তবুও ভালো থাকতে হবে

করোনাকালে দুঃসংবাদ যেন এখন প্রতিদিনের সঙ্গী, আর তা চেনাজানা গণ্ডিতে। তারপরও জীবন তো আর থেমে থাকবে না। মডেল: মাইশা, ছবি: সুমন ইউসুফ
করোনাকালে দুঃসংবাদ যেন এখন প্রতিদিনের সঙ্গী, আর তা চেনাজানা গণ্ডিতে। তারপরও জীবন তো আর থেমে থাকবে না। মডেল: মাইশা, ছবি: সুমন ইউসুফ

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরু থেকেই উদ্বেগ, ভীতি প্রায় সবার মধ্যেই। এরপর যখন একটু একটু করে সংবাদমাধ্যমে আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা দেখা শুরু হলো, তখন ভীতি রূপ নিল আতঙ্কে। আর প্রায় দুই মাসের বেশি সময় ঘরে থাকার পর সব যখন একটু একটু করে খুলে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে সংক্রমিত আর মৃতের সংখ্যা, তখন মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে অনেকের।

আগে কেবল সংক্রমিত আর মৃতেরা সীমাবদ্ধ ছিলেন ঘোষিত সংখ্যায়; এখন তা প্রবেশ করেছে পরিচিত বলয়ে। প্রায় সবাই–ই প্রতিদিন একাধিক আত্মীয়, স্বজন, বন্ধু, সহকর্মী বা প্রতিবেশীর নাম শুনছেন, যাঁরা করোনা সংক্রমিত হয়েছেন। আর ইদানীং পরিচিত বলয়ে, স্বজন বা বন্ধুদের মধ্যে এই রোগে সংক্রমিত হয়ে বা এই রোগের লক্ষণ নিয়ে মৃত্যুবরণ করছেন এমনটাও কিন্তু প্রতিদিন শুনতে হচ্ছে।

এই পরিচিতজনের সংক্রমিত হওয়া আর বিশেষ করে মৃত্যুর সংবাদ বাড়িয়ে দিচ্ছে আতঙ্ক, অবসাদে ভরে যাচ্ছে যাপিত দিনগুলো। শোক, আপনজন হারানোর বেদনাকে ছাপিয়ে কখনো কখনো বড় হয়ে উঠছে নিজের নিরাপত্তাবোধ, ‘আমি বাঁচব তো?’, ‘আমি চিকিৎসা পাব তো।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, পত্রিকা, অনলাইন আর টিভিতে নানা ধরনের সংবাদ। বেশির ভাগই হতাশামূলক। আশাজাগানিয়া সংবাদ খুব কম। ফলে নিজের মনের মধ্যে গুটিয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ। বিষণ্নতা আর সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার বোধে আক্রান্ত হচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হতে হলে মনোবল ধরে রাখা, ঠান্ডা মাথায় নিজেকে নিরাপদ রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা জরুরি।

আতঙ্কিত অবস্থায় শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়, চিন্তাশক্তি ঠিকমতো কাজ করে না। ফলে স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে মানা হয় না। তাই আতঙ্ক আর উদ্বেগ আমাদের আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেবে। করোনা থেকে মুক্ত থাকার চিন্তা আর ভীতি আমাদের সচেতন, সতর্ক করবে। কিন্তু চিন্তার বদলে দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ আর ভীতির বদলে আতঙ্ক আমাদের সংক্রমণের ঝুঁকিকে বাড়ায়। তাই আতঙ্কিত বা উদ্বিগ্ন না হয়ে সতর্ক আর সচেতন থাকতে মনোবল বাড়াব। চারদিকের এত এত দুঃসংবাদ ধারণ করে নিজেকে নিরাপদ রাখতে, মনোবল অটুট রাখতে কিছু নিয়মকানুন মেনে চলা উচিত।

মনকে বারবার বলতে হবে, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে। তবু শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।’

দুঃসংবাদ চারদিকে: কীভাবে ভালো থাকবেন

*সঠিক সংবাদ গ্রহণ করুন: মৃত্যুসংবাদসহ যেকোনো দুঃসংবাদ যখনই শুনবেন—এড়িয়ে যাবেন না। সেটি শুনুন। প্রয়োজনে বিস্তারিত সত্য ঘটনাপ্রবাহ শুনুন। ‘অমুকে বলে’, ‘আমি শুনলাম’ ‘কেউ কেউ বলে’, এমন সংবাদ বর্জন করুন। যা সত্য তা মেনে নেওয়াই যে সত্যিকারের শিক্ষা, সেটা নিজেকে বারবার বলুন।

*যাঁদের হারিয়েছেন, তাঁদের অবদানকে স্মরণ করুন: পরিচিত বা স্বজন যাঁদের হারিয়েছেন, আপনার জীবনে বা সমাজে তাঁদের অবদান মনে করুন। তাঁদের সঙ্গে আপনার কাটানো ভালো মুহূর্তগুলো মনে করুন। শোক খানিকটা কমবে।

*সক্ষমতা আর দুর্বলতা চিহ্নিত করুন: করোনাকালে আপনি মৃতের পাশে যেতে পারছেন না, সশরীর উপস্থিত হয়ে তাঁর স্বজনের পাশে দাঁড়াতে পারছেন না—এটাকে দুর্বলতা মনে করবেন না। বরং এটাই আপনার সবলতা—নিজেকে আর আপনার পরিবারকে নিরাপদ রাখার সক্ষমতা। আমরা অনেক সময় এটিকে নিজেদের দুর্বলতা ভেবে আত্মগ্লানিতে ভুগি, যা মনের চাপ বাড়িয়ে দেয়। এ সময় আপনি টেলিফোনে মৃতের স্বজনের সঙ্গে কথা বলুন, তাদের প্রতি সমমর্মী হোন। ধর্মীয় রীতি মেনে দোয়া, প্রার্থনা করুন।

