কৈশোরে প্রয়োজন সঠিক পুষ্টি

শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য কৈশোরে প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার। মডেল: মৌনিতা, ছবি: অধুনা
শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য কৈশোরে প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার। মডেল: মৌনিতা, ছবি: অধুনা

কিশোর বয়স প্রত্যেক মানুষের জীবনেই গুরুত্বপূর্ণ। এই বয়সের সুস্বাস্থ্য পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন রোগের হাত থেকে বাঁচাতে সাহায্য করে। এ জন্য প্রয়োজন সঠিক পুষ্টি। পুষ্টির মাধ্যমেই শারীরিক বৃদ্ধি, কোষের ক্ষয়পূরণ ও দেহে শক্তি উৎপাদিত হয়। এই শক্তি দিয়ে ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা, চলাফেরা করে, পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে। সঠিক পুষ্টির জন্য এই বয়সে প্রয়োজন সুষম খাবার। যার মধ্যে থাকবে প্রোটিন, চর্বি, শর্করা, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানি।

এই বয়সে অনেকের মধ্যে স্থূলতা দেখা দেয়। কারণ, প্রয়োজনের তুলনায় উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার বেশি খাওয়া, শারীরিক পরিশ্রম কম করা, শুয়ে–বসে সময় কাটনো। সন্তানসংখ্যা কম হলে অনেক মা-বাবা তাঁদের বেশি বেশি খাবার দিয়ে থাকেন। আবার অনেকে সকালের নাশতা না খেয়ে দুপুরের পর থেকে অনবরত খেতে থাকে। ওটাও ওজন বাড়ার অন্যতম কারণ। হরমোনের সমন্বয়হীনতার জন্যও ওজন বেড়ে যেতে পারে। তবে অসুস্থতা ছাড়া যদি ওজন বেড়ে যায়, সেটাকে সহজেই আয়ত্তে আনা সম্ভব।

কৈশোরের সময়টায় হরমোনের কারণে দেহে পরিবর্তন আসে বলে কারও ওজন কমে যায় বা বেড়ে যায়। কারও রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। কারও চেহারায় কামনীয়তা কমে যায়। কারও মেজাজ রুক্ষ হয়ে যায়। এ জন্য তাদের খাবারে থাকতে হবে কলিজা, ডিম, বাদাম, খেজুর, কিশমিশ, কচুশাক, ছোট মাছ, বেদানা, সফেদা, পেয়ারা, আপেল, আমলকী, লিচু ইত্যাদি। যেগুলো রক্তস্বল্পতা রোধ করবে।

দেহের বৃদ্ধি ও হাড় মজবুতের জন্য ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম প্রয়োজন। এ জন্য খেতে হবে দুধ, দুধজাতীয় খাবার, দই, পনির, সমুদ্রের মাছ, সবজি, ডিম, পোস্তাদানা, সয়াবিন, মাখন, ঘি, মাছ ইত্যাদি। ভিটামিন সির জন্য পেয়ারা, আমলকী, আমড়া, জাম্বুরা, কমলা, মাল্টা, লেবু খেতে হবে। প্রতিদিন এক গ্লাস লেবুর শরবত পান করা খুবই উপকারী অভ্যাস। জিঙ্ক ও ফলিক অ্যাসিডের জন্য খেতে হবে সমুদ্রের মাছ, গরুর মাংস, ব্রকলি, লেটুসপাতা, পানি, ডাল, পাতাজাতীয় সবজি ইত্যাদি।

ওজন বাড়লে সমস্যা

এই বয়সে ওজন বেড়ে গেলে বেশ কিছু সমস্যা দেখা যায়। যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, কোলেস্টেরল ও ট্রাইস্লাইসেরাড বৃদ্ধি, ফ্যাটি লিভার ইত্যাদি। মেয়েদের মাসিক অনিয়মিত হয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে এটা প্রজনন ক্ষমতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

