'স্বাভাবিক জীবন, প্লিজ ফিরে এসো'

স্বাভাবিক জীবনের প্রত্যাশা নিয়ে আশফিকার লেখা কবিতা। ছবি: প্রথম আলো
স্বাভাবিক জীবনের প্রত্যাশা নিয়ে আশফিকার লেখা কবিতা। ছবি: প্রথম আলো

স্বাভাবিক জীবন, প্লিজ ফিরে এসো,

কোভিড-১৯ তোমাকে নিয়ে যাচ্ছে,
সরকার, প্লিজ কোভিড-১৯ ঠিক করে দাও এবং একে শেষ করে দাও।
স্বাভাবিক জীবন মনে মনে ভাবে আমাদের যে সুন্দর সময়টা ছিল
বাইরে যেতাম
স্কুলে যেতাম
এ সবকিছুর জন্য বিশেষ ধন্যবাদ তোমাকে।

স্বাভাবিক জীবন, তুমি কি জানো কোভিড-১৯ সব বন্ধ করে দিয়েছে
বন্ধ করে দিয়েছে মানুষের কথা শোনা, চিকন থাকার বদলে মোটা করে দিচ্ছে আমাদের।
স্বাভাবিক জীবন, আমরা তোমার জন্য দিন গুনছি।

এনএইচএস প্লিজ মানুষকে ঠিক করে দাও।
সরকার, প্লিজ বলো কীভাবে করোনাভাইরাস মেরে ফেলা যায়
অথবা এটা বলো কোভিড-১৯–এর জীবনে কীভাবে একটু ভালো থাকা যায়
বরিস জনসন, প্লিজ স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসতে সাহায্য করুন। (ইংরেজি থেকে অনুবাদ)

ছোট্ট আশফিকার এই কবিতা যেন প্রতিটি মানুষের মনের কথা। লন্ডনের বাসিন্দা আট বছরের আশফিকা বাসায় থাকতে থাকতে ক্লান্ত। বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে যেতে পারছে না। প্রিয় স্কুলে যায়নি বহুদিন। কোভিড-১৯ নামের অদৃশ্য ভাইরাস কী, তা বুঝতে না পারলেও এর আতঙ্ক তাঁকে পুরোপুরি স্পর্শ করেছে। তাই তো কদিন আগে স্কটল্যান্ডে থাকা খালামণির কাছে কোভিড-১৯ নিয়ে এই কবিতা লিখে পাঠায় সে। সাধারণ জীবন ফিরে পাওয়ার আকুতি ফুটে ওঠে তার কবিতায়। বাসায় থেকে থেকে মোটা হয়ে যাচ্ছে সে। এটাও যেন ছোট্ট আশফিকাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে।

বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের শিশুরা যেন এভাবেই ভাবছে। মাস ছয়েক আগে বাবার কাজের সূত্রে কানাডা থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা এসেছে সেইফি ও সামোনা। আফ্রিকার এই দেশটি যেন তাদের মন ছুঁয়ে যায়। প্রতিদিন বাইরে হাঁটতে যেত তারা। পাহাড়ের পাশ ধরে গিয়ে খোলা জায়গায় প্রাণভরে নিশ্বাস নিত এই দুই শিশু। তবে হঠাৎ করেই সব এলোমেলো। ওদের বাবার করোনা ধরা পড়ল মার্চের ১০ তারিখ। ঘরে আটকে গেল জীবন। একসময় কড়া লকডাউন জারি হলো দক্ষিণ আফ্রিকায়। ঘরেই দিন কাটছে ওদের।

লন্ডনের বাসিন্দা আট বছরের আশফিকা বাসায় থাকতে থাকতে ক্লান্ত। ঈদের সময় ছোট ভাইয়ের সঙ্গে। ছবি: সংগৃহীত
লন্ডনের বাসিন্দা আট বছরের আশফিকা বাসায় থাকতে থাকতে ক্লান্ত। ঈদের সময় ছোট ভাইয়ের সঙ্গে। ছবি: সংগৃহীত

আসলে এই বয়সের বাচ্চাগুলো বেশ কষ্টের সময় পার করছে। স্কুলে একটা জগৎ তৈরি হয় তাদের। স্কুলে গিয়ে খেলা, একসঙ্গে সহপাঠীদের সঙ্গে পড়া—সবকিছুই তার ভাবনাকে বিস্তৃত করে; যা বাসায় থেকে ফোনে কথা বলে ঠিক হয়ে ওঠে না। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তারা। পড়াশোনা করতে হবে এই বোধও হয় না এ রকম বছরের শিশুর মনে। অনলাইনে স্কুল হয়, পড়া দেয়, কিন্তু হোমওয়ার্ক তো কেউ দেখছে না। তাঁকে বোঝানো যায় না, এভাবেই করতে হবে। তিন মাস ধরে বাসায় বসে আছে ওয়াহি। ঢাকার খিলগাঁওয়ে বাবা–মা আর দাদার সঙ্গে থাকে সে। করোনার ভয়ে দরজার কাছেও যেতে দেন না মা–বাবা। পাশেই ফুপুর বাসা—সেখানেও নিয়ে যায় না কেউ।

