এই বরষায়

>করোনাকালেও এসেছে আষাঢ়, বাংলার বরষা। তাই মেঘের পরে মেঘ জমবেই। আঁধার হবে আলো। টাপুরটুপুর বৃষ্টিতে ঝাপসা হবে গাছপালা। বেলি ফুটবেই। গন্ধ ছড়াবেই...। এবার বাঙালির পালা সচেতনতার সঙ্গে জীবনযাপনে বর্ষা উদ্‌যাপনের ধারা বদলে নেওয়ার। লিখেছেন সুমনা শারমীন
এবার নাহয় নীল পোশাকে, চুলে বেলি গুঁজে বারান্দার গ্রিল ছুঁয়ে আসা বৃষ্টির ছাটেই হোক বর্ষাযাপন। মডেল: তৃণ, ছবি: কবির হোসেন
এবার নাহয় নীল পোশাকে, চুলে বেলি গুঁজে বারান্দার গ্রিল ছুঁয়ে আসা বৃষ্টির ছাটেই হোক বর্ষাযাপন। মডেল: তৃণ, ছবি: কবির হোসেন

‘নেবুর পাতায় করমচা

যা বৃষ্টি ধরে যা’

ঝুম বৃষ্টিতে পথের পাঁচালীর সেই অপু–দুর্গার সিক্ত নাচন দেখে বৃষ্টিতে ভিজতে যাওয়ার রোমান্টিকতার দিন আজ নেই। অনেকটা ‘ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য’ অবস্থা। আজ বৃষ্টির ফোঁটা মাথায় পড়লেই আতঙ্ক। জ্বর–গলাব্যথা হবে না তো? গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো ডেঙ্গু–আতঙ্ক তো রয়েছেই। তবুও আবার এসেছে আষাঢ়, ফুটেছে বাদলদিনের প্রথম কদম ফুল। করোনা তো প্রকৃতিকে লকডাউন করতে পারেনি। তাই মেঘের পরে মেঘ জমবেই। আঁধার হবে আলো। টাপুরটুপুর বৃষ্টিতে ঝাপসা হবে গাছপালা। বেলি ফুটবেই। গন্ধ ছড়াবেই...। এবার বাঙালির পালা জীবনযাপনে বর্ষা উদ্‌যাপনের ধারা বদলে নেওয়ার।

জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়া নয়। নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষার সচেতনতা সবার আগে। কিন্তু বেশরি ভাগ শিক্ষিত বাঙালির একটি করে গোপন কবিতার খাতা থাকে। আর তাতে অবধারিত স্থান পায় বর্ষার রূপ। হোক না ছন্দে অমিল, কাঁচা হাতের ছাপ। অনুভূতিটা বড্ড খাঁটি। সেই বাঙালি এবার হয়তো বর্ষাকে ঘরে বসেই নিজের মতো করে আমন্ত্রণ জানাবে।

ষড়ঋতু নিয়ে চিত্রশিল্পীরা ছবি আঁকলেই বর্ষার প্রকাশে আনমনে প্যালেট (রং রাখার উপকরণবিশেষ) থেকে নীল রং তুলির ডগায় ভরিয়ে নেন। তারই ধারাবাহিকতায় পোশাক ডিজাইনাররা বর্ষার পোশাকে নীলের ছোঁয়া বুলিয়ে দেন। প্রথম আলোর এই নকশা ক্রোড়পত্রেই বছরের পর বছর নীল রঙের পোশাকে ডিজাইনাররা তাঁদের বর্ষাভান্ডার মেলে ধরেছেন। হয়তো এ বছরের জন্যও ছিল আগাম প্রস্তুতি। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবে বৈশাখ আর ঈদবাজারের কঠিন ধস স্বাভাবিকভাবেই বুঝিয়ে দেয় বাস্তব কতটা প্রতিকূল। তাই এবার না–হয় নিজেই নিজের ডিজাইনার হয়ে যান। রং তো জানাই। উপকরণ বাছাইয়েও চাই মৌসুম–চিন্তা—যা আছে তা দিয়েই। না–হয় শখ করে মনের ওপর জোর খাটিয়েই পরলেন একদিন। চুলে গুঁজলেন টবে ফোটা বর্ষার ফুল একটি কিংবা দুটি? কিছুক্ষণের জন্য মনটা আনমনাও হতে পারে। মনে পড়তে পারে সেই কিশোরীর কথা, অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে গত বর্ষায় গাড়ির কাচ নামিয়ে বিজয় সরণির মোড়ে রোজ যার কাছ থেকে বেলি ফুলের মালা কিনতেন। আহারে, এই করোনাকালে কেমন আছে মেয়েটা? কী খাচ্ছে? সুস্থ আছে? ঢাকায়? যদি আরেকবার দেখা হয়, ওর জন্য কিছু একটা করব। এই তো বৃষ্টিস্নাত মন!

বাইরে যেতে মানা, তাই ঝালমুড়ির সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আড্ডাটা জমেছে বেশ
বাইরে যেতে মানা, তাই ঝালমুড়ির সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আড্ডাটা জমেছে বেশ

মন ভালো রাখতে হবে। সচেতন থাকতে হবে। সব সময় করোনা–আতঙ্কে থাকা যাবে না। মনোরোগের চিকিৎসকেরা সেই পরামর্শই দিচ্ছেন। মানবিক মনটাকেও রাখতে হবে জাগ্রত। কারণ, এ লড়াই একা জেতার লড়াই নয়। তাই বাড়ির ছাদবাগানে বসে বৃষ্টিভেজা সতেজ গাছগাছালির সঙ্গে সময় কাটালে, তাদের যত্ন নিলে শরীর–মন দুটিই থাকবে ভালো।

 বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি রান্না হবেই। বাঙালি পরিবারে এ আবার নতুন কি? এখন করোনাকালে এমনিতেই বাজারে কম যাওয়া মঙ্গল আর বৃষ্টি এলে চালেডালে খিচুড়ির জবাব নেই। সঙ্গে ডিম ভুনা বা ভাজা হলেই হলো। তবে বর্ষার দিনে চা–মুড়ি আর আড্ডা জমে ভালো। ঘরে আটকে পড়া এই করোনাকালের বর্ষায় এর চেয়ে মন ভালো রাখার কীই–বা উপায়? চা তৈরির সময় একটু আদা–লবঙ্গ ফেলে দিন কেটলিতে। এক কাজে দুকাজ হবে। চিকিৎসকেরা বলছেন বারবার আদা–লবঙ্গ চা পান করতে।

এ দেশের কারুশিল্প এ দেশের ঐতিহ্য। কারুশিল্প গবেষকেরা বলেন, বর্ষায় যখন টানা বৃষ্টি হতো, একঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়া যেত না; পানি যেত জমে, তখন বাড়ির মেয়েরা নকশিকাঁথা সেলাই করতেন। সুই–সুতোয় ফুটিয়ে তুলতেন চমৎকার নকশা। অর্থাৎ বর্ষায় আটকে পড়ে নিজের সৃজনশীলতায় সময়টা কাটাতেন। একবার নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন তো এমন কোনো সৃজনশীলতায় কেটে যেতে পারে এবারের করোনাকালের বর্ষা?

আমি একজন কর্মজীবী নারীকে চিনি। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত অবসর ছিল না তাঁর। পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ছুটছেন তো ছুটছেন। বাড়িতে দুদণ্ড বসার সময় হতো না তাঁর। একবার টানা ভারীবর্ষণ আটকে দিল তাঁকে তিন দিন। খানকয়েক মোটা বই হাতে দোতলার জানালার পাশে বসলেন। নাওয়া–খাওয়া গেলেন ভুলে। যেন ক্লান্ত মনের মানসিক স্পা হচ্ছে তাঁর। আবহসংগীতে লাইভ বৃষ্টি। এমনই মশগুল হলেন যে বৃষ্টির পানি জমে তার বাড়িতেই নিচতলায় ঢুকে একাকার, কিন্তু তাঁর বিকার নেই। অতঃপর বাড়ির সবার হইচইয়ে সংবিৎ ফিরল তাঁর। নাহয় এমনই কোনো নেশায় পেয়ে বসুক আপনাকে। বই, চলচ্চিত্র, গান...।

বর্ষাদুপুরে, অবসর কাটুক বই পড়ে
বর্ষাদুপুরে, অবসর কাটুক বই পড়ে

গান? তা সে দেবব্রত িবশ্বাসের উদার কণ্ঠের ‘বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা, আষাঢ় তোমার মালা’, কিংবা বি জে থমাসের সেই সাড়া জাগানো ‘রেইন ড্রপস কিপ ফলিং অন মাই হেড’, অথবা তরুণ মন জয় করা ডিফারেন্ট টাচের ‘শ্রাবণের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে’—যার যা ইচ্ছে, পছন্দ, তাই শুনি। গানের আবার সীমানা কী? বয়সই–বা কী? ঘরে বসে বর্ষা উদ্‌যাপনে গানের চেয়ে ভালো আর কীই–বা হতে পারে?

বিশ্ববিদ্যালয়–জীবনে তরুণ শিক্ষক একদিন বললেন, কাল তোমাদের ক্লাস হবে সিনেমা হলে। অতটায় অমুক সিনেমা হলের সামনে উপস্থিত থাকবে। আমরা গোটা ক্লাসের ছাত্রছাত্রী উপস্থিত হলাম। স্যার আমাদের বেন–হার (১৯৫৯) সিনেমা দেখালেন। পরের ক্লাসে ছিল সিনেমা নিয়ে আলোচনা। আজ ছবির শেষের দিকের সেই বৃষ্টির দৃশ্যের কথা মনে হচ্ছে। কুষ্ঠ রোগ ধুয়ে যাচ্ছে বর্ষণে। এই বর্ষা কি করোনা ধুয়ে দিয়ে যেতে পারে না?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বর্ষা পর্যায়ে অসংখ্য গান লিখেছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে জীবনযাপনের বাস্তবতায় এই চরণ কটি মনে বাজছে, ‘বরিষ ধরা–মাঝে শান্তির বারি,/ শুষ্ক হৃদয় লয়ে আছে দাঁড়াইয়ে/ ঊর্ধ্বমুখে নরনারী।/ না থাকে অন্ধকার, না থাকে মোহপাপ,/ না থাকে শোকপরিতাপ।’