কম্বোডিয়ার ঐতিহ্যবাহী খেলা মোরগ লড়াই

লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত মোরগ। ছবি: লেখক
লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত মোরগ। ছবি: লেখক

কম্বোডিয়ার নমপেন শহরের মেকং নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত মনে হঠাৎ বেশ বড়সড় প্রশ্ন জাগল। আমি কি অমিশুক না লাজুক, নাকি কথাবার্তায় চৌকস না? এত এত মানুষ নদীর তীরে হেঁটে বেড়াচ্ছেন, কেউবা রেস্টুরেন্টে বসে একমনে খেয়ে চলেছেন, কেউবা দোকানে নানা কিছুর পসরা সাজিয়ে বসে আছেন, কেউবা লেন দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আমি মিশতে চাইলেও কেউ সেভাবে আমার সঙ্গে মিশছেনও না, আবার ঠিকভাবে কথাও বলতে পারছেন না। তাই আকার-ইঙ্গিত ও দু-একটা টুকরো শব্দে কাজ সারতে হচ্ছে। যোগাযোগের জন্য এভাবে হাত ও মুখের অভিনয় করতে করতে আবিষ্কার করলাম, আসলে আমি যেমন ওঁদের খেমের ভাষার কিছুই জানি না, ঠিক ওঁরাও তেমনি ইংরেজি জানেন না বললেই চলে। তাই এই অদ্ভুত বিড়ম্বনা!

জানুয়ারি মাসের কোনো এক সকালে ভাষাগত এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিড়ম্বনা মাথায় নিয়েই সাজানো গোছানো সুন্দর শহর নমপেন থেকে বাসে চেপে রওনা হলাম কম্বোডিয়ার প্রাচীন ও প্রাকৃতিক প্রদেশ সিয়েম রিপের দিকে। উদ্দেশ্য, ১২০০ শতাব্দীতে খেমের রাজা দ্বিতীয় সূর্যবর্মণ নির্মিত ঐতিহাসিক মধ্যযুগীয় মন্দির আঙ্করভাট দেখা। যেহেতু কারও সঙ্গে কথাবার্তায় তেমন জমছেই না, তাই বাসে চুপচাপ বসে চারপাশের সবুজ ধানখেত, বৃক্ষরাজি, নদী, জীবনযাপনের নানা প্রেক্ষাপট উপভোগ করতে লাগলাম।

এভাবে দেখতে দেখতে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম বিশ্বের সর্ববৃহৎ মন্দির আঙ্করভাটে। এই মন্দির কম্বোডিয়ার জাতীয় গৌরবের প্রতীক। তারই ধারাবাহিকতায় কম্বোডিয়ার জাতীয় পতাকায় এই মন্দিরের অলংকরণ রয়েছে। বিশাল এই মন্দির ঘুরে দেখার এক ফাঁকে এর বেশ কিছু জায়গায় মোরগ লড়াইয়ের কিছু দৃশ্যপট পেলাম। স্থানীয় এক গাইডের কাছে জানতে পারলাম, মোরগ লড়াই কম্বোডিয়ার প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী খেলা।

দারুণ আগ্রহ পেয়ে যখন গেলাম, দেখলাম মন্দিরের পেছনে বেশ খানিকটা দূরে সবুজ বন ও খেতের মধ্যে স্থানীয় তরুণী ও বয়স্ক ব্যক্তিরা মোরগ লড়াই দেখাচ্ছেন। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির দশা। তুমুল আগ্রহ নিয়ে সেদিকে পা ফেলার পথে কথায় কথায় গাইড কম্বোডিয়ার মোরগ লড়াইয়ের নানা প্রেক্ষাপট ও ঐতিহ্যের কথা জানালেন। জানতে পারলাম, খেমের ও তাদের মোরগের ভাস্কর্য এবং মোরগ লড়াইয়ের বিভিন্ন দৃশ্যপট কম্বোডিয়ার আঙ্করভাট মন্দির ছাড়াও বায়ন মন্দিরের পাথরে খোদাই করা আছে, যা এই খেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষ্য দেয়।

লড়াই শুরুর আগে মোরগকে উত্তেজিত করা হচ্ছে। ছবি: লেখক
লড়াই শুরুর আগে মোরগকে উত্তেজিত করা হচ্ছে। ছবি: লেখক

