আমটি আমি খাব পেড়ে

খাগড়াছড়িতে বাগান থেকে আম তুলে বাজারে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। ছবি: সংগৃহীত
খাগড়াছড়িতে বাগান থেকে আম তুলে বাজারে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। ছবি: সংগৃহীত

মৌসুম শেষ; তবু বাজারে এখনো মিলছে আম। অবশ্য আরও কিছুদিন থাকবে। অদ্ভুত এই ফলটির নিজের তুলনা নিজেই। অথচ মজার বিষয় হলো, আম লাভ করেনি স্বর্গীয় মর্যাদা। সে না হোক, এতে তার কৌলীন্য কমে না। সম্প্রতি একজনের মৃত্যু আম নিয়ে নানা কথা মনে পড়িয়ে দিল।

আমকীর্তন
গল্পটা পড়েছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে। সম্প্রতি তাঁর মৃত্যুতে বিষয়টা আবারও মনে পড়ল। মেয়েটির জন্ম যশোরে। ১৯১৯ সালে। তাঁর পরিবার অবশ্য তত দিনে কলকাতায় ব্যবসা-বাণিজ্য করে বেশ সুনাম অর্জন করেছে। বাবা অক্ষয় নন্দীর গয়নার ব্যবসা। ইকোনমিক জুয়েলারি। মেয়েটির বয়স যখন মাত্র ১১; সে প্যারিসে যায় ইন্টারন্যাশনাল কলোনিয়াল এগজিবিশনে অংশ নিতে। ১৯৩১ সালে। সেখানেই তার আলাপ এক ফরাসি বৃদ্ধার সঙ্গে। তিনি আমের আঁটি দেখিয়ে বলেন, ‘তোমার দেশ থেকে এই ফলের বীজটি এনেছি। তবে যা-ই বলো, এমন ফল কিন্তু আর খাইনি।’ পরবর্তী সময়ে সেই মেয়েটি আমের গুণকীর্তন করেছে তার স্মৃতিকথায়।

১৯১৯ সালের ২৭ জুন থেকে ২০২০ সালের ৩১ জুলাই। ১০১ বছর ১ মাস ৩ দিন। দীর্ঘ আর বর্ণময় জীবন। তিনি অমলাশঙ্কর। উপমহাদেশের কিংবদন্তিতুল্য নৃত্যব্যক্তিত্ব। সেবার সেই প্যারিসেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় নড়াইলের ছেলে উদয়শঙ্করের। এখানে প্রসঙ্গ সেটা নয়, বরং আম।

ফ্রান্স থেকে এবার জার্মানির দিকে যাওয়া যাক। বেশ কয়েক বছর আগে আমার এক জার্মান বন্ধু, গয়না নকশাবিদ, মার্টিনা ডেম্প বলেছিলেন, ‘তোমরা গরমের দেশের মানুষ। তোমাদের দেশের ফল ভারি মিষ্টি। আমের তো কথাই নেই। কিন্তু ঠান্ডার দেশের ফল আসলে পানসে।’

কেবল মার্টিনা বা ওই ফরাসি বৃদ্ধা কেন, খোদ আলেকজান্ডারই তো সেই কবে ৩২৭ সালে এ দেশ জয় করতে এসে আম খেয়ে মজে গিয়েছিলেন।

মোগল সম্রাট বাবরের মতে, আম ফলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এসব তিনি অকপটে লিখে গেছেন তাঁর জীবনচরিত ‘বাবরনামায়’। কেবল তিনি নন, আমের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তাঁর বংশধরেরাও। কারণ, অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে হর্টিকালচারেও আলাদা নজর দিয়েছেন তাঁরা। ফলে কলম করে নানা জাতের অসংখ্য আমের উদ্ভব হয় সেই সময়ে। সম্রাট আকবরই তো বিহারের দারভাঙার লাখিবাগে এক লাখ আমগাছের এক বিরাট বাগান করেছিলেন। জাহাঙ্গীর আর শাহজাহান দিল্লি ও লাহোরে আমবাগান করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। উপমহাদেশীয় সংস্কৃতিতে মোগলদের অবদান বলে শেষ করা যাবে না। যাপনের হেন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে তাঁরা উৎকর্ষ সাধনে অবদান রাখেননি। তাঁদের সময়েই কেবল আমবাগান করা নয়, আম দিয়ে তৈরি নানা পদেরও উদ্ভব হয়েছে।

তারও আগে মৌর্য সম্রাট অশোক তাঁর রাজ্যের মহাসড়কগুলোর দুপাশে প্রচুর গাছ লাগিয়েছিলেন। সেসব গাছের মধ্যে বটগাছ যেমন ছিল, ছিল আমগাছও। তাঁর শিলালিপিতে সেসব উৎকীর্ণ রয়েছে।

দ্বিতীয় মোগল সম্রাট হুমায়ুনকে পরাজিত করাকে স্মরণীয় করে রাখতে চোষা নামের আমগাছ লাগিয়েছিলেন শের শাহ। কবি ও দার্শনিক আমীর খসরু আমকে বলেছেন: নাগজা তারিন মেওয়া হিন্দুস্তান। হিন্দুস্তানের সবচেয়ে সুন্দর ফল।

অবশ্য আমের গুণকীর্তন কবি কালিদাসও কম করেননি। পার্বতীর ঠোঁটের আভাকে তুলনা করেছেন আমের কচি পাতার রঙের সঙ্গে।

বিশ্বের এমন উদাহরণ আম ছাড়া বোধ হয় দুটি নেই। কারণ তিনটি দেশের জাতীয় ফল আম: ভারত, পাকিস্তান আর ফিলিপাইন। তবে বাংলাদেশের জাতীয় ফল না হলেও জাতীয় বৃক্ষ আমগাছ। 

আমাদের জাতীয় সংগীতেই তো রয়েছে আমের উপস্থিতি: ‘ওমা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে’।

আমের অন্য নাম আবার রসাল। এই শব্দটি মনে করিয়ে দেয় মধুকবির ‘রসাল ও স্বর্ণলতিকা’ কবিতাটি: রসাল কহিল উচ্চে স্বর্ণলতিকারে/ শুন মোর কথা, ধনি,/ নিন্দ বিধাতারে।

রাজশাহীতে আমবাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত তিনি। ছবি: সংগৃহীত
রাজশাহীতে আমবাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত তিনি। ছবি: সংগৃহীত

লোকায়ত জীবন ও ধর্মে

বৌদ্ধধর্মের আচারানুষ্ঠানে আম্রপল্লব অপরিহার্য। এর একটা কারণ হয়তো হতে পারে বিভিন্ন সময়ে বুদ্ধ আমগাছের নিচে ধ্যানে বসেছেন। সেই ১৫০ খ্রিষ্টাব্দে সাঁচির ভাস্কর্যে মেলে আমগাছ। আমগাছের নকশা দেখা যায় ১৫২৩ সালে নির্মিত রাজশাহীর বাঘার মসজিদে।

মঙ্গলকাজে, মারি ও মড়কে প্রাচীনকাল থেকে আম পাতা বা আম্রপল্লব প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার বয়স্ক আইবুড়ো মেয়েদের কুমারীত্ব ঘোচাতে আমগাছের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। জৈনদের দেবী অম্বিকাকে দেখা যায় আমগাছের নিচে উপবিষ্ট অবস্থায়। ইলোরায় রয়েছে এমন গুহাচিত্র। আর স্বরস্বতীপূজায় লাগে আমের মুকুল। রবিঠাকুরের কবিতাটা মনে পড়ে? ‘ফাল্গুনে বিকশিত/ কাঞ্চন ফুল,/ ডালে ডালে পুঞ্জিত/ আম্রমুকুল।

একসময় বাঙালি বিয়েতে বাহিরসজ্জার অন্যতম উপকরণ ছিল আমপাতা। হিন্দু বিয়ে এবং মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের সজ্জায় এই চল এখনো আছে।

দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুতে তিনটি রাজফলের একটি আম। অন্য দুটি কলা ও কাঁঠাল।

কুষ্টিয়ায়ও কমবেশি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আম চাষ হয়। ছবি: সংগৃহীত
কুষ্টিয়ায়ও কমবেশি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আম চাষ হয়। ছবি: সংগৃহীত

আম-নাম

অঞ্চলভেদে একই আমের যেমন বিভিন্ন নাম আছে, তেমনি নামের উদ্ভব নিয়েও রয়েছে নানা গল্প: কিছু সত্য, কিছু কাল্পনিক। যেমন গোপালভোগকে অনেক জায়গায় বোম্বাই বলে। আবার হিমসাগরকে বলে ভুতোবোম্বাই।

আরও বেশি আছে কি না, জানি না। তবে অন্তত দুটো আমের নামকরণে দুই ইংরেজ সাহেবের ভূমিকা আছে—ল্যাংড়া ও ফজলি।

ল্যাংড়া আমের নাম হয়েছে এক ল্যাংড়া ফকিরের কারণে। বিহারের হাজিপুরে একটি আমগাছের নিচে থাকতেন তিনি। এই গাছটির আবিষ্কারক পাটনার ডিভিশনাল কমিশনার ককবার্ন সাহেব। এই আমগাছ নিয়ে সরেস বর্ণনা আছে শ্রীপান্থের লেখায়।

