করোনাকালে অস্ত্রোপচার

করোনাকালে অস্ত্রোপচারের আগে জেনে নিন সেটি জরুরি কি না। ছবি: সংগৃহীত
করোনাকালে অস্ত্রোপচারের আগে জেনে নিন সেটি জরুরি কি না। ছবি: সংগৃহীত

করোনা মহামারির এই সময় জীবনের গতি কমেছে ঠিকই, কিন্তু থেমে নেই। মানুষ বেছে নিয়েছে নতুন এক জীবনধারা। করোনাকালে সড়ক দুর্ঘটনা, কলকারখানায় দুর্ঘটনা কিছুটা কমলেও ঘর–গৃহস্থালির আঘাত ও দুর্ঘটনা অনেকাংশে বেড়ে গেছে। আগে যাঁরা গৃহকর্মীর ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, এই সময়ে স্বনির্ভর হতে গিয়ে গৃহকর্তা- গৃহকর্ত্রীর অদক্ষ হাতে ঘটছে দুর্ঘটনা। রান্নাঘরে ছুরি-কাঁচি-বঁটিতে হাত কাটা, তপ্ত কড়াই থেকে গরম তেল ছিটকে পুড়ে যাওয়া, গরম পানি গায়ে পড়া, বৈদ্যুতিক শক থেকে শুরু করে ঘটছে বৈদ্যুতিক পোড়ার (ইলেকট্রিক বার্ন) মতো ঘটনা। শিশুরা জানালায় খেলতে গিয়ে, ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে বা কাপড় শুকাতে গিয়ে নানা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।

করোনাকালে এমন জরুরি অস্ত্রোপচার বা সার্জিক্যাল ইমার্জেন্সি ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ক্ষত বা ঘা, হাড়ভাঙা, ফোড়া, অ্যাকিউট অ্যাবডোমেনসহ (যেমন অ্যাকিউট অ্যাপেনডিসাইটিস, কলেসিস্টাইসিস, পেনক্রিয়েটাইসিস) নানা সমস্যা। যেখানে জরুরি অস্ত্রোপচার ছাড়া বিকল্প নেই।

হার্নিয়া, হাইড্রোসিল, পোড়া বা দুর্ঘটনাজনিত কারণসহ নিয়মিত অস্ত্রোপচার আর কত দিন দেরি করা যায়? তার ওপর যাঁরা দুর্ভাগা আর এই ক্রান্তিকালে ধরা পড়েছে ক্যানসার, যাঁদের জন্য অস্ত্রোপচারে বিলম্ব মানেই মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাওয়া, তাঁরাই-বা কী করবেন?

যেকোনো কারণে অসুস্থতা বোধ করলে এ সময় প্রথমে টেলিমেডিসিন সেবা নিন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শে হাসপাতালে যাবেন। সামান্য কারণে বা অকারণে চিকিৎসার জন্য ঘর থেকে বের হওয়ায় রয়েছে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা আবার সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নিলেও রয়েছে জটিলতার আশঙ্কা। তাই জানতে হবে কোন বিষয়গুলো জরুরি, আর কোনগুলো বাড়িতেই চিকিৎসা সম্ভব।

হঠাৎ কাটাছেঁড়া

সামান্য কেটে বা ছিলে গেলে ঘরে বসে চিকিৎসা নিন। বাসায় ছোট ফার্স্ট এইড বক্স রাখুন। কিছুই না থাকলে সাবানপানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিন। শুকনা পরিষ্কার সুতি কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখুন। রক্তক্ষরণ বন্ধ না হলে ৬/৭ মিনিট চেপে ধরে রাখুন, তুলা দিয়ে আরও শক্ত করে বাঁধুন। দ্রুত সেলাই করার কোনো প্রয়োজন নেই। সুবিধাজনক সময়ে এমনকি ২–৩ দিন পরে দক্ষ হাতে সেলাই করানোই উত্তম, সে ক্ষেত্রে একজন চিকিৎসকের পরামর্শে এক কোর্স অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করা উচিত। 

যা করবেন না: ছাই, মাটি, গাছের পাতা, গোবর ইত্যাদি লাগাবেন না। রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য কাটা জায়গার ওপরের দিকে দড়ি দিয়ে বাঁধবেন না, প্রয়োজনে পরিষ্কার কাপড়ের টুকরা ব্যবহার করুন। মনে রাখবেন, এভাবে বাঁধন দিয়ে এক ঘণ্টার বেশি রক্ত চলাচল বন্ধ রাখা যাবে না, প্রয়োজনে কয়েক মিনিটের জন্য আবার খুলে দিতে হবে। পরিষ্কার দা-বঁটি বা ছুরি দিয়ে কাটলে টিটেনাসের ভয় নেই। মনে রাখবেন ছাই, মাটি, গোবর ব্যবহার করা থেকে যেমন, তেমনি সামান্য পুরোনো সুই-আলপিন ফোঁড়া থেকে ধনুষ্টঙ্কার (টিটেনাস) হতে পারে।