বেশ প্রাচীনকাল থেকেই খেমেররা একঘেয়ে সময়কে আনন্দময় করে তোলার জন্য এই খেলার আয়োজন করে আসছে। সাধারণত বিভিন্ন উৎসবে সাপ্তাহিক ও অন্যান্য ছুটির দিনে এবং ধান কাটার মৌসুম শেষেই এই খেলার আয়োজন করা হয়। কম্বোডিয়ার শহর ও গ্রামে এই খেলা এখনো ভীষণ জনপ্রিয়। এমনকি কম্বোডিয়ার রাজনৈতিক অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত সময়েও মানুষজন নিজেদের চাঙা রাখতে মোরগ লড়াইয়ের আয়োজন করত।

প্রাচীনকাল থেকে মোরগ লড়াই সাধারণত নিছক বিনোদনের উপাদান হিসেবেই বিবেচিত হয়ে এসেছে। তখন জয়ী মোরগের মালিককে নতুন ধানের বিয়ার বা ওয়াইন উপহার দেওয়া হতো আর মোরগের জন্য এক বস্তা নতুন ধানের চাল। দিনে দিনে এই খেলার ধরন ও চিন্তাভাবনায় বেশ পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে খেমেররা শুধু বন্ধুত্বের জন্য নয় বরং অর্থের জন্য এই খেলার দিকে বেশি ঝুঁকেছে। তাই টাকা দিয়ে জুয়া খেলার প্রচলন হওয়াতে মাঝেমধ্যেই প্রশাসন এটার ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসে।

সেই গাইড আরও জানালেন, কম্বোডিয়ার বাটাম্বাং প্রদেশের মোরগ লড়াইয়ের জন্য সবচেয়ে কঠিন যোদ্ধা হিসেবে প্রমাণিত। এই অঞ্চলের মোরগগুলোকে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের শক্তিশালী মোরগের সঙ্গে সংকরায়ণ করা হয়েছিল। পরিচর্যা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করে এসব মোরগকে লড়াইয়ের জন্য উপযোগী করে তোলা হয়। মোরগগুলোর স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য পুষ্টিকর খাবার, যেমন বাদাম, ঘি, মাখন, গরুর মাংস, ডিম, দুধ, ভিটামিন প্রভৃতি দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে লড়াইয়ের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে ব্যায়াম, প্রশিক্ষণ ও খাওয়া-দাওয়ার মাধ্যমে মোরগগুলোর ফিটনেস ধরে রাখতে কাজ করতে হয় মালিককে।

লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত মোরগ এবং তাদের মালিক দুই তরুণী। ছবি: লেখক
লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত মোরগ এবং তাদের মালিক দুই তরুণী। ছবি: লেখক

কম্বোডিয়ার মোরগ লড়াই নিয়ে গাইডের কাছ থেকে বিস্তর জ্ঞান লাভ করে খেলা দেখার দিকে মন দিলাম। খেলা শুরুর আগে দেখি মোরগের খেলোয়াড়েরা বা মালিকেরা নিজেদের মোরগ নিয়ে সমকক্ষ জোড় খোঁজার জন্য অন্যান্য মোরগের সামনে রেখে পরীক্ষা করে দেখে নিচ্ছেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মোরগ নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য তখন তৈরি। আসলে মোরগের সমান সমান জোড় না হলে লড়াই করা সম্ভব নয়, তাই ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু কাছাকাছি শক্তিশালী মোরগের সঙ্গে লড়াই হয়। একপর্যায়ে রক্ত মাতাল হওয়া লড়াইয়ের জন্য ঘাড়ের পালক ফুলিয়ে মোরগরা তৈরি হলো। এর মধ্যে লড়াইয়ের আসরে দেখি, মালিক বা খেলোয়াড়েরা মোরগকে রাগানোর জন্য নানা ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছেন।