আর ফজুল বিবি থেকে ফজলি। এই নামের নেপথ্যেও আছেন এক ইংরেজ সাহেব। বলা হয়, ১৮০০ সালে মালদহের কালেক্টর র‌্যাভেন সাহেব ঘোড়ার গাড়ি চেপে গৌড় যাওয়ার পথে পিপাসা মেটানোর জন্য গ্রামের এক মহিলার কাছে পানি খেতে চান। যতই দরিদ্র হোন না কেন, অতিথিকে তো আর কেবল পানি দেওয়া যায় না। তাই তিনি নিজের গাছের আম আর পানি দেন। আম খেয়ে মুগ্ধ র‌্যাভেন সাহেব তাঁর নাম জিজ্ঞাসা করে উত্তর পান: ফজলু বিবি। সেই থেকে হয়ে গেল ফজলি। তবে ফজুল বিবি এই আম ফকিরদের খাওয়াতেন বলে আগে একে ফকিরভোগ বলা হতো।

রবীন্দ্রনাথ আবার তাঁর শেষের কবিতায় অমিত রায়কে দিয়ে ফজলির কথা বলিয়েছেন, ‘কবিমাত্রের উচিত পাঁচ-বছর মেয়াদে কবিত্ব করা, পঁচিশ থেকে ত্রিশ পর্যন্ত। এ কথা বলব না যে, পরবর্তীদের কাছ থেকে আরো ভালো কিছু চাই, বলব অন্য কিছু চাই। ফজলি আম ফুরোলে বলব না, “আনো ফজলিতর আম।” বলব, “নতুন বাজার থেকে বড়ো দেখে আতা নিয়ে এসো তো হে।”’

ছেলেবেলায় আমাদের বাড়ির পাশে দুটো দুধরনের আমগাছ দেখেছি। একটা গোল, গায়ের রং চালতার মতো। পাকলে হালকা হলদেটে রং ধরে। একেবারে গোল। কাঁচায় এতটাই টক যে ব্রহ্মতালু গরম হয়ে যাবে। পাকলেও তেমন স্বাদ পাইনি। এর নাম ছিল মুণ্ডমালা। মুণ্ডর মতো আকার বলে কি না, জানি না।

অন্যটাকে বলা হতো গোবিন্দভোগ। এই আম একেকটি আধা কেজি বা তার বেশি হবে। পাকলে অদ্ভুত সুন্দর একটা রং হতো। অনেকটা গেরুয়া। শুনেছি, এটার নাম হয়েছে এক চর্মশিল্পী বা মুচির নামে।

তবে আরেকটি আমের কথা না বললেই নয়। গোলাপখাস। লাল আর হলুদের মিশ্রণ। যেন কলকাতার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জার্সি। অন্য রকম স্বাদ। এই আম অনেকটা গোপালভোগের মতো মৌসুমের শুরুর দিকে ওঠে।

আমরা হাতে গোনা কয়েকটা আমের বাইরে আর ভাবতে পারি না। গোপালভোগ, ল্যাংড়া, হিমসাগর ও ফজলি। এই তালিকায় এখন যোগ হয়েছে আম্রপালি আর হাঁড়িভাঙা। অথচ কত যে অচেনা নামের নাম রয়েছে। স্বাদেও কত বৈচিত্র্য। আম্রপালির কথা উঠলে আমি ফিরে যাই সেই কোন অতীতে বৈশালী নগরীতে। পৃথিবীর বৃহৎ ও প্রাচীন প্রজাতন্ত্র। এই জনপদের নাম তখন ছিল বৃজি। সেই রাজ্যে এক পরমাসুন্দরী নগরদুহিতার নাম ছিল আম্রপালি। এই নারীর প্রেমে পাগলপারা হয়েছিলেন মগধরাজ বিম্বিসার।

তবে বর্তমান আম্রপালি সংকর প্রজাতির আম। ভারতের দুই প্রান্তের দুটি আম উত্তর ভারতের দুসেরা ও দক্ষিণ ভারতের নীলমের সংকরায়নে ১৯৭৮ সালে জন্ম।

তাইয়ো নো তামাগো। অর্থ সূর্যের ডিম। বিশ্বের সবচেয়ে দামি আম। দাম শুনলে ভিরমি খেতে হবে। প্রতিবছরে এপ্রিলে এই আমের নিলাম হয়।

তবে হ্যাঁ বাতের ব্যথা সারাতে খেয়ে দেখতে পারেন ‘পেশোয়ার কি আমির’। এর অস্তিত্ব সম্পর্কে আমি নির্দ্বিধ নই। তবে নিছক আনন্দ পেতে এই নামে একটা গল্প আছে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘টেনিদা’ সিরিজে। পড়তে পারেন। আর পড়তে পড়তে আপনি নিজে হেসে কুটোপাটি যে হবেন, তা আমি আলবত বলতে পারি।