*মানসিক চাপ বাড়ায় এমন সংবাদমাধ্যমের সীমিত ব্যবহার: যেসব সংবাদমাধ্যম তা মূলধারার হোক আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই হোক, আপনার মনের চাপ বাড়ায় সেগুলোর ব্যবহার সীমিত করুন। দিনে দুবারের বেশি সংবাদ দেখবেন না।

*ইতিবাচক সংবাদের গুরুত্ব দিন: মৃত আর সংক্রমিতদের চেয়েও বহুগুণ বেশি মানুষ সুস্থ হচ্ছেন। এদের মধ্যেও আপনার পরিচিত স্বজন বন্ধু আছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলুন। তাঁদের সেরে ওঠার গল্পগুলো শুনুন। এতে আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়বে।

*নিজের শরীরের যত্ন নিন: স্বাস্থ্যবিধি মানুন। রুটিন মেনে ঘুমান। দিনে হালকা ব্যায়াম করুন। অফিসে বা কাজের জায়গায় নিরাপদ দূরত্ব মেনে কাজ করুন। অনেক পিছিয়ে পড়েছেন ভেবে বাড়তি কাজ নেবেন না। সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন, যথেষ্ট পানি পান করুন। ধূমপান বা অন্য কোনো নেশা বর্জন করুন।

*কাজ ধরে রাখুন: আপনি ঘরে বা বাইরে যেখানেই কাজ করেন না কেন, যথাসম্ভব নিজের কাজের ক্ষেত্রটিকে ঠিক রাখুন। আতঙ্কিত হয়ে কাজ বন্ধ রেখে নিজেকে গুটিয়ে রাখবেন না। এতে কিন্তু আপনার মনের ওপর চাপ আরও বাড়বে।

*মনের যত্ন নিন: আপনার আবেগকে যথাযথভাবে প্রকাশ করুন। মানসিক চাপের লক্ষণ (বুক ধড়ফড়, মাথা বা ঘাড়ব্যথা, ঘুম না হওয়া, ঘন ঘন শ্বাস, অস্থিরতা, মাংসপেশি শক্ত হওয়া) দেখা দিলে নিজেকে শান্ত রাখতে বড় বড় শ্বাস নিন, ইয়োগা, মেডিটেশন, রিলাক্সেশন, মাইন্ডফুলনেসের চর্চা করতে পারেন। অনলাইনে এগুলোর অনেক উপকরণ দেওয়া আছে।

*সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পরিমিত ব্যবহার করুন: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখবেন আপনার পরিচিত নন, কিন্তু আপনার পরিচিতের, পরিচিতের, পরিচিত একজন মৃত্যুবরণ করেছেন। এই সংবাদ আপনার মনের তালিকায় উঠে যাবে এবং আপনার আতঙ্ক বাড়াবে। এ জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পরিমিত ব্যবহার করুন। পারলে বন্ধুসংখ্যাও সীমিত করে আনুন।

*সহায়তার ক্ষেত্রগুলো প্রস্তুত রাখুন: অসুস্থ হলে কোথায় যাবেন কী করবেন, স্বাস্থ্যসেবা কোথায় কীভাবে নেবেন, আপনি অসুস্থ হয়ে আলাদা থাকলে পরিবারের বিকল্প দেখভাল কীরূপ হবে, আর্থিক ব্যবস্থাপনা কেমন হবে, তা আগেই ঠিক করে রাখুন। এতে প্রতিকূল পরিবেশে আপনার হতবিহ্বলতা তৈরি হবে না।

*শোক প্রকাশ করুন: শোক একটি স্বাভাবিক আবেগীয় প্রতিক্রিয়া, নিজের শোক প্রকাশের সুযোগ দিন আর শোককে কাটিয়ে ওঠার জন্য সময় দিন। শোককে উপক্ষো করবেন না। কারও শোকের প্রকাশকে কখনোই বাধাগ্রস্ত করা চলবে না, তেমনি শোকের প্রতিক্রিয়া যাতে দীর্ঘ না হয়, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে।

*মনের ওপর জোর নয়: যদি মনে করেন, আপনি স্বাভাবিক কাজ করার মতো মনটিকে তৈরি করতে পারেননি, আতঙ্ক থেকে বের হতে পারেননি, শোককে কাটিয়ে উঠতে পারেননি, তবে সময় নিন। জোর করে নিজেকে স্বাভাবিক দেখাবেন না।

*কাঁদুন যদি মন চায়: যদি মন চায় আপনি কাঁদুন। কান্না আমাদের আবেগকে প্রকাশিত করে, শোককে প্রশমিত করে। আপনি পুরুষ হন বা নারী, তাতে কিছুই যায়–আসে না। মনে রাখবেন, শোকের স্বাভাবিক প্রকাশ কান্না। তবে যদি কান্না না আসে, জোর করে কান্নার চেষ্টা করবেন না।

*নিজের পরিবারকে সময় দিন: আতঙ্কিত, অস্থির অবস্থায় একা থাকবেন না। নিজের পরিবার ও কাছের মানুষের সান্নিধ্যে থাকুন।

*মেনে নিন: আপনি যা পরিবর্তন করতে পারবেন না, তা মেনে নিন। নতুন শক্তি সঞ্চয় করে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিজেকে তৈরি করুন।

আহমেদ হেলাল : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা