দূরে থেকেই ঈদের আনন্দ

দূরে থেকেই যেন সামনে থাকা। করোনার এই সময়ে ঈদের উদ্‌যাপন না হয় এভাবেই হলো, সবার সুস্থ থাকাটাই তো বড় কথা। মডেল হয়েছেন সংবাদ উপস্থাপক আলফী খান, তাঁর স্বামী আখতারুজ জামান খান ও মা নাসরীন খান। ছবি: কবির হোসেন
দূরে থেকেই যেন সামনে থাকা। করোনার এই সময়ে ঈদের উদ্‌যাপন না হয় এভাবেই হলো, সবার সুস্থ থাকাটাই তো বড় কথা। মডেল হয়েছেন সংবাদ উপস্থাপক আলফী খান, তাঁর স্বামী আখতারুজ জামান খান ও মা নাসরীন খান। ছবি: কবির হোসেন
>রেলস্টেশনে টিকিটের লাইন, বাস–লঞ্চ টার্মিনালে ঈদের আগের সেই পরিচিত ভিড়, জনসমুদ্র এবার অনুপস্থিত। প্রতিবছরই যাঁরা ঈদে বাড়িতে যান, করোনাকালে এবার তাঁরা যেতে পারবেন না। থেকে যাবেন যাঁর যাঁর জায়গায়। তাই বলে কি ঈদের আনন্দ–উদ্​যাপন হবে না? হবে, ফোনে–ভিডিওতে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে। 

শুকনা খেজুর শাখার মতো শাওয়াল মাসের একফালি বাঁকা চাঁদ উঠবে পশ্চিমের আকাশে। মেঘ না থাকলে চোখেও পড়বে। রেডিও–টিভিতে বাজবে নজরুলের সেই চেনাগানের সুর ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ...’। এবারের ঈদে অনেক আনন্দ, অনেক চেনা ছবিই থাকবে না।

এই ঈদে আগের অনেক কিছুই যে থাকছে না, তার আলামত বেশ কিছু দিন থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল। রাজধানীর বিপণিবিতানগুলোর সামনে সুসজ্জিত তোরণ, রাতের বাহারি আলোকচ্ছটা, আর সামনে–ভেতরে উপচে পড়া ভিড় নেই, মাঝরাত পর্যন্ত কেনাকাটা। করোনাভাইরাসের এই দুঃসময়ে বেশির ভাগ মানুষের ঈদের কোনাকাটার তাড়া নেই। রাজধানীতে দূরপাল্লার বাস টার্মিনাল প্রায় জনহীন। টিকিটের জন্য লাইন নেই রেলস্টেশনে, হুড়োহুড়ি নেই সদরঘাটে। রাজধানীর বাইরেও এক জেলার কর্মজীবীদের অন্য জেলায় নিজের বাড়িতে যাওয়ার তাড়া নেই। অতি ব্যতিক্রম ছাড়া ঈদে কেউ এবার বাড়ি যাচ্ছেন না। 

ঈদে গ্রামের বাড়ি ফেরার যে প্রবল প্রেরণা, তা কাজ করছে না কারোর ভেতরেই। তবে মনের ভেতরে মোচড় দিচ্ছে আক্ষেপ। বুদ্​বুদের মতো ঠেলে উঠে আসছে নানা স্মৃতি। ঢাকা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাজমুন নাহার বলেন, ‘১৯৯৯ সাল থেকে ঢাকায় আছি। এবারেই প্রথম ঈদে বাড়ি যেতে পারছি না।’ তিনি নিউ ইস্কাটন রেডে থাকেন, স্বামী জাহিদুল বারীও আইনজীবী। এক সন্তান এই দম্পতির, পড়ে এ লেভেলে। 

নাজমুন নাহার বলেন, ‘আমরা সাধারণত শবে কদরের রাতের পরদিন রওনা দিই। অনেক দূরের পথ বলে ঈদে বাসেই যাতায়াত করি। আর এখন বাসগুলোও খুব উন্নত আর আরামদায়ক।’ তাঁর শ্বশুর বাড়ি বগুড়া সদর আর বাবার বাড়ি পাশেই বগুড়ার শেরপুর উপজেলায়। ফলে শ্বশুর বাড়িতে ঈদ করে পরের দিন বাবার বাড়ি যাওয়া হয়। শ্বশুর বাড়িতে এখনো যৌথ পরিবার। স্বামীর ভাইয়েরা তাঁদের ছেলেমেয়ে নিয়ে আসেন, বিরাট বাহিনী। হইচই করে খুব আনন্দে দিনগুলো কেটে যায়। এবার এসব কিছুই হবে না। সবার মন খারাপ। ঈদের দিন সবার সঙ্গে ফোনে কথা হবে। আপনজনের মুখটি দেখা যাবে ইমো, হোয়টসঅ্যাপে। এই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক হুমায়ুন কবির চৌধুরীর বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া। ঢাকার উত্তরায় থাকেন। তিনি বলেন, ‘বাড়ি ছাড়া ঈদ করি না। আমাদের লঞ্চ ছাড়ে রাত নটায়। বেলা তিনটায় স্ত্রী, দুই মেয়ে, ব্যাগট্যাগসমেত বাসা থেকে বের হই। মনের মধ্যে একরকম উৎকণ্ঠা শুরু হয়—সময়মতো পৌঁছাতে পারব কি না! প্রচণ্ড যানজট থাকে রাস্তায়। ট্যাক্সি থামলেই বুকের ঢিপ ঢিপ বেড়ে যায়। শাঁখারীবাজার মোড়ে আসার পর যেন আর চলেই না। তখন রাত নেমে পড়ে। আমরাও নেমে পড়ি রাস্তায়। প্রায় মাইলখানেক পথ। মেয়েদের হাত ধরে একরকম হুড়োহুড়ি করেই ছুটতে হয়। সদরঘাট জনসমুদ্র। নির্দিষ্ট ঘাটে গিয়ে একবার লঞ্চে উঠতে পারলেই ব্যস, সব ক্লান্তি উদ্বেগ নিমেষে শেষ। বুড়িগঙ্গার খোলা হাওয়ার ঝাপটা লাগে গায়ে। মনে হয় বাড়িতে পৌঁছে গেছি। আহ, সে যে কী প্রশান্তি, বলে বোঝানো যাবে না।’ 