রংপুরে আম বেচাকেনা চলছে। ছবি: সংগৃহীত
রংপুরে আম বেচাকেনা চলছে। ছবি: সংগৃহীত

আম্র-রসনা

আম দিয়ে ডেজার্ট বানানোর আধুনিক চলের প্রবর্তক অবশ্যই মোগলরা। তবে কেবল ডেজার্ট নয়, আম সংরক্ষণ ও খাওয়ার রীতিতেও তারা পথপ্রদর্শক। আমার সহকর্মী আশীষ-উর-রহমান ও আমি তখন অন্য একটি দৈনিকে কাজ করি। সেখানে তিনি একটি আমবিষয়ক নিবন্ধ লিখেছিলেন। তা থেকে জেনেছি, আমকে গাছে পুরোপুরি পাকতে দেওয়া যাবে না। বরং কয়েক দিন আগে তাকে পেড়ে তুলোর বিছানায় শুইয়ে রাখতে হবে। আম পাড়ার জন্য ব্যবহার করতে হবে তুলো বিছানো জালি। আর প্রতিদিন প্রতিবেলায় এপাশ-ওপাশ করিয়ে দিতে হবে। তাও আবার যেনতেন প্রকারে নয়; বরং তুলার দস্তানা পরে। তারপর পাকা আম কাটতে হবে রুপার ছুরিতে। তবেই না সঠিক স্বাদ মিলবে। এই না হলে রাজফলের রসনাবিলাস।

তবে অনেক বাড়িতে একসময় একাধিক বঁটি রাখা হতো আম কাটার জন্য। একেক ধরনের আম আলাদা আলাদা বঁটিতে কাটা হতো। আর কাটার আগে পানিতে ভিজিয়ে রেখে আঠা ছাড়িয়ে নেওয়া হতো। ভেজানোও হতো আলাদা আলাদা পাত্রে।

এ তো গেল বড়লোকের ব্যাপার। সাধারণ মধ্যবিত্ত কিশোরদের আম খাওয়ার আলাদা ধরন আছে। সেটা হালের ওয়াই, মিলেনিয়াম বা জেড জেনারেশন জানে না। সেই নিপাট আনন্দলাভেও বঞ্চিত তারা। পাকা আমের মুখ ছিদ্র করে চুষে খাওয়া। সেই অমৃতসুধা মুখের পাশ আর হাতের তালু বেয়ে কনুই পর্যন্ত গড়াবে। তবেই না আম খাওয়া।

এই পদ্ধতিতে আম খাওয়া রাশান প্রেসিডেন্ট নিকিতা ক্রুশচেভ আর চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে দেখিয়েছিলেন জহরলাল নেহরু। ক্রুশচেভ আকৃষ্ট হলেও চৌ হননি। বরং তিনি ছুরি দিয়েই কেটে খেয়েছিলেন।

খাটের একটা সহোদর আছে। নাম শুনেছেন? শোনেননি? শব্দটি ফারসি: তক্তপোশ। এর অর্থ কাঠের চৌপায়া। ছোট নয়। বরং বড়। শোয়া যায়। খাট এবং তক্তপোশের নিচে পাতা দিয়ে আম বিছিয়ে রাখা হতো। সেখান থেকে বলে কিংবা না বলে পাকা আম নিয়ে খাওয়া। যাকে বলে পাকা আমের মধুর রসে মুখ ভরানো।

রাঙামাটির একটি আমবাগান। ছবি: সংগৃহীত
রাঙামাটির একটি আমবাগান। ছবি: সংগৃহীত

আম-কূটনীতি

কূটনীতিতে উপাদান বা অনুঘটক হিসেবে মেলে নানা উদাহরণ। সেখানে আমের রয়েছে বিরাট এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শুরু করা যাক বাংলাদেশকে দিয়ে। একেবারে হালের কথা। গেল বছরের জুলাই মাসে বরিস জনসন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণের দিন তাঁকে শুভেচ্ছাস্বরূপ আম ও ফুল পাঠান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বর্তমান থেকে অতীতে ফিরে যাওয়া যাক। মোগলদের আমপ্রীতি নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তারা আমকূটনীতিতেও ছিল অগ্রগামী। রাজসভায় আতিথ্য গ্রহণ করা বিদেশি অতিথি ছাড়াও অন্য বাদশাহদের নিয়মিত আম উপহার দিতেন বাবর। আর দ্বীনে-ইলাহি গ্রহণকারীদের উপহার হিসেবে আম দিতেন আকবর।

আম কূটনীতিতে পাকিস্তান বরাবরই তৎপর। ১৯৬৮ সাল। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর মাত্র দুবছর হয়েছে। চেয়ারম্যান তখন মাও সে তুং। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়া আরশাদ হুসেন বেইজিং গেলেন রাষ্ট্রীয় উপহার হিসেবে আম নিয়ে। মাও সেই আম বিলিয়ে দেন। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান পায় একটি করে আম। সাধারণ মানুষের কাছে এ ছিল যেন ঈশ্বরের উপহার। এক কারাখানায় একটি আমকে বিরাট পাত্রে পানিতে ফুটিয়ে সবাই এক চামচ করে খেলেন। কারখানায় আমের একটা রেপ্লিকা বানানো হলো মোম দিয়ে। সারা দেশেই চলল এই হুজুক। এমনকি আম খেলনা, আম মোটিফমুদ্রিত মগ, পোশাক আরও কত কী যে বেরোল তখন। আর গানও রচিত হলো: সোনালি আমের রূপ দেখে/ মনে যেন হয় আমাদের মহান নেতা চেয়ারম্যান মাওকে দেখছি।

