সাহস নিয়ে স্বপ্ন দেখা

>দুনিয়াজোড়া যখন করোনাভাইরাসের আতঙ্ক, তখন আলোকচিত্রী দম্পতি চঞ্চল মাহমুদ ও রায়না মাহমুদ লড়ছেন দুটি ভিন্ন রোগের সঙ্গে। রায়না মাহমুদ যুদ্ধ করছেন ক্যানসারের বিরুদ্ধে, চারবার হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়া চঞ্চল মাহমুদের ডায়াবেটিসের ঝুঁকিটাও কম নয়। তবু তাঁরা সাহস নিয়ে এই দুর্দিনে স্বপ্ন দেখেন শান্ত আগামীর।
মনে সাহস রেখেই আগামীর সুসময়ের জন্য লড়াই করছেন চঞ্চল মাহমুদ ও রায়না মাহমুদ। ছবি : পারিবারিক অ্যালবাম
মনে সাহস রেখেই আগামীর সুসময়ের জন্য লড়াই করছেন চঞ্চল মাহমুদ ও রায়না মাহমুদ। ছবি : পারিবারিক অ্যালবাম

পায়রাগুলো সময় মেনে হাজির হয় ঠিক সকালবেলা। জানালার ওপর ওদের ওড়াউড়ি বাড়তে থাকলে চঞ্চল মাহমুদের আলসে ঘুমটা কেটে যায়। তিনি বিছানা ছেড়ে মুঠো ভরে চাল নেন। ছিটিয়ে দিতে দিতে ভাবেন, ধানমন্ডি ১ নম্বর সড়কের বাসাটায় কত বছরই তো কাটালেন, আগে কেন পায়রাগুলোর দেখা মেলেনি? বাংলাদেশের মডেল ফটোগ্রাফির এই অগ্রপথিক ভাবেন, প্রকৃতি আর প্রাণীর প্রতি মানুষ কী বিরূপ আচরণই না করেছে এত দিন।

‘এরপর ঘরে ঢুকে দুজনের সকালের নাশতা তৈরি করি। সকালের এই দায়িত্বটা আমার কাঁধে। অন্য কাজও কিন্তু করি, এই যে এখন পটোল ছিলছি!’ কথাটুকু শেষ হতেই চঞ্চল মাহমুদের স্বভাবজাত হাসির উচ্ছ্বাস ধরা দেয় এ প্রান্তে। স্ত্রী আলোকচিত্রী রায়না মাহমুদ তখনো যে পাশেই, বোঝা যায় তাঁর হাসির মৃদু ধ্বনিতে।

৮ মে দুপুরে আলাপের শুরুটা হয়েছিল অবশ্য রায়না মাহমুদের সঙ্গেই। তাঁর শরীরে কর্কট রোগের বিস্তার, আর্থিক সংকটের সুরাহা হলে অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপির সঙ্গে চলমান রেডিয়েশন থেরাপি, করোনার শঙ্কা নিয়েই নিয়মিত হাসপাতালে যাতায়াত। অনেকে যখন করোনা–কালে কষ্টের দিন কাটাচ্ছে, তখন রায়না মাহমুদের যুদ্ধটা কর্কটের বিরুদ্ধে, করোনার আতঙ্ক নিয়েই।

রায়না মাহমুদ যোগ করেন, ‘শুধু তো আমার অসুস্থতা নয়। চঞ্চল মাহমুদ চারবার হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। উচ্চমাত্রায় ডায়াবেটিস। দুজনের জন্যই এটা কঠিন সময়। আমাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা একেবারে কম। তবু নিয়মিত আমি হাসপাতালে যাচ্ছি। ঘরে দূরত্ব মেনে চলছি। জীবনকে জীবনের নিয়মে কাটিয়ে দিচ্ছি।’ এত কিছুর পরও তাঁরা জীবনকে নিয়েছেন ইতিবাচকভাবে।

শুরুতে শঙ্কাগ্রস্ত দিনের কথা

গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের কথা। স্তনে টিউমার দেখা দিলে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন রায়না মাহমুদ। চিকিৎসক পরামর্শ দিলেন বায়োপসি করার। বায়োপসির পর জানা গেল, ক্যানসার বিস্তৃত হয়েছে।

পরীক্ষা তো ভুলও হতে পারে, আবার পরীক্ষা করালেন। দ্বিতীয়বারও জানা গেল, ক্যানসার পজিটিভ, যা আছে দ্বিতীয় ধাপে। জরুরি অস্ত্রোপচার করার পরামর্শ দিলেন চিকিৎসক।

বিপত্তি বাধাল বিশাল অঙ্কের অর্থ। নিজেদের সঞ্চয়টুকু সেখানে অপ্রতুল। চঞ্চল মাহমুদ সহযোগিতা চাইলেন সরকারের, প্রিয়জনদের। পাশে দাঁড়ালেন তাঁদের বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষীরা। ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শুরু হলো রায়না মাহমুদের চিকিৎসা।