ছেলেমেয়েদের ওজন বেড়ে গেলে অনেক মা-বাবা তাদের ডিম-দুধ-মাংস খাওয়ানো থেকে বিরত রাখেন। অথচ এই বয়সে এসব খাবার প্রয়োজন দেহের বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ ও মস্তিষ্কের গঠনের জন্য। অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তির জন্য। দুধের বদলে ডাল-বাদাম-সয়াবিন-দই-শিমের বিচি দেওয়া যেতে পারে।

সন্তানের সুস্বাস্থ্যের জন্য কিছু বিষয় মা–বাবাকে মনে রাখতে হবে।

• সুষম ও আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে। আঁশ পাওয়া যাবে ডাল, আটার রুটি, শাক-সবজি ও ফল থেকে। আঁশ কোষ্টকাঠিন্য থেকে রক্ষা করবে।

• খেতে হবে টক-মিষ্টি মৌসুমি ফল।

• অতিরিক্ত তেল-চর্বি না খাওয়া ভালো। তবে তেল, ঘি, মাখন একেবারে বাদ দেওয়া যাবে না।

• বাইরের খাবারের আসক্তি রোধ হবে। কারণ, এসব খাবার মেওনেজ, মার্জারিন, সয়াসস, কেচাপ, স্বাদ লবণ (টেস্টিং সল্ট) দিয়ে তৈরি; যা স্বাদগ্রন্থিকে পরিবর্তিত করে ফেলে। এ কারণে সেসব বাচ্চার বাড়ির তৈরি খাবার খেতে ভালো লাগে না। অথচ স্বাস্থ্যগত দিক থেকে বাইরের এই খাবারগুলো ভালো নয়।

• সকালের নাশতা ঠিকমতো খেতে হবে। এই নাশতাই সারা দিনের শক্তির জোগান দেবে।

• অপুষ্টি সম্পর্কে তাদের ধারণা দিতে হবে। অপুষ্টি কেবল দরিদ্রদের মধ্যে হয় না। পুষ্টিকর ও সুষম খাবারের অভাবে সচ্ছল পরিবারেও অপুষ্টি দেখা দেয়।

• প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার যত কম খাওয়া যায়, তত ভালো।

• ভিটামিন ডির জন্য খাবারের পাশাপাশি প্রতিদিন পাঁচ মিনিট সূর্যের আলোতে থাকা প্রয়োজন।

• অতিরিক্ত ক্ষুধার্ত হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে না খাইয়ে রাখা যাবে না। এতে খাবার গ্রহণের পরিমাণ বেড়ে যাবে।

• পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে।

• শারীরিক পরিশ্রম বাড়াতে হবে। এ জন্য ঘরের কাজ ও খেলাধুলার অভ্যাস করতে হবে।

• দীর্ঘ সময় টেলিভিশন, কম্পিউটার ও মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত না থাকাই ভালো।

কিশোর–কিশোরীদের পুষ্টি ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তা জানার জন্য মাঝেমধ্যে তাদের ওজন–উচ্চতা মাপতে হবে। তারা ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত ও পড়াশোনায় অমনোযোগী হলে বুঝতে হবে তাদের শরীরে হিমোগ্লোবিন, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিনের অভাব হচ্ছে। ওজন কমানোর জন্য কখনই তাদের ডায়েট করা উচিত নয়। এতে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়াসহ নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দেবে। সুষম ও পরিমিত খাবার এবং ব্যায়ামই পারে তাদের ওজন আদর্শ মাপে রাখতে।

সবশেষে বলতে চাই, করোনাকালীন সময়েও তাদের নিয়ম মেনে খাবার খেতে হবে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি, জিঙ্ক, আয়রন ও প্রোটিন প্রয়োজন। এ সময় কিশোর–কিশোরীদের স্বাস্থ্যকর খাবার রান্না করা শেখানো যেতে পারে। এতে তাদের ঘরে থাকার একঘেয়েমি যেমন দূর হবে, তেমনি মানসিক দিক থেকেও তারা সুস্থ থাকবে।