করোনাকালের অভ্যাস: কী দেবে আমাদের

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

নব্বইয়ের দশকের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ থেকে ২০০১ সালের ৯/১১ এবং তার পরের ঘটনাক্রম বিশ্বকে একভাবে বদলে দেয়। ক্রমেই বিশ্ববাসীকে অবিশ্বাসী করে তোলার প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় অবিশ্বাসের অর্থনীতি। মেটাল ডিটেক্টর থেকে আর্ক, ফিঙ্গার স্ক্যানার থেকে রেটিনা স্ক্যানার, কত কিছুই যে আবিষ্কার হয়েছে, আর হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই; সেসব নিরাপত্তা আর সুরক্ষার নামে দেশে দেশে ব্যবহার হচ্ছে। নানা হাত ঘুরে অর্থ ঠিকই পৌঁছে যাচ্ছে গন্তব্যে।

নয়া স্বাভাবিকতা যে অতীতের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে, তাতে সন্দেহ নেই। কারণ, চলমান করোনা প্রাদুর্ভাব বিশ্বকে বদলে দিচ্ছে আরেকভাবে। হচ্ছে নতুনতর মেরুকরণ। এর পাল্লায় পড়ে, নয়া স্বাভাবিকতায় মানুষ ক্রমেই হয়ে উঠবে অসামাজিক, আবেগবর্জিত আর সন্দেহবাতিকগ্রস্ত জীব। অন্তত সেই ধারণাই পোষণ করছেন বিশেষজ্ঞরা।

মানুষের আচরণগত পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে ব্যবসা এখানেও হবে। ইতিমধ্যে শুরুও হয়েছে। টিকা আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত চলবে কিছু সামগ্রীর রমরমা ব্যবসা। থার্মাল স্ক্যানার, স্যানিটাইজার, মাস্ক, পিপিই, টিকা—ফেল কড়ি মাখ তেলের ট্র্যাডিশন সমানে চলবে। আর টিকা আবিষ্কারের পরেও এসবের অনেক কিছুই অব্যাহত থাকবে, সঙ্গে যোগ হবে নতুন কিছু। আগামীর দিনগুলোয়, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এভাবেই অভ্যস্ত হতে থাকবে মানুষ। সৃষ্টি হবে আরেক নতুন অর্থনীতির। সন্দেহবাতিকগ্রস্ত অর্থনীতি।

মজার কথা হলো, এখন যেসব বিষয় মানুষের অবরুদ্ধ জীবনকে পরিচালনা করছে, পরবর্তী সময়ে সেসবই নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। ফলে বদলে যাবে কাজের ধরন, পরিবেশ আর পদ্ধতি। এমনকি বদল আসবে ক্রেতাদের মনোভাবেও।

শরীরী উপস্থিতি ক্রমেই কমতে থাকবে।  চরৈ বেতির মন্ত্রে দীক্ষিত মানুষ পাগলপারা হবে না। বেপরোয়া ছোটাছুটিতে রাশ টেনে উসাইন বোল্ট থেকে মো ফারায় পরিণত করবে নিজেকে। অন্যদিকে অফিসে না এনেও যাঁদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া যাবে, তাঁদের দিয়ে সেভাবেই সেটা করানো হবে। অফিসগুলো তখন স্পেস আর ওভারহেড কমাবে। এই ধরনের আরও কত কী যে সামনে দেখার সুযোগ হবে, তার শেষ নেই। দেশে দেশে দোকানগুলোতেও হবে একই অবস্থা। ক্রেতাকে সুরক্ষিত রাখতে নানা তোড়জোড় করতে গিয়ে তাদের ঘাড়ে চাপবে অতিরিক্ত খরচ, পরোক্ষে সেটাই গিয়ে ভারী করবে ক্রেতার বোঝা।