রায়না মাহমুদ কৃতজ্ঞতার সুরে বলেন, ‘বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাদের আপনজন। ব্যয়বহুল ক্যানসার চিকিৎসায় মানসিক ও আর্থিকভাবে পাশে দাঁড়ানো এই হৃদয়বান মানুষদের প্রতি মন থেকে কৃতজ্ঞ আমরা।’

তিন সপ্তাহ পরপর একে একে ছয়টা কেমোথেরাপি নিয়েছেন। ২৫টির মধ্যে ১২টা রেডিয়েশন থেরাপি নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় কেমোথেরাপি দেওয়ার পর নিজেকে আয়নায় দেখে চোখের পানি লুকিয়েছেন। রায়না মাহমুদ বলেন, ‘মাথার চুল পড়ে যাচ্ছিল। খুব হতাশ হয়ে পড়ছিলাম। তখন আমার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিল। তিনি স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তাঁর কষ্টটা আমি অনুভব করতে পারছি।’

সেই কষ্ট চেপেই এগোচ্ছে রায়না মাহমুদের চিকিৎসা। সহযোগীর মতো পাশে আছেন চঞ্চল মাহমুদ। আছেন তাঁদের সন্তানেরা। এখন হাসপাতালে যেতে কখনো তিন সন্তানের কাউকে সঙ্গে নেন, কখনোবা একাই যান। নিজের নিরাপত্তাটুকু নিজেই করে নেন রায়না মাহমুদ। এসবের মধ্যে অর্থনৈতিক সংকটটাও ভাবিয়ে তোলে। রায়না মাহমুদ বলেন, ‘আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। করোনার কারণে কাজ বন্ধ। আমার এই ব্যয়বহুল ক্যানসার চিকিৎসা চালিয়ে নেব কীভাবে, এ নিয়ে চিন্তা হয়।’

সুন্দর দিনে যৌথ প্রদর্শনীর স্বপ্ন

বহমান জীবনে এসব দুশ্চিন্তাকে প্রশ্রয় দিতে চান না চঞ্চল মাহমুদ আর রায়না মাহমুদ। মার্চের মাঝামাঝি থেকেই ঘরবন্দী তাঁরা। একসময় গৃহকর্মীকেও ছুটি দিয়েছেন। ঘরদোরের কাজ ভাগাভাগি করে সামলান দুজনে। আনন্দে থাকতে সময়টুকু সাজিয়ে নিয়েছেন নিজেদের মতো। যেমন ফুরসত পেলে বই হাতে বসেন, দেখেন প্রিয় কোনো সিনেমা। লেখক আশাপূর্ণা দেবীর সুবর্ণলতা বইটি নতুন করে পড়ছেন রায়না মাহমুদ। পাশেই রেখেছেন শরৎরচনাবলী, সমরেশের বইগুলো। তিনি বলেন, ‘নতুন করে সব পড়তে ভালো লাগছে। অনেকে বলে সময় নাকি কাটে না। আমাদের সময় তো ভালোভাবেই কাটছে। সময়টাকে আসলে নিজের মতো ভাগ করে নিলে সহজেই কেটে যায়।’

চঞ্চল মাহমুদ নিজের ঘরের টিভির পর্দায় ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক কিংবা অ্যানিমেল প্ল্যানেট ছেড়েই রাখেন। মডেল আলোকচিত্রী হিসেবে তাঁর বিপুল খ্যাতির কাছে বন্য প্রাণী আলোকচিত্রীর পরিচয়টা সেভাবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। তবে তিনি বন্য প্রাণীর ছবি তোলার শখটা মনে মনে লালন করেন এখনো।

ফোনের ও-প্রান্ত থেকে চঞ্চল মাহমুদের গল্প শুনি। তাঁর হুটহাট বেরোনোর প্রিয় জায়গা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সময় পেলেই ছুটে যান ক্যামেরা কাঁধে। সঙ্গে থাকেন রায়না মাহমুদ। থাকেন তাঁর ফটোগ্রাফি স্কুলের সন্তানসম ছাত্ররা।

করোনার কারণে সে যাত্রা বন্ধ হলেও দুজনে যৌথ প্রদর্শনী আয়োজনের কথা পাকা করে ফেলেছেন। নিজেদের তোলা ছবিগুলো নিয়ে শিগগিরই আয়োজন করতে চান প্রদর্শনীটি। রায়না মাহমুদ মজা করে বলেন, ‘আমি ওকে বলেছি, গ্যালারির এক কোনে আমার জন্য ছোট একটু জায়গা দিলেই হবে।’ কথাটি শেষ হতেই হাসতে থাকেন দুজনে। সে হাসিতে যে মিশে আছে নির্ভরতা আর ভালোবাসা, দূর থেকেও তার আঁচ অনুভব করা যায় অবলীলায়।

তখন আগামীর প্রত্যাশায় মনে মনে জনপ্রিয় গায়ক নচিকেতাকে আওড়াই, ‘একদিন ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে...’।