হুমায়ুনদের আট ভাইবোনের বড় পরিবার। ঢাকায় আরও দুই ভাই থাকেন। তাঁরাও গ্রামে যান। ঈদের পরদিন বোনেরা আসেন। ঈদের জামাত শেষে মা–বাবার কবরে যান জিয়ারত করতে। এসব এবার হবে না। বিষণ্ন স্বরে বলছিলেন, ‘পুরোনো দিনের ঈদের স্মৃতি ভেসে আসছে মনের পর্দায়।’ 

সরাসরি যেতে না পারলেও যোগাযোগ হবে প্রযুক্তির কল্যাণে। পেশাগত কারণেই হুমায়ুন কবির জুম সফটওয়্যারে নানা রকম সভা করে অভ্যস্ত। জানালেন, ঈদের দিনে জুমেই সবার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ, কথাবার্তা হবে এটা বলে রেখেছি। একই রকম কথা বলেন, ব্যবসায়ী জামিউল হাসান। অনলাইনে যোগাযোগ হবে ঈদের দিন। তাঁর বাড়ি রংপুর শহরের ধাপে। বাবা নেই, মা আছেন। স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন ঢাকায় ইউনিসেফের প্রশাসন বিভাগের প্রধান। তাঁদের একমাত্র ছেলে এ লেভেলে পড়ে। কুড়ি রোজাতেই সাধারণত তিনি সপরিবারে বাড়িতে চলে যান। প্রধান কারণ মায়ের সঙ্গে ইফতার করা। আক্ষেপের সঙ্গে বলছিলেন, ‘মার সঙ্গে এবার একটি দিনও ইফতার করতে পারলাম না—এর থেকে বড় দুঃখ আর নেই। আমার জীবনে এ রকম কখনো হয়নি। রোজ টেলিফোন করি। ঈদে বাড়ি যাব না। মা কাঁদে, আমিও কাঁদি। কিছুই তো করার নেই।’

নিজের গাড়িতে করেই ঈদের সময় বাড়ি যান জাকিরুল হক। এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘ঈদে আগে বাসে যেতাম। গাড়ি কেনার পর বাসে যাই না। অনেক সময় লাগে। লম্বা যানজট থাকে পথে। সাধারণত সাহ্​রি খেয়ে উত্তরার বাসা থেকে তিনি রওনা দেন। তারপরও বগুড়ায় পৌঁছাতে অন্তত সন্ধ্যা হয়। কোনো কোনো বছর তো রাত নটা অবধি লেগে যায়। তবে এতেও আনন্দ আছে। পিকনিকের আমেজে যাওয়া যায়। গাড়িজটে আটকে পড়লে নেমে একটু হাঁটাহাঁটি করা, দুয়েকটি ছবি তোলা। বিরক্ত হয়ে নেমে পড়া বাসযাত্রীদের সঙ্গে টুকটাক কথা বলা, মাঝপথে ইফতারি, সব মিলিয়ে ঈদের এটাও একটা অন্য রকম আনন্দ। তারপর বাড়িতে গেলে তো কথাই নেই।’

আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ, ছেলেমেয়েরা তাদের অন্য ভাইবোনদের সঙ্গে মেতে ওঠে কে কী কিনেছে, ঈদের সাজগোজ কেমন হবে, কাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া হবে—এসব বহুবিধ জরুরি আলোচনায়। জাকিরুল বলছিলেন, তাঁর মেয়ে ফোনে ওর চাচাতো–জ্যাঠাতো ভাইবোনদের বলছে, ঈদের দিনে সাজগোজ করে বাড়িতেই থাকবে। জুমে সবার সঙ্গে দেখা করবে। দেখবে কার সাজ কেমন হলো। স্কুল বন্ধ, তবে জুমে ক্লাস চলছে, এসব প্রযুক্তি এখন ওদের কাছে পান্তাভাত হয়ে গেছে।

ঈদের উৎসব নিয়ে সব পরিবারেই এমন অনেক ছোট ছোট গল্প থাকে। পরিকল্পনা থাকে। আমাদের এখানে ঈদ তো কেবল আনন্দের উৎসই নয়—এটি মানুষে মানুষে কাছে আসার অনেক বড় এক উপলক্ষ। এতে ঈদ আরও মহিমান্বিত হয়ে ওঠে আমাদের জীবনে। কোভিড–১৯ এবার ২০২০ সালের ঈদে পারস্পরিক সংযোগের সেই রঙধনুর মতো রঙিন সুতাটি কেটে দিল। তবে দূরে থেকেও ঈদের দিন সেই সুতার বন্ধন যেন অটুট থাকে, ফোন–ভিডিও কলে ঈদের আনন্দ যেন পাওয়া যায়, সে চেষ্টার কমতি হয়তো কারোরই থাকবে না।