তবে দেখা হলে মানুষ কি আর আগের মতো আন্তরিক হবে? আবেগময় থাকবে? করমর্দন করবে কি? জড়িয়ে ধরবে একে অপরকে? এসব প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। কারণ আশঙ্কা, করোনা মানুষকে অন্য রকমভাবে সন্দেহবাতিকগ্রস্ত করে তুলবে কি না! সে ক্ষেত্রে এই সন্দেহবাতিক, ৯/১১–পরবর্তী সময়ের মতো হবে না; বরং তা হতে পারে আরও সাংঘাতিক।

পাশাপাশি বসবে না, স্পর্শ এড়িয়ে চলতে চাইবে। তাই হয়তো অমূলক হয়ে যাবেন রবীন্দ্রনাথ। একটুকু ছোঁয়ায় কেউ আর মনে মনে ফাল্গুনী রচনা করবে না। দুদণ্ড মুখোমুখি বসবার সাহস দেখানোর মতো দুঃসাহসীদের সংখ্যা হয়তো ক্রমেই নগণ্য হয়ে উঠবে। বরং সবকিছুই হবে ভার্চ্যুয়াল।

বন্ধুদের আড্ডা তাহলে কি উঠে যাবে? সেটা কি হয়ে যাবে ভার্চ্যুয়াল? কিংবা সেই ওপার বাংলার রকবাজি? এক গ্লাসের ইয়ার, এই প্রবাদটিও কি মুছে যাবে?

অবরুদ্ধ জীবন মানুষকে প্রযুক্তিনির্ভর করেছে। নানা সহজলভ্য মাধ্যম ব্যবহার করে কত কিছুই তো সেরে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে; জরুরি মিটিং থেকে আড্ডা, সভা থেকে সেমিনার, স্বাস্থ্যসেবা থেকে প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগ; কাঁচাবাজার থেকে ওষুধ কেনা, শপিংও। আগেও কি হতো না? কিন্তু ঠিক এভাবে তো ভাবা হয়নি। এমনকি যাঁরা প্রযুক্তির ওপর পুরোপুরি নিজেকে সমর্পণ করতে প্রস্তুত ছিলেন না, তাঁদেরও করোনা বাবাজি বাধ্য করেছে।

এ জগতে নতুন যাঁরা, প্রযুক্তি তাঁদের পথিক নবীর গানের মতোই হাতছানি দিচ্ছে; অচেনা পথিক কোথা যাবি চল?

অনেকেরই মনে থাকার কথা, ইন্টারনেট চালু হলে বয়স্ক বাবা-মায়েরা রোমান হরফে বাংলা লিখে ছেলেমেয়েদের কাছে ই–মেইল করতেন। আস্তে আস্তে অদৃশ্য কথোপকথন শুরু হলো। এরপর তা দৃশ্যমান হলো। বর্তমান পরিস্থিতি সেই ভার্চ্যুয়াল জীবনের নয়া পরিবর্ধন বললে অত্যুক্তি হয় না।

কিন্তু এই নির্ভরতায় মানুষ কি আরও অলস হতে থাকবে? হয়ে পড়বে কি ঘরকুনো? এমনিতেই তো বলা হয় ইট-কাঠ-পাথরের জঙ্গলে খোপবন্দী জীবন। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটাই কি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। এমনকি কিছু করতে গেলে পাছে লোকে কিছু বলে নয়, পাছে কিছু ঘটে যাওয়ার জুজু পিছু নেবে? আর তা যদি হতেই থাকে তাহলে বাজি রেখে বলা যায়, মানুষের অসুস্থ হওয়ার সংখ্যাও বাড়তে থাকবে পাল্লা দিয়ে।

আচ্ছা, নতুন পরিস্থিতিতে কী হবে কিছু কিনতে গেলে, খেলতে গেলে বা কর্মক্ষেত্রে। তাহলে কি পৃথিবীটাই কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলার একটা জায়গায় পরিণত হবে। ছুঁয়ে দিলেই আকাশ ভেঙে পড়বে! ভাবলেই তো কেমন লাগে।

