করোনায় নিজেকে হারিয়ে ফেলছেন না তো?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আমরা আধুনিক বা উত্তর-আধুনিক মানুষ এবং আধুনিক যুগে বাস করি। আধুনিক চিন্তা, সংস্কৃতি, ইন্ডাস্ট্রি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের ভেতর একধরনের আধুনিক বাস্তবতা তৈরি করে দিয়েছে। যে বাস্তবতার আওতায় আধুনিক মানুষেরা একে অপরের ওপর তীব্রভাবে নির্ভরশীল, একে অপরের তীব্র প্রতিযোগী, একে অপর থেকে মানসিকভাবে প্রায় বিচ্ছিন্ন। সর্বোপরি আধুনিক মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে তৈরি করেছে এক দীর্ঘ নেতিবাচক সম্পর্ক, যেখানে সামগ্রিক প্রকৃতিকে সে নিজের লাভের জন্য নির্বিচার শোষণ করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।

অথচ প্রকৃতিতে ইকোলজি/বাস্তুসংস্থান নামক একটা সিস্টেম আছে যেখানে গাছপালা, পশুপাখি ও মানুষের মধ্যে কে কতটুকু প্রকৃতির দান আহরণ করবে, তার একটা অলিখিত নিয়ম আছে। কেউ যদি তার নির্ধারিত ভাগের চেয়ে বেশি ভোগ করতে যায়, তবে পুরো সিস্টেমই মারাত্মকভাবে ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ক্ষেত্রে আধুনিক মানুষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার অজুহাতে নির্বিচার প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানকে শোষণ করছে এবং বাস্তুসংস্থানের একক মালিকানা দাবি করছে।

সরলভাবে বলতে গেলে, এই সামগ্রিক শোষণমূলক ব্যবস্থা ও মালিকানা মনস্তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক মানুষের আধুনিক বাস্তবতা ও জীবনব্যবস্থা। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হলো, প্রকৃতির ওপর মানুষের দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের কারণে অধিকাংশ আধুনিক মানুষের ভেতর একধরনের ইগো/অহংবোধ তৈরি হয়েছে। এ কারণে তারা সচেতন ও অবচেতনভাবে মনে করে যে, তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণী এবং তারা চাইলেই তাদের চারপাশের পরিবেশকে সব সময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

অর্থাৎ অধিকাংশ আধুনিক মানুষ তার অন্তর ও বাইরের জগতে এমন এক বাস্তবতার ধারণা তৈরি করেছে, যা আপাতদৃষ্টিতে অনেকটা স্থায়ী ও সব সময় নিয়ন্ত্রণযোগ্য (Sense of Permanent Reality) বলে মনে হয়। এ ধরনের কল্পিত বাস্তবতার ধারণার ওপর ভিত্তি করে আধুনিক মানুষ অনেক দিন ধরে সমাজ ও পরিবেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক নির্ধারণ করে আসছে এবং ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একধরনের স্থায়ী নিরাপত্তা খোঁজার চেষ্টা করে আসছে।

কিন্তু প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনা (মহামারি, বন্যা, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, খরা ইত্যাদি) মানুষের সেই কল্পিত বাস্তবতাকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করে এলেও, সেসব ঘটনা পৃথিবীর সব জায়গায় একই সময়ে না ঘটার কারণে এবং সবার জীবনে একই প্রভাব না ফেলার কারণে বিশ্ববিবেক ও বিশ্ব জীবনদর্শনকে খুব বেশি জোরে ধাক্কা দিতে পারেনি। ফলে এসব ঘটনার রেশ শেষ হলেই আমরা আবার আমাদের কল্পিত বাস্তবতার ভেতর ডুব মেরেছি।

বর্তমানে নভেল করোনাভাইরাস নামক প্রাণঘাতী মহামারি পৃথিবীর প্রায় সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে, হাজার হাজার জীবন বিনা বাধায় কেড়ে নিচ্ছে। ফলে বলতে দ্বিধা নেই, আজ আমরা আধুনিক যুগে নয় বরং করোনার যুগে বাস করি। কারণ, আধুনিক মানুষের ভেতর লালিত এত দিনের কল্পিত স্থায়ী ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য বাস্তবতাকে/অহংবোধকে করোনা প্রায় ধূলিসাৎ করে দিয়েছে, মিথ্যা প্রমাণিত করে দিয়েছে।

