রান্নার গল্প বান্নার গল্প

নিজেকে চাঙা রাখতে অনেকেই করছেন রান্নাবান্না। মডেল: আসিফ, ফাইল ছবি: অধুনা
নিজেকে চাঙা রাখতে অনেকেই করছেন রান্নাবান্না। মডেল: আসিফ, ফাইল ছবি: অধুনা
>যাঁরা সাধারণত ঘরের কাজ করেন না, এই করোনাকালে তাঁদের অনেকেই ঘরে নানা কিছু করছেন। বিশেষ করে রান্নাবান্না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা ভালোই বোঝা যায়। নিজের হাতে রান্নাবান্না করলে মনেও আসে প্রশান্তি। রান্নাবান্নায় আগ্রহী হয়ে ওঠার গল্প শুনিয়েছেন জাহীদ রেজা নূর

ফোড়ন দেওয়াটা সব সময়ই আমাকে নতুন অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দ দেয়। তেল ঠিকভাবে গরম হলে ছ্যাঁৎ করে ওঠে, তাতেই বোঝা যায়, আজকের সবজি বা ডাল থেকে ভুরভুর করে ঘ্রাণ বের হবে। আর অসাবধানে তেল গরম হওয়ার আগেই পাঁচফোড়ন দিলে সেগুলো কোনো শব্দ করে না। ঘ্রাণও পাওয়া যায় না!

রান্না শেখার সময় এই ব্যাপারগুলো জানা হয়ে যায়।

এখনো, এই করোনা বিপর্যয়ের সময়ও, নিজেকে চাঙা রাখার একটা উপায় রান্নাবান্না করা। এখন একটু কম উপকরণে দ্রুত রান্না করে ফেলাই ভালো। কিন্তু তাতে স্বাদ যেন ভালো থাকে, সে চেষ্টাটা থাকা দরকার। রান্না করতে আমি ভালোবাসি। তাই দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় এই কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা যায়।

আমার মতো অনেককেই রান্না শিখিয়েছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। ও দেশটায় যাওয়ার আগে ডিম আর আলু সেদ্ধ করে গোলমরিচ-লবণ দিয়ে তৃপ্তিভরে খাওয়াই ছিল রান্নার দৌড়। কিন্তু ১০ বছরের সোভিয়েত-জীবন আমাকে রীতিমতো রাঁধুনি করে ছেড়েছে।

ছেলেবেলায় বাড়ির রান্নাঘরে কী রান্না হচ্ছে, তা জানা ও দেখার আগ্রহ ছিল প্রবল। প্রতিদিনই রান্নার সময় হাঁড়ির ঢাকনা উল্টে দেখতাম, তাতে দুপুরের খাওয়াটা কেমন হবে, তা নিয়ে ধারণা হতো। আম্মা বা বেড়াতে আসা কোনো আত্মীয় মসলা বাটছেন, পেঁয়াজ কাটছেন—এ ধরনের ছবি এখনো মনে ভাসে। কিন্তু রান্না শেখার আগ্রহ হয়নি তখনো।

১৯৮৬ সালে ক্রাসনাদার শহরের কৃষি ইনস্টিটিউটে কেটেছে আমার প্রস্তুতি পর্বের পড়াশোনার কাল। ৪ নম্বর হোস্টেলে থাকত সদ্য নিজ নিজ দেশ থেকে আসা নবীন শিক্ষার্থীরা। ১০ নম্বরে থাকত ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন কোর্সে পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েরা আর ১১ নম্বরের একটা অংশে থাকত পিএইচডি গবেষকেরা। আমি আর রিপন (ড. মনিরুল ইসলাম, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিপ্রযুক্তির অধ্যাপক) থাকতাম ৪-এ, কিন্তু রাতের খাবার তখনো খাচ্ছিলাম ১০ নম্বর হোস্টেলে, ইনস্টিটিউটের বাঙালি ছয় বড় ভাইয়ের সঙ্গে।

কিছুদিন পর আমরা অনুভব করলাম, এভাবে প্রতিদিন এখানে এসে খাওয়া ঠিক নয়। রান্না করতে হবে নিজেদেরই। এরই মধ্যে আমরা বড় ভাইদের সঙ্গে বাজারে যাওয়া শুরু করেছি। কোথায় কী কিনতে পাওয়া যায়, সে ব্যাপারে ধারণা হয়েছে। তাই একদিন আমরা দুজন ঘোষণা দিলাম, এবার থেকে নিজেরাই রান্না করে খাব। বড় ভাইদের বললাম, খুব শিগগির আমরা তাঁদের দাওয়াত দেব।

রিপনের বন্ধু ছিল ইথিওপিয়ার ছেলে গিরমা। ছোটখাটো শান্ত একটা ছেলে। রিপন রাতে খাওয়ার জন্য দাওয়াত করল গিরমাকে। সানন্দে নিমন্ত্রণ কবুল করল সে।

আমরা সেদিন মাছ-মাংস কিছুই রান্না করিনি। আমাদের মেনু ছিল ভাত, বেগুনভাজা, ডিমভাজা আর ডাল। কিন্তু সেদিন রান্না করতে গিয়ে আমাদের বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ডাল যে ফুলে উঠে পাতিল ভাসিয়ে বন্যা ঘটিয়ে দিতে পারে, বেগুন যে ঠিকমতো ভাজা না হলে হঠাৎ করেই পুরোটা পুড়ে যেতে পারে, রান্নাঘর থেকে ডিমভাজা ঘরে আনার পথেই যে তা মেঝেতে পড়ে ধুলো-ময়লায় গড়াগড়ি দিতে পারে, সে কথা কে জানত! সে রাতটি ছিল সত্যিই এক বিভীষিকার রাত। রান্নাবান্না যে এত কঠিন কাজ, সেটা বড় ভাইয়েরা পাশে থাকতেন বলে এত দিন বুঝিনি। গিরমা অবশ্য সেই প্রায় অখাদ্যেরও ভূয়সী প্রশংসা করেছিল!