ক্রিকেটে এখন থুতু আর ঘাম দিয়ে বল ঘষা যাবে না, তাহলে কী হবে? কেমন করে বলের চকচকে ভাবটা ওঠানো হবে? তাহলে কি রিভার্স সুইং হবে না? নাকি মাঠের পাশে রাখা খনিজ পদার্থমিশ্রিত পানি বা অন্য কোনো তরল ব্যবহার করবেন ক্রিকেটাররা? আবার ফুটবল মাঠে থুতু ফেললেই হলুদ কার্ড, এমন কত কাণ্ডই যে হবে খেলার মাঠে। টিকা আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত বডি কন্টাক্ট গেমগুলোকে তাহলে শিকেয় তুলে রাখতে হবে। স্টেডিয়ামে কয় হাত অন্তর বসবে দর্শক? নাকি দর্শকশূন্য থাকবে? এর আপাতত উত্তর বুন্দেসলিগা শুরু হয়েছে ৬৪ পৃষ্ঠার নতুন নিয়মকানুন অনুসরণ করে। দর্শক থাকবে না। সাংবাদিকেরা বসবে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ইত্যাদি আরও কত ফন্দিফিকির।

আর অন্য খেলার মাঠ তাহলে দর্শকশূন্য থাকবে? কিংবা সিনেমা, থিয়েটার, মেলা, প্রদর্শনী? সবই ভার্চ্যুয়াল?

কিংবা গণপরিবহন? বাস, ট্রেন, লঞ্চ? এবার না–হয় ঈদে অনেকে বাড়ি যেতে পারবেন না। যাঁদের যাওয়ার তাঁরা তো আগেই ভোকাট্টা। তবে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে অনেকেই আবার এরই মধ্যে যাচ্ছেনও। কিন্তু ভবিষ্যতে? ট্রেন আর লঞ্চের চিরাচরিত সেই দৃশ্য আর্কাইভে স্থান পাবে?

সিনেমার একটা বিকল্প কিন্তু স্পেন বের করেছে ফেলেছে। তামাশা দেখতে কোনো পয়সা লাগবে না। ব্যালকনি সিনেমা। রোজ সন্ধ্যায় দেখানো হচ্ছে। ইলেকট্রনিক বোর্ডে সিনেমা চালানো হচ্ছে। পুরবাসী ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বা বসে তা উপভোগ করছেন। বেশ কিন্তু!

এদিকে ডেনমার্কে লকডাউন উঠিয়ে দিয়েছে। স্কুল খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে ক্লাস হচ্ছে স্টেডিয়ামে। ফ্রান্স আর ইতালিতেও উঠেছে নিয়ম সাপেক্ষে লকডাউন। কিন্তু মুখোশ আর দস্তানা অবশ্য পরিধেয়।

সব স্থাপনায় ওয়াক থ্রু মেটাল ডিটেক্টরের আগে অবশ্যই থার্মাল স্ক্যানার যে বসবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সারা বিশ্বের কত কোটি স্ক্যানার বিক্রি হবে, তার হিসাব কে রাখছে। এখন অফিসে অফিসে শোভা পাবে হ্যান্ড স্যানিটাইজার মেশিন। নানা ধরন আর ডিজাইনের। এ নিয়েও হবে এক জবর ব্যবসা।

তবে যা–ই বলেন, মাস্ক নিয়ে কিন্তু তেলেস মাতি শুরু হয়েছে। কারণ, কোন মাস্কে কাজ হবে আর কোনটায় হবে না, তা নিয়ে চলছে চাপান উতোর। এদিকে অনেক কিছুর মতো ভেন্ডিং মেশিনে মাস্ক বিক্রি শুরু হয়েছে। আবার সেদিন দেখলাম লিথুয়ানিয়ায় মাস্ক ফ্যাশন উইক হচ্ছে। বেড়ে আইডিয়া! এই মাস্কে আবার নানান নকশাও করা হচ্ছে। ফ্যাশনের নতুন অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে মাস্ক। পোশাক আর জুতোর সঙ্গে মিলিয়ে পরা শুরু হলো বলে।