পুড়ে গেলে

গায়ে গরম পানি বা গরম তেল পড়লে কিংবা কাপড়ে-চোপড়ে আগুন ধরে গেলে সঙ্গে সঙ্গে বেশি করে ওই জায়গায় পানি ঢালুন। কমপক্ষে ২০ মিনিট ধরে। অল্প পরিমাণ জায়গা পুড়ে গেলে বাসায় চিকিৎসা নিতে পারেন। সাবানপানি দিয়ে পরিষ্কার করে শুকিয়ে ১ শতাংশ সিলভার সালফাডায়াজিন (সিলক্রিম/বার্নাক্রিম) লাগিয়ে জীবাণুমুক্ত গজ-ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে রাখুন অথবা সিনথেটিক ড্রেসিং হাইড্রোকলয়েড (ডিওডার্ম) ব্যবহার করুন। প্রয়োজনমতো পরিবর্তন করুন। ক্ষত গভীর না হলে এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে সেরে যাবে। সামান্য ব্যথা প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ নিয়মিত সেবনে কমে যাবে। বেশি পরিমাণ জায়গা পুড়ে গেলে বা ক্ষত গভীর হলে বা রাসায়নিক/বৈদ্যুতিক পোড়া হলে পরিষ্কার কাপড় বা কলাপাতা দিয়ে পেঁচিয়ে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। যাত্রাপথে ঘন ঘন খাওয়ার স্যালাইন খাওয়াতে থাকুন।

যা করবেন না: ক্ষতস্থানে ডিমের কুসুম বা টুথপেস্ট জাতীয় কোনো কিছু লাগাবেন না। ইলেকট্রিক বার্ন অল্প মনে করে অবহেলা করবেন না; আস্তে আস্তে পরে দৃষ্টিগোচর হয় এবং হাত–পা হারাতে হয়, এমনকি রোগীর মৃত্যুও ঘটে।

অন্যান্য সার্জিক্যাল সমস্যায়

যথাযথ রেফারেল পদ্ধতি অনুসরণ করুন—উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, জেলা সদর হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল। এতে সংক্রমণ ঝুঁকি এবং অযথা হয়রানির আশঙ্কা—দুটোই কমে যাবে। হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের রোগীদের তিন ভাগে ভাগ করা হয়।

১. জরুরি সার্জিক্যাল সমস্যা—যেখানে জীবন বিপন্ন বা স্থায়ী বিকলাঙ্গতার আশঙ্কা, যেমন দুর্ঘটনায় হাত-পা ভেঙে যাওয়া, তীব্র পেট ব্যথা (অ্যাকিউট অ্যাবডোমেন), প্রসবজনিত জটিলতার ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসক আপনাকে দ্রুত জেলা সদর বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, প্রয়োজনে বিশেষায়িত হাসপাতালে সরাসরি রেফার করতে পারেন। কোনো রকম কোভিড পরীক্ষা ছাড়াই করোনায় আক্রান্ত রোগীদের অস্ত্রোপচারে ব্যবহার্য পিপিই পরিধান করে জরুরি অস্ত্রোপচার করছেন চিকিৎসকেরা। নন-কোভিড হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের এই অংশটি কোভিড হাসপাতালের থিয়েটারের মতো পরিচালিত হয়।

২. জরুরি সার্জিক্যাল সমস্যা নয়, তবে তাড়াতাড়ি করলে ভালো—হার্টের বাইপাস সার্জারি, ক্যানসার সার্জারি, রক্তনালি বন্ধের অস্ত্রোপচার যা কিনা ক্ষেত্রবিশেষে কয়েক মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করা যায়, সেগুলো সম্পাদন করতে হলে করোনা পরীক্ষাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে সুবিধাজনক সময়ে অপারেশন করতে হবে।

৩. ইলেকটিভ (নিয়মিত) অপারেশন: হার্নিয়া, হাইড্রোসিল, পোড়া বা দুর্ঘটনাজনিত বিকলাঙ্গতাসহ অন্যান্য নিয়মিত অস্ত্রোপচারের জন্য এই সময়ে হাসপাতালে ভিড় করা উচিত নয়। একটু কষ্ট হলেও কিছুদিন অপেক্ষা করা মঙ্গলজনক। মনে রাখতে হবে, করোনা রোগীদের আলাদা চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে গিয়ে সরকারি-বেসরকারি সব ক্ষেত্রেই অন্যান্য চিকিৎসাসেবা সংকুচিত হয়েছে। তা ছাড়া হাসপাতালে গিয়ে আপনার নিজের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তো আছেই, পাশাপাশি অন্যান্য রোগী, ডাক্তার, নার্সসহ হাসপাতালকর্মীকে আক্রান্ত করতে পারেন। ফলে হাসপাতালের চলমান জরুরি চিকিৎসাসেবাও একপর্যায়ে ব্যাহত হতে পারে। 

তাই আসুন, আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, যেখানে সম্ভব সেখানে টেলিমেডিসিন সেবা গ্রহণ করি, যথাযথ রেফারেল পদ্ধতি অনুসরণ করে নিয়ম মানি।

সহযোগী অধ্যাপক, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, ঢাকা।