এরপর প্রতিদিনের রুটিন বদলে গেল। আগে দুপুরের খাওয়াটা খেতাম ক্যানটিনে। চেষ্টা করতাম দুই বেলাই হোস্টেলে খাওয়া যায় কি না। পরের বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার পর একা হয়ে গেলাম। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একা আমি বাঙালি। ব্যস! শুরু হলো পুরোদমে রান্নাবান্না। খুব প্রয়োজন না হলে তিন বেলাই বাড়ির খাবার! রুশ, ইয়েমেনি রুমমেটরাও সে খাবারে তৃপ্তি পেত। প্রতিদিনই বাজারে যাওয়া, প্রতিদিনই রান্না করা। এই স্বভাব এখনো যায়নি।

তখন তো এখনকার দিনের মতো ইউটিউবে বা পত্রিকার কোনো বিশেষ সংখ্যায় নানা ধরনের রেসিপি খুঁজে পাওয়া যেত না, তাই নিজের উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে রান্না করতে হতো। যেমন বড় মাছ রান্না করতে গিয়ে প্রায়ই ভুল করে ফেলতাম। অসময়ে হাঁড়ি ভরে পানি দিয়ে রান্নার বারোটা বাজিয়ে দিতাম। রান্নায় সময়মতো সবকিছু যোগ করা এবং পরিমাণমতো দেওয়া যে কতটা দরকারি, তা ভুক্তভোগীমাত্রেই জানেন।

এ গল্প আরেক দিন করা যাবে। আজ শুধু বলি, এখন এই দুঃসময়ে কীভাবে রান্নাবান্না করে সময়টা কাটানোর চেষ্টা করছি।

বৈচিত্র্যহীন খাবার আমার ভাল্লাগে না। প্রতিদিন একই নাশতা টেবিলে দেখতে ইচ্ছা করে না। এখন একদিন যদি সকালে রুটি বানাই, তাহলে আলুভাজি বা কয়েক পদের সবজি রান্না করি। সবজিটা একটু বেশি করেই করি, যেন কয়েক বেলা চলে যায়। রুটি গোল করার একটা নিয়ম আছে। বেলনের ডান দিকটায় একটু চাপ দিয়ে আটার গোলাটা বেলতে থাকলেই তা গোল হবে। নুডলস করি কখনো কখনো। গাজর, ক্যাপসিকাম থাকলে দিই, নইলে শুধু ডিম দিয়েই করে ফেলি। বাড়তি দেওয়ার মধ্যে গোলমরিচ আর সয়া সস। রাশিয়া থেকে শিখে আসা আলুভাজা আর পাউরুটিও সকালের নাশতা হিসেবে দারুণ। আলু চিপসের মতো করে কেটে নিয়ে হালকা তেলে ভেজে গোলমরিচ দিয়ে রুটির সঙ্গে গরম-গরম খাওয়া—অতুলনীয় স্বাদ। রমজান মাস চলে আসায় অবশ্য সে রুটিনেও পরিবর্তন এসেছে।

আগেই বলেছি, এই দুর্দিনে প্রতি বেলা রান্না হয় না। একবার রান্না করলে তা দুই দিন, এমনকি তিন দিন ধরেও খাওয়া হয়। তাই মাছ-মাংস রান্না হলে তা ভালোভাবে সংরক্ষণ করি। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে পেঁয়াজসহ আনুষঙ্গিক কাটাকাটি করি। কখনো টেলিভিশনের শব্দ বাড়িয়ে দিই, যেন হেঁশেল থেকেও করোনাভাইরাসের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানা হয়ে যায়।

রান্নাবান্না নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার অভ্যাস আমার বহুদিনের। নানা ধরনের দেশি-বিদেশি রান্না করে খাওয়াতে ভালো লাগে। নানাজনকে নানা সময় বাড়িতে ডাকি কিংবা রান্না করে অফিসে নিয়ে যাই। প্রতিদিনই কী রান্না করব—এই চিন্তা আমাকে ঘিরে রাখত এত দিন। কিন্তু এখন এই করোনাকালে সে গুড়েবালি। বাড়ির লোকেরাও ভিনদেশে আটকা পড়েছে। পরিবারের সদস্য বলতে আমি আর আমার ভাই। অফিসেও যাওয়া হয় না। তাই বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, রান্না করে আগের আনন্দটা আর পাচ্ছি না। খাওয়ার সঙ্গে স্বাদের সম্পর্ক আর স্বাদের সঙ্গে মানুষের, এ কথা বুঝতে পারছি। রান্নাবান্নার বাজেটের একটা অংশ কোনো প্রতিষ্ঠানে দিয়ে এটুকু অন্তত ভাবতে পারছি, কেউ না কেউ আমার বা আমার মতো কারও কারও সামান্য সহযোগিতায় খাবার পাচ্ছে। নিরন্ন মানুষের চেয়ে অসহায় আর কেউ হতে পারে না। সেই মানুষের পেটের খিদে মেটাতে পারার মধ্যেও রয়েছে আনন্দ। সেই আনন্দের ভাগীদার হতে ভালো লাগে।