মোরগের পায়ে অস্ত্র বাঁধার জন্য আশপাশ থাকে কাঁতিদার। কাঁতিদার চটের ওপর কাঁত, চামড়া টুকরো সুতো নিয়ে বসে থাকে। আর এরাই মোরগের পায়ে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র বেঁধে দেয়। যেমন সোজা ফলি, বাঁকা ফলি, লোহার ধারালো অস্ত্র প্রভৃতি। এই সব অস্ত্রে তুঁতে মাখানো থাকে, যাতে খুব সহজে ঘায়েল করা যায়। একটি ব্যাপার লক্ষ করার মতো, যখন মোরগের লড়াই চলছিল, তখন দর্শকদের হাততালি দেওয়া বন্ধ ছিল। এটা নাকি তাঁদের নিয়ম।

চলছে মোরগের লড়াই। উত্তেজিত মোরগের মালিক দুই তরুণী। ছবি: লেখক
চলছে মোরগের লড়াই। উত্তেজিত মোরগের মালিক দুই তরুণী। ছবি: লেখক

অনেক সময় এই খেলাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় খেমেরদের মাঝে বিশাল ঝগড়া ও মারামারি হয়। এই সব অশান্তি ঠেকাতে স্থানীয় প্রশাসন ভূমিকা পালন করে থাকে। এসব সত্ত্বেও কম্বোডিয়ার খেমেররা আনন্দ, আমোদ, প্রমোদ করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় বেশ উৎসবমুখর পরিবেশে এই খেলার আয়োজন করে থাকে।

কম্বোডিয়ার ঐতিহ্যবাহী মোরগ লড়াই ও আঙ্করভাট মন্দির দেখে সিয়েম রিপেতে ঠিক করে রাখা হোটেলে ফিরে মোরগ লড়াইয়ের ইতিহাস ঘেঁটে জানতে পেলাম, একে বিশ্বের প্রাচীনতম খেলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রায় ছয় হাজার বছর পূর্বে প্রাচীন পারস্যে এই খেলার উদ্ভব হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। খুব সম্ভবত ভারতীয় লাল বনমোরগ ব্যবহারের মাধ্যমে এ খেলার উৎপত্তি ঘটেছিল, যা পরবর্তীকালে সব ধরনের গৃহপালিত মোরগকে এ লড়াইয়ে যুক্ত করে।

ধারণা করা হয়, ভারত, প্রাচীন পারস্য, চীনসহ অন্যান্য পূর্বাঞ্চলীয় দেশে এ খেলা ছড়িয়ে পড়ে। অতঃপর এই খেলা খ্রিষ্টপূর্ব ৫২৪-৪৬০ সালে গ্রিসে প্রবেশ করে। এরপর তা এশিয়া মাইনর ও সিসিলির মাধ্যমে বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে যায়। রোম থেকে তা উত্তরাঞ্চলের দিকে ছড়িয়ে যেতে থাকে।

লড়াইকারী মোরগের পরিচর্যা করছেন মোরগের মালিক এক তরুণী। ছবি: লেখক
লড়াইকারী মোরগের পরিচর্যা করছেন মোরগের মালিক এক তরুণী। ছবি: লেখক

খ্রিষ্টীয় ধর্মগুরুরা এ উন্মত্ত লড়াইয়ের বিরোধিতা করলেও ইতালি, জার্মানি, স্পেন এবং এদের উপনিবেশগুলোতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে খেলাটি। ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ডেও একই দৃশ্য প্রবাহিত হয়। ইংল্যান্ডে ষোলো শতকের শুরু থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত রাজন্যবর্গ ও উচ্চ পদবিধারী মানুষের কাছে এ প্রতিযোগিতা বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। মোরগ লড়াইয়ের কথা ১৬৪৬ সালে প্রথম প্রামাণ্য দলিলে উল্লেখ করা হয়। এর আগে অবশ্য জর্জ উইলসন ১৬০৭ সালে তাঁর ‘দ্য কমেন্ডেশন অব কক্স অ্যান্ড কক ফাইটিং’ গ্রন্থে খেলাধুলায় মোরগ নামটি ব্যবহার করেন।

মোরগ লড়াই কতটা বেঠিক বা অমানবিক, সে বিষয়ে মাঝেমধ্যে কিছু শোরগোল ওঠে বটে। কিন্তু কম্বোডিয়ার বিনোদনের জগতে সে আলোচনা খুব একটা হালে পানি পায় না। তার ওপর এটি এখন রোজগারেরও একটি পথ হয়ে উঠছে।