মোবাইল ফোন ট্যাবে শিশুরা কতক্ষণ থাকবে

একটানা অনেক সময় শিশুকে যন্ত্রের সামনে থাকতে দেওয়া উচিত নয়। মডেল: আনুসা, ছবি: খালেদ সরকার
একটানা অনেক সময় শিশুকে যন্ত্রের সামনে থাকতে দেওয়া উচিত নয়। মডেল: আনুসা, ছবি: খালেদ সরকার

স্কুলে ডিভাইস নাকি ডিভাইসে স্কুল, কোনভাবে বলব! একসময় সবাই মিলে বলতাম, ‘হে শিশুরা, স্কুলে মোবাইল ফোন নিয়ো না।’ শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন নিতে দিত না। মোবাইল শিশুদের জন্য নয়। ওদের জন্য ভালো নয়। ওদের জন্য চাই চারপাশের আনন্দ উপকরণ, যন্ত্র নয়।

করোনাকাল বদলে দিল সবকিছু। এখন সে কথা কেমন করে বলব। স্কুল, পড়াশোনা, শিক্ষকের অসামান্য লেকচার—সবকিছু এখন যে যন্ত্রে ঢুকে পড়েছে। কে এমনটা ভেবেছিল! তবে এটাও ঠিক; যুগের হাওয়ায় তাল মেলাতে হয়েছে এবং হবেও। নতুবা অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তে হয়। করোনাকালে বাচ্চাদের পড়াশোনা নিয়ে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সবার মনেই প্রশ্ন, সংশয়, ভয়—ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষার হাল কী হবে, দেশ ও দশের কী হবে।

স্কুল বন্ধ করতে হলো কেন

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাচ্চারা বড়দের তুলনায় কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয় কম। কিন্তু তারা রোগ সংক্রমণের ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। বাচ্চাদের মধ্যে লক্ষণ কম দেখা যায়, তবে ভাইরাস লোড বেশি থাকতে পারে। তাই স্কুলে গেলে এই কোভিড-১৯ সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। আশঙ্কাটা খুবই উদ্বেগের। স্কুল বন্ধ থাকলে করোনা বিস্তারের হার ৪০-৬০ শতাংশ কমে যাবে।

তাহলে পড়াশোনা

অনির্দিষ্টকালের জন্য স্কুল বন্ধ হলে বাচ্চারা কীভাবে পড়বে? তাই নতুন প্রচারণা শুরু হলো। মোবাইল ফোন, টিভি, রেডিও—সব মাধ্যম এখন সচল। সব মাধ্যমে শিক্ষাকে কেন্দ্র করে প্রোগ্রাম চালু হয়েছে। আগেও ছিল। তবে এখন তা ব্যাপক হারে বেড়েছে।

ফেসবুক, ইউটিউব সবখানে অনলাইন ক্লাস চলছে পুরোদমে। অনলাইন প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, ওয়েবিনার চলছে। ছোট-বড় সবাই জ্ঞান আহরণে আর পিছিয়ে নাই। আগে বাচ্চাদের হাতে মোবাইল দিলে যে বাঁকা চাহনিতে সবাই দেখত, এখন তা আর কেউ দেখে না। কারণ এখন অনলাইন ক্লাসে সবাই উত্সাহী। সেখানে কী দেখা যায় না বা শেখা যায় না! নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি ছবি আঁকা, নাচ-গান, ব্যায়াম, রান্নাবান্না, স্পোকেন ইংলিশ, বাগান করা, গৃহস্থালি কাজকর্ম—সবই শিশুরা শিখছে, জানছে। তার পরও তাদের মোবাইল ফোন বা যন্ত্র ব্যবহার করার সময়ের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। অন্যথায় এসবের অপব্যবহার হতে পারে।

যন্ত্রে যেভাবে শিশু-কিশোর প্রভাবিত হচ্ছে

শিশুদের তো বটেই, বড়দেরও কানে হেডফোন, চেখের সামনে পর্দা কতক্ষণ থাকবে, তা চিন্তার ব্যাপার বৈকি। শিক্ষণীয় মাধ্যমের পাশাপাশি অশিক্ষার প্রভাবও তো কম নয়। তা ছাড়া শারীরিক সুস্থতা ও অসুস্থতার দিকেও খেয়াল রাখা দরকার।

* দিনে চার ঘণ্টার বেশি পর্দার সামনে বসে থাকলে বাচ্চাদের ওজন বেড়ে যাবে। পরবর্তী সময়ে ডায়াবেটিস, হাইপার টেনশন প্রভৃতি শারীরিক রোগের বীজ নিয়ে চলতে হবে।

* ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায় বিশেষত শিশুদের। কারণ, যন্ত্র থেকে যে রেডিয়েশন হয়, তা বাচ্চাদের শরীরের হাড়ে, টিস্যুতে অনেক বেশি ঢুকে পড়ে, যা কারসিনোজেন হিসেবে শরীরে থেকে যায়।

* রেডিয়েশন মস্তিষ্কের কাজকর্মে বাধা দেয়। এর ফলে বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটার তৈরি হতে পারে না। আর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠায় বাধা দেয়।

* পড়াশোনায় মনোযোগ না দিয়ে অনেকে অন্যান্য দিকে নজর দেয়। চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত থাকে বেশি। অনেকে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে যায়। আগেও দেখত। কিন্তু সুযোগ এখন বেশি।

* পড়াশোনা থেকে দূরে সরে যাওয়ার পাশাপাশি অনৈতিকতাও শেখে। পরীক্ষায় নকল করা, ছবি, রেফারেন্স সরবরাহ করা এই বয়সে শিশু-কিশোরদের মননে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পরবর্তী সময় এদের ব্যক্তিত্ব ঠিকমতো তৈরি হয় না।

* যেভাবে আঠার মতো বাচ্চারা মোবাইল ফোনের সঙ্গে লেগে থাকে, তাতে মনে হয় ওর একপাশে মোবাইল আর একপাশে সারা দুনিয়া। এতে সামাজিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। আপনার সন্তানের (বিশেষ করে বয়স যদি তিনের নিচে হয়) মনোযোগ সরাতে বা শান্ত করতে যদি ডিভাইস অন্যতম মাধ্যম হয়, তবে অবশ্যই আপনার সন্তানের গণিত, বিজ্ঞান বা সাহিত্যভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়নের দিকে খেয়াল রাখবেন।

* সহমর্মিতাবোধ বা সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, দৈনন্দিন জীবনে যা অপরিহার্য, তা না হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।

* ইন্টারেনেটে সহিংস সিনেমা, গেম, কার্যকলাপ যে শিশুরা দেখে, তাদের মধ্যে স্মৃতিগুলো গেঁথে যায়। পরবর্তী সময়ে পৃথিবীকে তাদের কাছে ভয়ংকর মনে হয়। আপন লাগে না। শিশু-কিশোররা সহিংস হয়ে ওঠে।

* টিভি সিরিয়াল, সিনেমা বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত চরিত্রগুলোর সঙ্গে অনেক শিশু-কিশোর অজান্তে নিজেদের মিলিয়ে ফেলে। পরবর্তী সময়ে সেই চরিত্রে নিজেরাই নিজেদের জীবনে ঘটাতে চেষ্টা করে। বাচ্চাদের মানসপটে কী কখন গেঁথে যাবে, কে জানে।

মোবাইলে স্কুল, কী করণীয়

ক্লাসের হিসাব করে শিশুর পর্দার সময় (স্ক্রিন টাইম) বেঁধে দিতে হবে। বাকি সময় স্বাভাবিক নিয়মে পড়াশোনা করবে, চর্চা করবে।

আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস এই নিয়ে একটি চমৎকার গাইডলাইন দিয়েছে। সেই গাইডলাইন মেনে নিচের পরামর্শগুলো বেশ কার্যকর হবে।

* ১৮ মাস বয়সী শিশুদের জন্য কোনো যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। পরিবার, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে তারা সময় কাটাবে।

* ১৮ থেকে ২৪ মাস বয়সী শিশুদের জন্য কিছু স্ক্রিনটাইম দেওয়া যাবে, তবে সঙ্গে অভিভাবক থাকবে।

* প্রাক্‌বিদ্যালয়ের (প্রি-স্কুল) শিশুরা পর্দায় ১ ঘণ্টা পাবে পড়াশোনার জন্য। তবে পাশে অভিভাবক বা শিক্ষক থাকবে তাদের দেখাতে বা বোঝাতে।

* স্কুলপড়ুয়া শিশু-কিশোর এবং ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের জন্য প্রয়োজনমতো যন্ত্র ব্যবহার করতে দেওয়া যেতে পারে। তবে তাদের সময়সূচি যেন অভিভাবকের জানা থাকে।

* ঘুমানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় থাকতে হবে। যথেষ্ট ঘুম না হলে পড়াশোনা মনে রাখাটা কষ্টকর হয়ে উঠবে ।

* নিয়মিত শারীরিক নড়াচড়া করা জরুরি। এতে স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ বাড়ে।

এই সময়ে এসে শিশুদের এই বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চাদের ঠিকমতো বড় করে তুলতে চাই সবাই। সুস্থ, সবল, মানসিক শক্তিমত্তায় পরিপূর্ণ করতে চাই। সে জন্য সবকিছু ভেবেচিন্তে, মেনে নিয়ে সামনে এগোতে হবে।