ওদের ঝরনা আমাদের ছড়া

এমন জংলাপথ মাড়িয়ে পৌঁছতে হবে কুলুমছড়ায়। ছবি: লেখক
এমন জংলাপথ মাড়িয়ে পৌঁছতে হবে কুলুমছড়ায়। ছবি: লেখক

সিলেট বেড়াতে গেলে একটা আফসোস প্রায়ই হয়। এত সুন্দর সব ঝরনা, বেশির ভাগই ভারতের সীমানায় পড়েছে। আমরা শুধু দূর থেকে দেখতে পাই। কুলুমছড়া ঝরনাটাও তেমনি। মেঘালয়ের পাহাড় থেকে শুরু হয়ে এ দেশে এসে ছড়া হয়ে গেছে। এর উৎসে যেতে না-ই পারি, বাংলাদেশ প্রান্তে এর পানিতে গোসল করেও মজা পেয়েছি। 

ছবি: লেখক
ছবি: লেখক

সিলেটে এখন পর্যটকদের বেজায় ভিড়। বৃষ্টির পানিতে ঝরনাগুলো টইটম্বুর, তা দেখতেই আসা। বর্ষার শুরুতে আমরা গিয়েছিলাম সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লোভাছড়ায়। সেখানে দুদিন কাটিয়ে আরও এখানে-ওখানে ঘুরে তারপর পাড়ি দিলাম মেঘালয় সীমান্তে। সিলেট বলতে গেলে মেঘালয় পর্বতমালায় ঘেরা। সিলেট এলেই আমরা দূর থেকে দেখতে পাই মেঘালয়ের বনাঞ্চলঘেরা পাহাড় আর সে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া সব ঝরনা। কিছু ঝরনা আছে একটু দুর্গম এলাকায়।
আমরা প্রায় আটজনের দল মিরাবাজার থেকে লেগুনায় যাত্রা শুরু করি। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার সোনার হাট সীমান্তবর্তী কুলুমছড়া একটি গ্রাম। এখানে ভারত সীমান্তের ঝরনাটিই কুলুমছড়া ঝরনা নামে পরিচিত। বৃষ্টি যত দিন থাকবে তত দিনই কুলুমছড়ায় বেড়ানো যাবে। অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত সাধারণত পানির প্রবাহ থাকে।
দুপুর ১২টায় আমরা হাদারপার পৌঁছে দুপুরের খাবার খেয়ে চলে আসি পিয়াইন নদীর তীরে। এখানে আগে থেকেই আমাদের জন্য নৌকা প্রস্তুত ছিল। হাদারপার ঘাটে কোনো ছইওয়ালা নৌকা মেলে না। তবে আমাদের জন্য নির্ধারিত নৌকাটি বেশ বড়সড়। নৌকা চলতে শুরু করার ১০ মিনিটের মাথায় চলে আসি বিছনাকান্দি। পিয়াইন নদীতে পানি থইথই। পানির ধারায় ভেসে আসা মাছের ঝাঁক ধরায় ব্যস্ত অনেকে। বিছনাকান্দি পেছনে ফেলে আমাদের নৌকা কুলুমছড়ার দিকে তর তর করে এগিয়ে চলেছে।
এখন আমরা খোলা প্রান্তরে। গন্তব্য খুব কাছে বোঝাই যাচ্ছে। পাহাড়ের প্রায় পাদদেশে চলে এসেছি। চারপাশটা অসম্ভব সুন্দর। ঝরনার কুলকুল ধ্বনি কানে আসে। সবার মধ্যে কী এক চঞ্চলতা। নৌকা ছেড়ে এবার জংলাপথ ধরে হেঁটে চলি। এখন ঝরনার শব্দ প্রবল। ঝরনার পানি গড়িয়ে বাংলাদেশ প্রান্তে আছড়ে পড়ছে। সে কী তার গর্জন, দৃশ্য বটে! এত কাছে থেকে পাহাড়ি ঝরনার প্রবাহ বা ঝরনাধারার এমন দৃশ্য এভাবে আগে কখনো দেখিনি। এমন দৃশ্য যতনা বেশি ক্যামেরার লেন্সে ধরা দিচ্ছে তার চেয়ে বেশি মনে গেঁথে যাচ্ছে! বিশাল সব পাথর বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে উচ্ছল সে ঝরনা। আমার সঙ্গীরা প্রবল উচ্ছ্বাসে ঝরনার পানিতে লাফিয়ে পড়ে। আমার হাতে ক্যামেরা কিন্তু ছবি তোলার তাড়া নেই। অসাধারণ সে সৌন্দর্য শুধু চেয়ে দেখার। আমি তাকিয়ে দেখি, তারপর পাথর জল বেয়ে আরও উপরে উঠি। এর মধ্যে বিকাল প্রায় শেষ, গ্রামবাসীরা তাড়া দিচ্ছে ফিরে যাওয়ার। সূর্যের আলো নিভে যাওয়ার আগেই আমরা ফিরতি পথ ধরি।
এখানে ঝরনার পানিতে স্রোত খুব বেশি, একই অবস্থা বাংলাদেশ প্রান্তে ছড়ার। সুতরাং এখানে এলে এবং গোসলের সময় সাবধান থাকতে হবে। এখানে নানা প্রজাতির উদ্ভিদ, অর্কিড, ভেষজ গাছ-গাছড়ার দেখা পাবেন। কুলুমছড়া ঝরনা দেখার জন্য সকাল সকাল যাওয়াই ভালো। আর সন্ধ্যার আগেই ফেরত আসা উচিত। কেননা, এখানে চড়াই ভাঙতে দম ফুরিয়ে যাবে। আর সীমান্ত এলাকা বলে দিনের আলো ফুরিয়ে আসার আগেই ফিরে আসুন। ঝরনার গভীরে না যাওয়াই ভালো।

ছবি: লেখক
ছবি: লেখক

কীভাবে যাবেন
কুলুমছড়া বেড়ানোর মোক্ষম সময় আগস্ট থেকে অক্টোবর মাস। ঢাকা-সিলেট দিনরাত বাস চলাচল থাকে। যেকোনো বাসে চড়ে বসলেই হলো। তবে সন্ধ্যার বাসে যাত্রা শুরু করলে রাতটুকু বিশ্রাম পাবেন। পরদিন সকাল সকাল কুলুমছড়া যাত্রা করুন। এমন ভ্রমণ দলবেঁধে করাই ভালো। সিলেট শহর থেকে হাঁদারপার আপনার বাহন হবে লেগুনা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা মাইক্রোবাস। হাঁদারপারে মোটামুটি মানের খাবার ব্যবস্থা আছে। খাবার খেয়ে, নৌকার ভাড়া চুকিয়ে তবেই নৌকায় উঠুন। রাত্রিযাপনের জন্য আপনাকে সিলেট শহরের ওপরই নির্ভর করতে হবে। এখন সিলেটে পর্যটক খুব বেিশ। সুতরাং যাত্রার শুরুতে হোটেল বুকিং দিয়ে রওনা হতে হবে। মিরাবাজার, জিন্দাবাজার বা দরগাগেটে ভালো মানের হোটেল রয়েছে। আপনি সিলেট শহরকে কেন্দ্রবিন্দু করে কুলুমছড়াসহ সিলেটের অন্যান্য দর্শনীয় সবগুলো জায়গাই ঘুরে আসতে পারবেন।

ছবি: লেখক
ছবি: লেখক