তবে আম কূটনীতিতে সর্বাধিক আলোচিত পাকিস্তান ও ভারত। দেশ বিভাগের পর থেকে নানা সংঘাত, যুদ্ধ আর ঠান্ডা লড়াই সত্ত্বেও আমবিনিময় বন্ধ হয়নি। তবে একটা আম নিয়ে এখনো রয়েছে অদৃশ্য রশিটানাটানি। ১৯৮১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডিকে এক ঝুড়ি করে আম পাঠান পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক। একটি বার্তায় জানিয়ে দেওয়া হয়, দেশের সেরা আম তাঁদের জন্য পাঠানো হয়েছে। আমের নাম রাতাউল। সেই আম খেয়ে উভয়েই মুগ্ধ। রাতাউল কেবল পাকিস্তানেই হবে বলে শুভেচ্ছা বার্তায় জানিয়ে দেন ইন্দিরা। এখানে বাধে গোল। কারণ রাতাউল আদতে উত্তর প্রদেশের রাতাউল জেলার প্রজাতি। ভারত ভাগের সময় রাতাউলের একজন ওই আমের চারা নিয়েই দেশান্তরী হন। এর পরও বিভিন্ন সময়ে উভয় দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা সৌজন্য উপহার হিসেবে আম বিনিময় করেছেন।

১৯৬১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু সফর করেন যুক্তরাষ্ট্র। সঙ্গে যায় উপহার হিসেবে আম। যদিও তখন ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আম যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। তাই হাইকমিশনের দাওয়াতে সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আঁটি যেন অতিথিরা ফেলে না দেন। কারণ সংখ্যা গুণে সব আঁটি ফেরত দিতে হয়ে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচারকে নষ্ট করে ফেলার জন্য। তবে হ্যাঁ সেই আম ভারত থেকে রপ্তানি হয়েছে বহু বছর পরে। ২০০৭ সালে। মার্কিন মোটরবাইক নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান হার্লে-ভেডিডসন ভারতে ব্যবসার অনুমতি পায় আম রপ্তানির বিনিময়ে।

ভারতে প্রথম এয়ারলাইন চালু করে টাটা। টাটা এভিয়েশন। পরে এটাই হয় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এয়ার ইন্ডিয়া। শুরুতে বিভিন্ন রাজ্য থেকে নানা ধরনের পণ্য পরিবহন হলেও আম হতো না। পরে এই তালিকায় যোগ হয় আম। সেই সময়ে সুইডেন এবং হল্যান্ডে উপহার হিসেবে আম পাঠানো হতো আমের ইউরোপীয় বাজার বিস্তারের জন্য। ১৯৩৭ সালে রাজা ষষ্ঠ জর্জের অভিষেক অনুষ্ঠান ভারত থেকে পাঠানো উপহারের মধ্যে ছিল আম। পরবর্তী সময়ে আলফানসোই প্রথম ভারত থেকে রপ্তানি হয়। লন্ডনের কভেন্ট গার্ডেন বাজারে সেই আম সুষ্ঠুভাবে বিক্রির জন্য ভারত থেকে সেই সময়ে গিয়েছিলেন দুজন ফলবিক্রেতা।

বাগান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে আম
বাগান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে আম

আমৈতিহাসিক

দুটো ঐতিহাসিক বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আম। আরও বিশদে বললে আমবাগান। একটা পলাশীর আম্রকানন, অন্যটা বৈদ্যনাথতলার আমবাগান। দুটোই আমরা জানি। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আমবাগানে রবার্ট ক্লাইভ বাহিনীর হাতে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে ইংরেজ শাসনের সূচনা।

এই ঘটনার ঠিক ২১৬ বছর পর মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগান প্রতিষ্ঠা হয় বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারের দ্বিতীয় রাজধানী। এই জায়গার নাম পরে মুজিবনগর রাখেন তাজউদ্দীন আহমদ। এখানেই ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সরকারের মন্ত্রিপরিষদ শপথ নেয়। এই সরকারের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

মির্জা পছন্দ আম নিয়ে নবাব নাজিম আর তাঁর কর্মচারীর মধ্যে হয়েছে বিস্তর রশিটানাটানি। যতই পছন্দ হোক, এই আমের চারা নবাবকে দেবেন না কর্মচারী। রাজাও নাছোড়। শেষ পর্যন্ত বৈবাহিক সম্পর্কে রফা।