জগজিৎ সিংয়ের একটা অসাধারণ গজল আছে। আপনারা সবাই সেটা জানেনও— তুম ইতনা জো মুসকুরা রাহে হো।/কেয়া গম হ্যায় জিসকো ছুপা রাহে হো…। মাস্ক পরা দেখে এই গানটা অনুরণিত হচ্ছে। কারণ, অনেক কিছুই মাস্ক পরে সহজে এড়িয়ে যাওয়া যাবে। মাস্ক আপনাকে সেই সুবিধাটুকু দেবে। এখন আর আপনি হাসলেও সেটা কেমন হাসি, তা বুঝতে পারবে না। আবার এটা পরে অট্টহাসি হাসাও যাবে না। ফলে ক্ষুধিত পাষাণের পোস্ট মাস্টারের মতো কেউ আর আপনাকে বলতে পারবে না, মশায় আপনার হাসিটা তো সমুদ্রের মতো।

দূষণের কারণে মাস্ক পরা অনেক দেশেই হচ্ছে। আবৃত আর অনাবৃত অংশের ত্বকের মধ্যে ফারাক দেখা যাচ্ছিল। এখন সেটা আরও বেশি করে হবে। ছোটবেলা জীববিজ্ঞানে সালোকসংশ্লেষ পড়েছেন? সবুজ ঘাসের ওপর ইট রাখলে কয়েক দিন পর ফ্যাকাশে হয়ে যায়। আমাদের মুখেও তাই হবে, মেলানিন ত্বকের কিছু অংশে সেভাবে কার্যকর থাকবে না। ফলে বিশ্ববাসীর মুখের কিছু অংশের রং বদল ঠেকাতে তৈরি হবে নতুনতর প্রসাধন। নানা ক্রিম—গালভরা সব নামের। আসবে চটকদার বিজ্ঞাপন। আর শেষমেশ ব্যবসা।

কেবল মাস্ক বলি কেন, অনেকেই শিল্ড পরে ঘুরছেন। সেদিন এক প্রৌঢ়ের সঙ্গে করোনাবিষয়ক আলোচনায় শিল্ড প্রসঙ্গ আসতে তিনি বললেন, ছোটবেলায় শিল্ড বলতে ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনালে বিজয়ী আর বিজিত দলকে দেওয়া কারুকাজ করা বৃহদাকার বস্তুকে জানতাম। বড় হয়ে আরও কত কিছু যে জানা হলো! আর এই বুড়ো বয়সে করোনারোধী শিল্ড দেখে জীবন ধন্য হয়ে গেল। মানুষকে সঙ সাজানোর যতেক ব্যবস্থা হয়েছে। আরও হবে। লক্ষ্য একটাই, মোক্ষলাভ অর্থাৎ ব্যবসা।

আর হ্যাঁ, সব হবে ভার্চ্যুয়াল। পড়াশোনা, খেলাধুলা, ব্যায়াম, মেডিটেশন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ডাক্তার দেখানো, চুল ছাঁটা, মেকওভার। ওহ, তথ্যটা দিয়ে রাখা জরুরি। চীনে ইতিমধ্যে চালু হয়েছে ভার্চ্যুয়াল হাসপাতাল। যাহোক, শেষমেশ, পয়সা আপনাকে ঠিকই দিতে হবে। অবশ্যই প্লাস্টিক মানি। কিংবা কেবলই ট্রান্সফার। এ নিয়ে কথায় কথায় পরিচিত এক সিনিয়র বললেন, বুঝলে বন্ধু, এটা আরেক খেলা। আমজনতাকে মুখাপেক্ষী করে তোলার কারসাজি বৈ তো নয়।

সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, পৃথিবীটাকেই যেন লখিন্দরের লৌহবাসরে পরিণত করা হচ্ছে। আর সেখানে যেমন একটা ছিদ্র রাখা হয়েছিল, তেমনি করে এখানেও থাকবে নানা ফাঁকফোকর।