মাছের রাজা ইলিশ

ভরদুপুরে নদীর কিনারে দুলছে মাছ ধরার নৌকা। তার পাটাতনে কলাপাতা বিছিয়ে খেতে বসেছেন মাঝিরা। প্রথমেই পরিষ্কার কলাপাতায় দেওয়া হলো সামান্য লবণ, হলুদ ও শর্ষের তেল মেশানো প্রমাণ আকারের ইলিশের পেটি, কাঁচা। তার ওপর হাঁড়ি থেকে তোলা গরম ভাত। কলাপাতার এক পাশে লবণ, তার ওপর শর্ষের তেল। যাঁরা খেতে বসেছিলেন, তাঁরা ভাত ঠান্ডা হওয়ার জন্য একটুখানি সবুর করলেন। তারপর তেল মেশানো লবণ ভাতে ছিটিয়ে দিয়ে খেতে শুরু করলেন। দু-এক গ্রাস খাওয়ার পরই ধবধবে সাদা ভাত ইলিশের তেলে ধীরে ধীরে সোনালি হতে শুরু করল! চারদিকের বাতাস হয়ে উঠল ইলিশগন্ধি।

মাঝিরা বাদে আর যে দু-চারজন ছিলেন সেখান, এভাবে ইলিশ খেয়ে স্মৃতিকথা লিখে রেখেছেন তাঁরা। ‘আহা আহা’ লিখেই সুখ্যাতি করেছেন এ খাবারের। কিন্তু এই বিশেষ রেসিপির নাম কী? না, খুঁজে পাইনি। সম্ভবত মাঝিরাও এর কোনো নাম রাখেননি। ইলিশপ্রেমী এক কবিবন্ধু বলেছিলেন, ‘কেন ইলিশ মাছের রাজা, জানেন? কারণ, ভেজে, ভাপিয়ে, তরকারিতে দিয়ে সেদ্ধ করে, লবণ মেখে শুকিয়ে যেকোনোভাবে ইলিশ খাওয়া যায় এবং সেটা সেরা স্বাদেই। তবে সম্ভবত ইলিশের সেরা স্বাদ ভাপানোতেই।’ ভাপা নাকি ভাজা, কোন ইলিশ স্বাদে সেরা, সেটা তর্কসাপেক্ষ যদিও, তারপরও ব্যাপারটা ইলিশ—কোনো কথা হবে না!

খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই, সব মাছের নামের পাশে ‘মাছ’ শব্দটি লেখা বা বলা হয়। যেমন চিতল মাছ, বোয়াল মাছ, চিংড়ি মাছ ইত্যাদি। কিন্তু ইলিশের বেলায় শুধুই ইলিশ। এ যেন এক এবং অনন্যতারই গল্প, নামেই যার পরিচয়। ইলিশ মানে জলের অধীশ্বর বা রাজা।

শুধু মানুষই নয়, ইলিশও চন্দ্রাহত হয়। ‘ফড়িংফাট’ মানে ফড়িং ধরা জোছনায় নাকি ইলিশ পাওয়া যায় বেশি, এমনটাই মনে করেন ইলিশ-জেলেরা। ভরা পূর্ণিমায় জলের গভীর তলদেশ থেকে জোছনাবিহারে বেরিয়ে পড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে চন্দ্রগ্রস্ত ইলিশ। উদ্দাম ডুবসাঁতারের খেলা চলে দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। তারপরই টপাটপ ধরা পড়ে জেলেদের ফাঁদে। এ যেন চন্দ্রকলায় আত্মহত্যা! অবশ্য ইলিশ যদি এমন আত্মহত্যা না করত, তাহলে আমরাই-বা তার স্বাদে স্বর্গ-মর্ত্য ভুলে ‘ঘটি-বাঙাল’ ঝগড়া করতাম কীভাবে?

কিন্তু এমন যে ইলিশ, বাহারি স্বাদের ইলিশ ইংরেজরা তাকে কেন ঠিক গ্রহণ করল না? ২০০ বছর এ দেশ শাসন করে, এ দেশের অর্থে-সম্পদে পরিপুষ্ট হয়েও কেন তারা ইলিশকে নিজের করে নিল না? কেনই-বা ভেটকি মাছ প্রিয় হলো তাদের? এমন প্রশ্ন বহুবার করেছি বহুজনকে। বেশির ভাগই উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেছেন। তবে দিগেন বর্মণ তার ইলিশ পুরাণ বইয়ে যা লিখেছেন, তাকে আমার মোটামুটি সন্তোষজনক বলে মনে হয়েছে। এই সব কেনর উত্তরে দিগেন বর্মণ ছোট্ট করে একটি শব্দ লিখেছেন—কাঁটা। আমরা ছড়া শুনেছি না, ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা…। ইলিশে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি কাঁটা আছে। বলা হয়ে থাকে, ৯ হাজারের বেশি কাঁটা আছে ইলিশের শরীরে!

৯ হাজারের বেশি! এত কাঁটার জঙ্গল ঠেলে কাঁটাচামচে করে ইলিশ খাওয়ার কষ্ট ইংরেজরা স্বীকার করতে চায়নি। ফলে প্রায় কাঁটাহীন ভেটকি বা কোরাল মাছই তাদের প্রিয় হয়েছিল। এখন ভাবলে ভালোই লাগে যে ইংরেজরা ইলিশ অপছন্দ করত। পছন্দ করলে তাদের ‘বিটিশবুদ্ধিতে’ কি-না-কি করে ফেলত। তার চেয়ে এ-ই ভালো হয়েছে।

অবশ্য এখন কাঁটা ছাড়া ইলিশও পাওয়া যায়। কিন্তু বাঙালির সামনে বোনলেস ইলিশের গল্প দিলে মানসম্মান থাকবে কি?

আগেই বলেছি, ভেজে, ভাপে, তরকারিতে দিয়ে সেদ্ধ করে, পেঁয়াজ দিয়ে কিংবা ছাড়া, কাঁচা মরিচ দিয়ে বা না দিয়ে, যেভাবে খুশি আপনি ইলিশ খেতে পারেন। সব সময় আটপৌরে রন্ধনপ্রণালিতে আটকে থাকতে হবে, তেমন কোনো কথা নেই। গুগল ঘাঁটলে কিংবা ইউটিউবে খুঁজলে প্রচুর রান্নার পদ্ধতি পেয়ে যাবেন। যেকোনো একটা পছন্দ করে নিন। অথবা নিজেই বসে যান নিজের মতো করে রান্না করতে। আরে খাবেন তো আপনি, কেউ আপনাকে রেটিং দেবে না। কাজেই ভয় নেই।

তবে যা-ই করুন না কেন, ইলিশের সঙ্গে চিংড়ি মেশাবেন না যেন।