একইভাবে তোতাপুরি আম নিয়ে বিবাদ গড়িয়েছে আদালত অবধি। কিন্তু হেরে যাওয়ায় নবাব ওয়াসেফ আলী মির্জা আর আম ছুঁয়েও দেখেননি।

বগুড়ায় ক্রেতার অপেক্ষায় আম সাজিয়ে রেখেছেন বিক্রেতা। ছবি: সংগৃহীত
বগুড়ায় ক্রেতার অপেক্ষায় আম সাজিয়ে রেখেছেন বিক্রেতা। ছবি: সংগৃহীত

আম-মোটিফ

কল্কা মোটিফ সবার পরিচিত। ইংরেজিতে একেই বলা হয় পেইজলি। এর আকৃতি আমের মতোই। ধারণা করা হয়, আমের আকার থেকেই এই মোটিফের উৎপত্তি। পারস্যে এই মোটিফকে বলে বুটেহ বা বুটা। অর্থ ফুল। এর উদ্ভব অন্তত এক হাজার বছর আগে। অনেকেই এই কল্কার মধ্যে পদ্ম, জোঁক, ড্রাগনের মিল খোঁজেন। পারস্যের বয়নশিল্পীরা এই নকশা তাঁতে বোনার সময় ফুটিয়ে তুলতেন। ঠিক যেভাবে জামদানিতে বোনা হয়। একাদশ শতকে কল্কা নকশা যোগ হয় কাশ্মীরি শালে। আসলে পারস্য (বর্তমানে ইরান) থেকে কাশ্মীর উপত্যকার মধ্যেই বিচরণ করেছে এই নকশা। তবে শালে এই নকশার যথার্থ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ১৪৫৯-১৪৭০ পর্যন্ত কাশ্মীর শাসন করা নবাব জইন-উল-আবেদীন। তিনি পারস্য ও মধ্য এশিয়া থেকে বয়নশিল্পীদের কাশ্মীরে নিয়ে আসেন। এরপর সম্রাট আকবরও পৃষ্ঠপোষণা দিয়েছেন। তবে জামদানিতে কল্কার অন্তর্ভুক্তির পেছনে ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীর। তাঁর জমানায় পারস্যের বয়নশিল্পীদের ভারতে নিয়ে আসা হয়। তবে বাংলাদেশের জামদানি বয়নশিল্পীরা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছিলেন বয়নে কল্কা নকশা ফুটিয়ে তোলার দক্ষতা। তবে সাম্প্রতিক উদ্যোগে নবীন বয়নশিল্পীরা নিপুণতা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে কাশ্মীরি শাল ইউরোপে যেতে শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কারণে। ১৮০০ সালের দিকে ইউরোপে পেইজলির চাহিদা তুঙ্গে ওঠে। এই সময়ে নেপোলিয়ানের স্ত্রী জোসেফাইনও সমৃদ্ধ করেন তাঁর সংগ্রহ। তরুণ রানি ভিক্টোরিয়া ১৮২৭ সালে সংগ্রহ করেছিলেন কল্কা নকশার ১৭টি কাশ্মীরি শাল।

ভারত থেকে যাওয়া কল্কা নকশাই পরে স্কটিশ বয়নশিল্পীরা তাঁদের বয়ন গ্রহণ করেন। আর স্কটিশ শহর পেইজির নামে নামকরণ করে এই মোটিফের।

ভারতে এখনো বিভিন্ন বয়ন (ব্রোকেড, জামেভার), সূচি (চিকনকারি) ও ছাপ (কলমকারি) মাধ্যমে কল্কা মোটিফ ব্যবহৃত হয়। অবশ্য কেবল বারত কেন কল্কা বা পেইজলি, যে নামেই ডাকা হোক এই নকশা আজ সর্বজনীন, বিশ্বজনীনও।

খাগড়াছড়িতে গাছে ঝুলছে আম। ছবি: সংগৃহীত
খাগড়াছড়িতে গাছে ঝুলছে আম। ছবি: সংগৃহীত

আমসংখ্যান

বিশ্বে তালিকাভুক্ত আমের সংখ্যা হাজার দেড়েক। আর সব মিলয়ে সংখ্যাটা দাঁড়াবে অন্তত ১৫ হাজার। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আম উৎপন্ন হয় ভারতে। রপ্তানিও তারা করে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু খাওয়ার দিক থেকে এগিয়ে মার্কিনরা। ফলে তাদের আমদানিও করতে হয় সবচেয়ে বেশি। পরিমাণটা বিশ্বের মোট আমদানির ২৩ শতাংশ। এরপর আছে হল্যান্ড ১০ ও জার্মানি ৭ শতাংশ। তবে যেসব দেশ দ্রুত রপ্তানি বাড়াচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছে লাওস, বাংলাদেশ ও আজারবাইজান।

বাংলাদেশে বর্তমানে ২২ জেলার প্রায় ১ লাখ হেক্টর জমিতে আম চাষ হচ্ছে। বছরে উৎপাদন ২৪ লাখ মেট্রিক টন। বিশ্বে আম উৎপাদনে বাংলাদেশ সপ্তম। তবে রপ্তানিতে বাংলাদেশ প্রথম বিশের মধ্যে নেই। উৎপাদন ও রপ্তানিতে শীর্ষে ভারত। ভারতে উৎপাদনের পরিমাণ বছরে ১ কোটি ৬৩ লাখ ৩৭ হাজার ৪০০ টন; যার বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৪২.২ শতাংশ। চীনে উৎপাদন ৪৩ লাখ ৫১ হাজার ৫৯৩ টন। আর থাইল্যান্ডে ২৫ লাখ ৫০ হাজার ৬০০ টন। অন্যদিকে আম রপ্তানিতে ভারতের পরে আছে চীন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, মেক্সিকো ও ব্রাজিল।

খুলনার এই আমের রঙটা ব্যাতিক্রম। ছবি: সংগৃহীত
খুলনার এই আমের রঙটা ব্যাতিক্রম। ছবি: সংগৃহীত

পুষ্টিগুণ

আম কেবল সুস্বাদু ফলই নয়, এর পুষ্টিগুণও বিস্ময়কর। আম ফ্যাট, সোডিয়াম আর কোলেস্টেরলমুক্ত। এমনকি এতে থাকা শর্করা ধীরে ধীরে হজম হওয়ায় এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স মাঝারি, ৬০-এর কাছাকাছি। অন্তত ২০ ধরনের ভিটামিনের উপস্থিতি আমকে দিয়েছে সুপারফুডের কৌলীন্য। জাতভেদে পুষ্টিগুণের হেরফের হলেও সাধারণভাবে ১০০ গ্রাম আমে শক্তির পরিমাণ ৬০ ক্যালরি। আম পটাশিয়ামের চমৎকার উৎস৷ প্রতি ১০০ গ্রামে আছে প্রায় ১৬৮ মিলিগ্রাম। আরও আছে ক্যালসিয়াম, লোহা, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, দস্তা ও ফসফরাস। আমে থাকা উল্লেখযোগ্য ভিটামিনগুলো হলো ভিটামিন এ (বেটা ক্যারোটিন ও লুটিন জিজানথেন), থায়ামিন (বি১), রিবোফ্লাভিন (বি২), প্যানটোথেনিক অ্যাসিড (বি৫), ভিটামিন বি৬, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই ও ভিটামিন কে। কেবল ভিটামিন সি রয়েছে ৬০ শতাংশ গবেষকেদের মতে, একটি আম খেলে প্রায় ৫০০ ইউনিট ভিটামিন সি খাওয়া হয়। ভিটামিন এ-র পরিমাণ প্রায় ২১ শতাংশ। শর্করা প্রতি ১০০ গ্রাম আমে ১৫ গ্রাম। পাকা আমে আঁশের পরিমাণ প্রায় ১.৬ গ্রাম, যা অন্যান্য ফলের মধ্যে পাওয়া যায় না।

আমের উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। আম রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। বেটা ক্যারোটিনের কারণে চোখ, হাড়, দাঁত, মাড়ি, ত্বক ও চুল সুস্থ রাখে এবং অ্যাজমা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিডনি, লিভার ও হার্ট সবল রাখে। কোষ্ঠকাঠিন্য, যক্ষ্মা ও রক্তাল্পতা দূর করে। হজমে সহায়তা করে। ক্যানসার বিশেষত কোলন ক্যানসার, স্তন ক্যানসার, রক্তস্বল্পতা ও প্রোস্টেট প্রতিরোধ করে। আম হজম ও স্মৃতিশক্তি বাড়ায়। গরমে কাঁচা আম হিটস্ট্রোকের সম্ভাবনা হ্রাস করে। শরীরের ক্ষয়রোধ করে এবং স্থূলতা কমায়। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। কাঁচা আমের পেকটিন গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রোগ উপশমে সহায়ক। কাঁচা আমবাটা বদহজম দূর করে। এ ছাড়া রাতে এক গ্লাস গরম পানিতে ১০-১৫টি আম পাতা ভিজিয়ে রেখে সকালে ওই পানি খেলে পেট ভালো থাকে। আমগাছের ছালবাটা কৃমিনাশক।

চট্টগ্রামের বাজারে আম। ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রামের বাজারে আম। ছবি: সংগৃহীত

সৌন্দর্যচর্চায় আম

আমকে লাভ ফ্রুট বলা হয়। তবে ম্যাজিক ফ্রুট বললেও বাড়াবাড়ি হবে না। কারণ উপকারের কথা তো বলাই হয়েছে তবে এর সঙ্গে আরও যোগ করা যেতে পারে সৌন্দর্যচর্চায় আমের ভূমিকা। সানবার্ন, ত্বকের দাগ ও ব্রণের সমস্যা দূর করতে আমের রয়েছে সহায়ক ভূমিকা। পাকা আম মুখ ও নাকে লাগালে ব্ল্যাক হেড দূর হয়। পাকা আমের পেস্টের সঙ্গে মধু ও দুধ মিশিয়ে লাগালে ত্বক কোমল আর মসৃণ হয়।

খুশকির সমস্যা সমাধানে রয়েছে আমের আঁটির ভূমিকা। আঁটি গুঁড়া করে পানি বা তেলের সঙ্গে মাথায় মাখলে খুশকি দূর হয় এবং চুল মজবুত হয়। এ ছাড়া দাঁতের মাড়ি শক্ত করতেও এই গুঁড়া কার্যকর। অতএব আম-আঁটি দিয়ে কেবল ভেঁপু হয় না, আরও অনেক কাজেই লাগে।

ডাকটিকিটে আম

আম তিন দেশের জাতীয় ফল। সংগত কারণে তারা এই ফলকে ডাকটিকিটে স্থান দেবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে অন্য অনেক দেশও ভুবনমোহন এই ফলের সম্মানে ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের ডাক বিভাগ প্রকাশিত আম নিয়ে ডাকটিকিটের মূল্যমান এক টাকা। তবে সময়ের নিরিখে, ১৯৬৩ সালে কিউবা আমের ছবি দিয়ে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে; তার দাম ছিল ১৩ সেন্ট। পলিনেশিয়ার ডাকটিকিট প্রকাশ পায় ৬ আগস্ট ২০১০। দাম ১০০ ফ্রাঁ। এখানে একটু বলে রাখা ভালো, পলিনেশিয়ার মানুষের আমের সঙ্গে পরিচয় ঘটে ১৮৪৮ সালে। অ্যান্টিগা আর বারবুডা আমগাছকে ডাকটিকিটের উপজীব্য করে ২০১৫ সালে। দাম ছিল ২৫ সেন্ট। আর ম্যাগনিফেরা ওডোরাটা গোত্রের আম নিয়ে ১০ রিঙ্গিত মূল্যমানের ডাকটিকিট করে মালয়েশিয়া ২০১২ সালে। মাদাগাস্কার আম নিয়ে ডাকটিকিট করে ১৯৯২ সালে। ১৪০০ ফ্রাঁ মূল্যমানের। আম নিয়ে লাওসের ডাকটিকিটের দাম ছিল ২০ কিপ। আর ১৯৮৫ সালে পাকা আমসহ আমগাছের ছবি দিয়ে আর্জেন্টিনা যে ডাকটিকিট ছাপে, তার দাম ছিল ১.১৫ ডলার। ভারত আম নিয়ে যে ডাকটিকিট প্রকাশ করে তার মূল্যমান ৫০ পয়সা। ২০১৮ সালে চীনে আম নিয়ে ডাকটিকিটের দাম রাখা হয় ১.৫০ রেনমিনবি। ১৮ জুন ২০০২ সালে পাকিস্তান ফ্রুটস অব পাকিস্তান সিরিজে চার ধরনের (আনওয়ার রাতল, দুসেরি, সিন্ধ্রি ও চোষা) আমের ছবি দিয়ে চারটি ডাকটিকিট বের করে। প্রতিটির মূল্য ছিল ৪ রুপি করে। ভারত আর পাকিস্তান ছাড়াও ফিলিপাইনের জাতীয় ফল আম। তারাও ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে একাধিকবার। প্রথমবার ১৯৯৩ সালে। জাতীয় পতাকার সঙ্গে, জাতীয় ফল। এই ডাকটিকিটের দাম রাখে ৮ পেসো। এরপর আবারও তারা আম নিয়ে ডাকটিকিট প্রকাশ করে ৩ পেসো মূল্যের। এ ছাড়া, পাপুয়া নিউগিনি, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, টোগো, বার্বাডোজ, কম্বোডিয়া, গ্যাবনসহ অনেক দেশই আম দিয়ে ডাকটিকিট ছেপেছে।

শেষ কথা

বাঙালির অক্ষরজ্ঞান শুরু হয় আ-য়ে আমটি আমি খাব পেড়ে-র মধ্য দিয়ে। ফলে আমের সঙ্গে থাকে তার সারা জীবনের সম্পর্ক। জীবনে নানা পরতে আমের উপস্থিতি থেকে যায়। সাহিত্যেও বিম্বিত আম্রভাবনা। গরমে মানুষ হাঁসফাঁস করে। অথচ সেই নিদাঘের আদর না পেলে গ্রীষ্মে ফল পাকে না। তাই তো কবি দেবেন্দ্রনাথ সেন পরমাদরে বলতে পারেন, ‘কনকিত পাকা আম নিদাঘের সোহাগে রঞ্জিত’।