এর ফলে মানুষের ভেতর তাদের জীবন ও চারপাশের পরিবেশের ওপর হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার একটা মিশ্র অনুভূতি তৈরি হচ্ছে এবং একধরনের কারণবিহীন শূন্যতা তৈরি হচ্ছে (Existential Emptiness)। আধুনিক মানুষ প্রথমবারের মতো সামষ্টিক অসহায়ত্ব (Collective Helplessness) অনুভব করছে। ফলে মানুষের ভেতর খুব স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন ধরনের মানসিক ভারসাম্যহীনতা, যেমন নিদ্রাহীনতা, অতিরিক্ত দুঃস্বপ্ন, অস্থিরতা, উদ্বিগ্নতা, অস্বাভাবিক আচরণ ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিচ্ছে বা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ, ভবিষ্যতে আমার কী হবে, পরিবারের সদস্যদের কী হবে, আত্মীয়স্বজনদের কী হবে, ব্যবসার কী হবে, চাকরির কী হবে, লেখাপড়ার কী হবে, ভাইরাসে সংক্রমিত হলে চিকিৎসা কই পাব ইত্যাদি বিষয়ে আমরা প্রায় অনিশ্চিত।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে সামাজিক, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা কাঠামোর মাধ্যমে সহায়তামূলক কর্মসূচির ভেতর দিয়ে জনগণের পাশে থাকা রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের দেশে এইধরনের কল্যাণমূলক নিরাপত্তাবলয় আমরা তৈরি করতে পারিনি অথবা যতটুকু তৈরি করতে পেরেছি, বিভিন্ন কারণে সেটার সুফল আমরা তেমন পাচ্ছি না। আমরা সবাই লড়ছি এক অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে, যে শক্তি মানুষকে মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। একজন সংক্রমিত লোকের সংস্পর্শে এসে অনেক সুস্থ মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে। ফলে মানুষের সঙ্গে মানুষের স্পর্শভিত্তিক মৌলিক যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।

এ ছাড়া এত দিনের দৈনন্দিন কাজের ধরনে হঠাৎ ব্যাপক পরিবর্তন আসার কারণে এবং সারা দিন বাঁধাধরা কোনো লক্ষ্য না থাকার কারণে আপনার ভেতরে একধরনের শূন্যতা কাজ করতে পারে। বর্তমানের এই সামগ্রিক অনিশ্চয়তার ভেতর সংগত কারণেই আপনি এমন কিছু আবেগ, অনুভূতি, চিন্তা ও আচরণের মুখোমুখি হতে পারেন, যেগুলোর সঙ্গে আপনি নিজেই অপরিচিত। এ ধরনের নতুন মানসিক বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারলে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।

এমন হলে কী করবেন?

স্থান, কাল, পাত্র, মানসিক গঠন ও জীবনদর্শন ভেদে বর্তমান অনিশ্চিত পরিস্থিতি একেক জনের ভেতর একেক ধরনের নেতিবাচক উপসর্গ তৈরি করবে এবং সেগুলো মোকাবিলা করার কৌশলও ভিন্ন হবে। সুতরাং বাঁচতে হলে, সুস্থ থাকতে চাইলে আমাদের কাছে যতটুকু সম্পদ আছে, আমাদের কাছে যতটুকু ইতিবাচক মানসিক শক্তি আছে, ততটুকু দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিকে সামাল দিতে হবে। যেকোনো ধরনের বাস্তবতার প্রতি নমনীয় ধারণা পোষণ করতে হবে। নইলে এ রকম কেন হচ্ছে, এ রকম তো হওয়ার কথা ছিল না টাইপের চিন্তা এসে আপনার মানসিক জগৎকে ওলটপালট করে দিতে পারে।

আপনার ভেতর যদি কোনো কারণে কোনো নেতিবাচক চিন্তা, অনুভূতি ও আবেগ আসে, তবে সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোর প্রতি কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে একটু সময় নিন নিজের কাছ থেকে। ওই চিন্তা (ইতিবাচক-নেতিবাচক), অনুভূতি (সুখকর- দুঃখমূলক) ও আবেগের (রাগ, ক্ষোভ, বিদ্বেষ ভাব, বিরক্তিভাব) ইত্যাদির সঙ্গে একাত্ম না হয়ে যদি কিছু সময় নিরপেক্ষ থাকতে পারেন, তবে দেখবেন এগুলো স্থায়ী কিছু নয়, স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার মন থেকে উধাও হয়ে যাবে।

বাড়িতে থাকাকালীন নিয়মিত কাজের একটি তালিকা বানান এবং সময়টা কাজের ভেতর দিয়ে কাটান। প্রয়োজনের বেশি শুয়ে-বসে থাকা, টিভি দেখা, সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার থেকে নিজেকে বিরত রাখুন। প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম করুন, প্রার্থনা করুন, শ্বাসপ্রশ্বাসের ওপর মনোযোগ রেখে ৫-১০ মিনিট ধ্যান করুন, পরিবারকে মানসিকভাবে সময় দিন, ফোনের মাধ্যমে আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নিন, পারলে সহায়তা করুন এবং বিশেষভাবে পৃথিবীর সব প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি মৈত্রী ভাব চর্চা করুন।

এই করোনা মহামারি সংকট আপনার ভেতর শুধু ভয়, আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা তৈরি করছে না, বরং জীবন-বাস্তবতার এমন একটি অর্থ উপলব্ধি করতে সহায়তা করছে ও কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সক্ষমতা বাড়াচ্ছে, যেটা করোনা-পরবর্তী আপনার জীবনকে আরও বেশি পরিশুদ্ধ ও অর্থপূর্ণ করে তুলতে সাহায্য করবে।

লেখক: মনোবিজ্ঞানী ও একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত