প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে

প্রায় দেড় বছর ধরে একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষের ছাত্রীর সঙ্গে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্রের সম্পর্ক। একপর্যায়ে এ প্রেম গড়ায় শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত। ছেলেটি কোনো কোনো সময় তাঁদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো গোপনে ক্যামেরায় ভিডিও করে রাখতেন মেয়েটির অজান্তে। মেয়েটির পড়াশোনা যখন শেষ পর্যায়ে, তাঁদের সম্পর্কের অবনতি হয়। মেয়েটির বিয়ে ঠিক হয় অন্য কোথাও। কিন্তু ছেলেটি তা মানতে পারেননি। ছেলেটি গোপন ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেবেন বলে হুমকি দিতে থাকেন। এরই মধ্যে ছেলেটি একটি দৃশ্য মেয়েটির এক আত্মীয়ের কাছে পাঠিয়েও দেন।

২.

দুই সন্তানের জননী চল্লিশের কাছাকাছি বয়সের এক নারীর স্বামী বিদেশে থাকেন প্রায় ১০ বছর ধরে। প্রায়ই ইমোতে কথা হতো দুজনের। মাঝেমধ্যে স্বামীর অনুরোধে নিজের কিছু ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও শেয়ার করতেন তিনি। এরই মধ্যে জানতে পারলেন, তাঁর স্বামী না জানিয়েই বিদেশি এক মেয়েকে বিয়ে করেছেন। তিনি স্বামীকে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু চতুর স্বামী তা মানতে নারাজ। তিনি স্ত্রীর পাঠানো ছবি, ভিডিও একটি ওয়েবসাইটে এবং ফেসবুকে ছেড়ে দিয়েছেন।

৩.

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দুই সহকর্মীর মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে কয়েক মাস ধরে। তাঁরা স্বেচ্ছায় নিজেদের অনেক অন্তরঙ্গ মুহূর্তের দৃশ্যের ছবি তুলেছেন এবং ভিডিও করেছেন। একপর্যায়ে মেয়েটি তাঁদের আরও অনেক সহকর্মীর সঙ্গে ছেলেটির প্রেমের সম্পর্ক আছে জানতে পারেন। একটি মেয়ের পোশাক পরিবর্তনের দৃশ্য গোপনে ক্যামেরাবন্দী করার অভিযোগে ছেলেটির চাকরিও চলে যায়। মেয়েটি ছেলেটির কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চাইলে ছেলেটি তাঁদের গোপন ভিডিওর অজুহাতে মেয়েটিকে বারবার শারীরিক সম্পর্ক করতে বাধ্য করতেন। ছেলেটির কথামতো কাছে না এলে এ ছবি–ভিডিও সবাইকে দেখাবেন বলে হুমকি দিতে থাকেন।

প্রেমের সম্পর্কের ফাঁদে ফেলে অজান্তে বা জেনেশুনে নিজেদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও দিয়ে ব্ল্যাকমেলিং, প্রতারণা বা নানাভাবে ক্ষতি করার ঘটনা কিন্তু কম নয় আমাদের সমাজে। এ নিয়ে প্রচুর মামলা–মোকদ্দমাও হচ্ছে। সাইবার ট্রাইব্যুনালে দায়ের হওয়া অধিকাংশ মামলাই এ ধরনের অভিযোগে দায়ের করা এবং এর বেশির ভাগ ভুক্তভোগী নারী। অধিকাংশ মেয়ের সচেতনতার অভাব কিংবা সরল বিশ্বাসের কারণে সহজেই ফাঁদে ফেলেন তাঁর কথিত প্রেমিক বা কাছের মানুষটি। আর এর ফলে নেমে আসে দুর্বিষহ যন্ত্রণা। কেউ কেউ এ যন্ত্রণা এড়িয়ে সাহস করে সামনে এগোতে পারলেও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বেশির ভাগই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। পরিবার এবং সমাজে হতে থাকেন হেয়। কিন্তু একটু সচেতন হলে এবং একটু সাহসী হয়ে আইনের আশ্রয় নিলে এ ধরনের নির্যাতন থেকে মুক্তি মেলে সহজেই।

আইনের আশ্রয় যেভাবে

যদি কেউ এমন ধরনের পরিস্থিতির শিকার হন, তাহলে প্রথমে তাঁকে আলামত সংগ্রহ করতে হবে। ফেসবুকের মতো যেকোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অনলাইনে যেখানেই হোক না কেন, প্রথমে স্ক্রিনশট এবং ওয়েব ঠিকানা (লিঙ্ক) নিয়ে রাখতে হবে। দ্রুত কাছের থানায় এটি সাধারণ ডায়েরি করতে হবে। যদি কেউ সরাসরি মামলা করতে চান, তাহলে থানায় এজাহার দায়ের করতে হবে।

সাধারণ ডায়েরি (জিডি) বা এজাহার এক বিষয় নয়। যদি কেউ প্রথমেই মামলা করতে না চান, তাহলে জিডি করার পর প্রতিকারের জন্য ঢাকায় মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কাছে জিডির কপিসহ লিখিত অভিযোগ দায়ের করা যায়। সাইবার ক্রাইম ইউনিট ঘটনার সত্যতা প্রাথমিক প্রমাণ পেলে নিজেরা উদ্যোগী হয়ে মামলা করতে পারে বা এ ধরনের ভিডিও লিঙ্ক বন্ধ করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।

কেউ মামলা করতে চাইলে থানায় মামলা না নিলে ঢাকার দায়রা জজ আদালত ভবনে অবস্থিত সাইবার ট্রাইব্যুনালে আইনজীবীর মাধ্যমে সরাসরি মামলা করা যায়। তবে ট্রাইব্যুনালে মামলা করলে ট্রাইব্যুনাল সরাসরি মামলা আমলে নেবেন না। অভিযোগটি তদন্তে পুলিশ বা যেকোনো বাহিনীকে নির্দেশ দিতে পারেন অথবা থানায় মামলাটি এজাহার হয়েছে গণ্য করার আদেশ দিতে পারেন। এ ধরনের অপরাধে দায়ী ব্যক্তিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন–২০১৮ এবং পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন–২০১২ অনুযায়ী কঠিন শাস্তি পেতে হবে।

সতর্ক থাকুন এবং আবেগের বাড়াবাড়ি নয়

যেকোনো সম্পর্কের মূল ভিত্তি বিশ্বাস হলেও এ বিশ্বাস খুবই ঠুনকো যেন। বিশেষ করে প্রেমের সম্পর্কে আবেগের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি একেবারেই উচিত নয়। নিজেদের মধুর মুহূর্ত কৌতূহলবশত কিংবা নিজেদের ইচ্ছাতেও ক্যামেরাবন্দী করা উচিত নয়। হয়তো সম্পর্কের অবনতি হলে এ বিশেষ মুহূর্তই নিজের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাইবার জগতে কেউই নিরাপদ নন। হয়তো সঙ্গীটি কিছু করলেন না, কিন্তু ম্যালওয়্যার বা বিভিন্ন উপায়ে তা অনলাইনে ছড়িয়ে পড়তে পারে নিমেষেই। ফোন বা ক্যামেরা চুরি বা পকেটমার হলো তাতেও ঝুঁকি থেকে যায়। প্রেমের সম্পর্কে সতর্ক থাকাও জরুরি, বিশেষ করে নারীদের। একটু বিচক্ষণ হলেই হয়তো সঙ্গীটির মতিগতি বুঝে ফেলা সম্ভব হবে। বর্তমান সাইবার জগতে সতর্ক বা সচেতন থাকার কোনো বিকল্প নেই। আর ভুক্তভোগী হয়ে গেলে সমাজ বা পরিবারের ভয়ে পিছপা হওয়াও উচিত নয়। তবে কেউ এমন পরিস্থিতির শিকার হলে নিজের মা-বাবা বা পরিবারের খুব নিকটজন বা সবচেয়ে কাছের বন্ধুটির কাছে বলা উচিত। এতে মানসিক শক্তির পাশাপাশি প্রতিকার পেতে সহজ হয়। মা-বাবা বা স্বজনদেরও উচিত তাঁর পাশে থাকা।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।