মিরপুরে থাকা নানা–নানুর সঙ্গে ফোনে অ্যাপের সাহায্যে কথা বলে সে। এতে যেন তার তৃষ্ণা মেটে না। সব সময় যেন অস্থিরতা কাজ করে সাত বছরের এই শিশুটির মনে। কদিন আগে সে তার মাকে বলে, মনে হচ্ছে আমি যেন কোনো পাহাড়ের নিচে আটকা পড়েছি। মাথার ওপর এক পাহাড় বোঝা। বাসায় বসে সারা দিন টিভি দেখেই সময় কাটায় সে। একই অবস্থা সুমাইয়ার। ছয় বছরের লক্ষ্মী মেয়েটা হঠাৎ করেই যেন বড্ড জেদি হয়ে গেছে। হঠাৎ হঠাৎ কেঁদে ওঠে। মেয়ের জন্য খুব কষ্ট হয় ওর মা–বাবার। রাগও হন মেয়ের ওপর। বুঝতে পারেন ওর কষ্টটা। তবে কী করবেন বুঝে উঠতে পারেন না।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মে মাসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৯৯ শতাংশ শিশুকে কোভিড-১৯ কারণে বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে। ৬০ শতাংশ হয় পুরো, নয় আংশিক লকডাউনে রয়েছে। বিশ্বব্যাপী দেড় শ কোটি শিশু স্কুলে যাচ্ছে না। করোনাভাইরাস মহামারি এবং এর বিস্তার ঠেকাতে নেওয়া অভূতপূর্ব ব্যবস্থাগুলো শিশুদের জীবনের প্রায় প্রতিটি দিককে ব্যাহত করছে—তাদের স্বাস্থ্য, বিকাশ, শেখা, আচরণ, তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক সুরক্ষা এবং সহিংসতা ও নির্যাতন থেকে তাদের সুরক্ষা। আর সেই সঙ্গে ব্যাহত করছে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে, অল্প বয়সী বাচ্চারা বড় ঝুঁকিতে রয়েছে—এই পর্যায়ের মানসিক চাপ এবং বিচ্ছিন্নতা তাদের মস্তিষ্কের বিকাশের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। কখনো কখনো অপূরণীয় দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির দিকেও নিয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া অনেক শিশুই এই সময়ে প্রিয় স্বজনদের থেকে বিচ্ছেদে আছে। অনেককে অসুস্থ স্বজনদের যত্ন নেওয়া, এমনকি প্রিয়জনের মৃত্যুর মতো বিষয়েও লড়াই করতে হচ্ছে।

মহামারির শুরুতে শিশুদের ওপর এক জরিপ চালায় ইউনিসেফ। ১০৪টি দেশের ১ হাজার ৭০০ শিশু, মা–বাবা ও শিক্ষকের ওপর ওই জরিপ চালানো হয়। ওই শিশুরা জানায়, তারা পরিবার ও বন্ধুবান্ধব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এবং ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া, এমনকি মারা যাওয়ার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। পিতামাতারা জানান, তাঁরা কীভাবে তাঁদের বাচ্চাদের ভয়কে মোকাবিলা করতে শেখাবেন। কীভাবে সামাজিক দূরত্বের মতো ব্যবস্থা ব্যাখ্যা করবেন, তা নিয়ে বিভ্রান্ত।

এপ্রিলে সেভ দ্য চিলড্রেনের করা এক জরিপে দেখা গেছে, করোনার এই সময়ে ৬৭ শতাংশ মা–বাবা সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত। ৭৪ শতাংশ শিশু স্কুল কার্যক্রম মিস করছে। আর ৭০ শতাংশ শিশু কষ্ট পেয়েছে, কারণ আকস্মিকভাবে স্কুল বন্ধ হওয়ায় বন্ধুদের বিদায় পর্যন্ত জানাতে পারেনি তারা। ৪৯ শতাংশ শিশুই করোনাভাইরাসের কোনো কোনো বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন। ৬ থেকে -১৮ বছর বয়সী শিশুদের ওপর এই জরিপ চালানো হয়।

আইসিডিডিআরবির মা ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের জ্যেষ্ঠ মনোবিদ শামীমা সিরাজী সম্প্রতি প্রথম আলোতে এ বিষয়ে কিছু পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, শিশুদের নিয়ে এই সময়টা কত ভালোভাবে পাড়ি দেওয়া যায়, সেই চেষ্টাই মা–বাবাকে করতে হবে। করোনাভাইরাসের এই দুর্যোগে আমরা যদি শুধু নেতিবাচক চিন্তা করি, তাহলে চরম হতাশায় ডুবে যাব। আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়বে। দেখা দেবে নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যা। পরিবারের বড়রা ভেঙে পড়লে শিশুদের কী হবে? বরং শিশুদের নিয়ে এই সময়টা কত ভালোভাবে পাড়ি দেওয়া যায়, সেই চেষ্টাই মা–বাবাকে করতে হবে। তিনি পরামর্শ দেন অবসরে শিশুর সঙ্গে কথা বলুন, ছড়া কিংবা খেলা শেখান, গল্প বলুন, প্রাণ খুলে হাসুন। তাকে গান গাইতে বা মনের আনন্দে নাচতে দিন। এতে বাচ্চার ভাষাগত বিকাশ দ্রুত হবে। সে আত্মবিশ্বাসী হয়ে বেড়ে উঠবে। রঙিন পেনসিল ও খাতা দিয়ে যা ইচ্ছে আঁকতে দিন। কাগজ দিয়ে নৌকা কিংবা ফুল-পাখি বানানো শেখাতে পারেন। পরিত্যক্ত জিনিস দিয়ে রঙিন নরম বল, পুতুল বা অন্য কিছু বানাতে উৎসাহ দিন।

আসলেই সব মা–বাবাকে এই সময়ে সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাড়তি সচেতন থাকতে হবে। ছোট এই শিশুরা মনের কথা সুন্দর করে বলতে পারে না। পাহাড়ের মতো বোঝা আটকে থাকে মাথায়, নামাতে পারে না। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মতো ওরাও অপেক্ষা করে স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসার।