বদলে গেছে ভোজ্যতেল

.
.

তেলে আর জলে নাকি মিশ খায় না। কিন্তু রন্ধনকর্মে তাদের না মিশিয়েও উপায় নেই। আবহমানকাল থেকেই চলে আসছে এই মিশেল। সেকালে রান্নার প্রধান তেল ছিল সরিষা। মুক্তি মিলেছে কলুর বলদের। ঘানিতে ভাঙা সেই খাঁটি ঝাঁজালো তরলটিকে পাওয়া তাই এখন দুর্লভ। তবে সরিষার তেল অবশ্য বিলুপ্ত সামগ্রীর কাতারে পড়েনি। রান্নায় তার ব্যবহার যদিও ঢের কমেছে। ভাজি, ভর্তা, আচার, চাটনি প্রভৃতি গৌণ এবং খানিকটা শখের রান্নাতেই এখন সরিষার তেলের প্রয়োগ করে থাকেন পাচক-পাচিকারা।

দিন বদলায়। মানুষের আচার-আচরণ, রুচি আর অভ্যাসও পাল্টায়। আজ যা আধুনিক, কাল তাই মলিন। সেকেলে। সরিষার তেলের হাল হয়েছে অনেকটা তেমনি। তার একচেটিয়ায় শুধু ভাগ বসায়নি, বলা যায় সরিষার তেলকে রীতিমতো ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে সয়াবিন তেল। সরিষার তেলের পেরে না ওঠার কারণ অনেক। দেশে মানুষ বেড়েছে অনেক। চাহিদা মোটানোর মতো সরিষার উৎপাদন বাড়েনি। সেই খালি জায়গাটি পূরণ করতে গত শতকের সত্তর দশক থেকেই একটু একটু করে সয়াবিনের প্রবেশ। তখন তার দামও ছিল সস্তা।

সয়াবিনের দ্রুত জনপ্রিয়তার এটিও এক কারণ। বাজারে অবশ্য এখনো সরিষার তেলের তুলনায় সয়াবিন তেলের দাম অর্ধেক। ফলে সরিষার তেলের হৃত আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা যে নেই, তা নিশ্চিত।
প্রথম স্থানে সয়াবিনের আসনটিই কি টিকে যাবে? অনেক দিন তো হলো। মাঝখানে পাম তেলের তার জন্য কিছুটা হুমকি হয়ে উঠেছিল বটে, তবে শেষাবধি ভোজ্যতেলের তালিকার শীর্ষস্থান থেকে সয়াবিনকে অপসারণ করা যায়নি। সয়াবিনের দর মাঝে মাঝে বেশ চড়ে যায়। তখন দায়ে ঠেকে অনেকে পাম তেলের দিকে হাত বাড়ান। নয়তো সরিষার তেলের বিকল্প হিসেবে সয়াবিন তেল যেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, সয়াবিনের বিকল্প হিসেবে পাম তেল তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি।

ইতিমধ্যে আরও এক নতুন ভোজ্যতেল বাজারে হাজির। অভিনবই বলা যায়। ধানের তুষের তেল বা ‘রাইস ব্রান অয়েল’। যে তুষ-কুঁড়া এত দিন জ্বালানি আর গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো, তা নিংড়ে তেল বের করা হচ্ছে প্রযুক্তির উৎকর্ষের কল্যাণে। সেই তেল দিব্যি সুদৃশ্য বোতলে করে এসে গেছে খোলাবাজারে। রং সরিষার তেলের কাছাকাছি। দামেও সাশ্রয়ী। প্রায় সয়াবিন তেলের মতোই। মাত্রই বছর দুয়েক হলো এই ‘রাইস ব্রান অয়েল’ এসেছে বাজারে। দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে এই তেল প্রায় গোটা দশেক প্রতিষ্ঠানে। বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এর মধ্যেই ভোজ্যতেলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাজার চলে গেছে এই নব্য তেলের দখলে। সে কারণেই মনে হচ্ছে, এবার সত্যি বোধ হয়, তুষের তেল সয়াবিন তেলের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে যাচ্ছে। এমনকি অদূর ভবিষ্যতে এক নম্বর আসনটি দখল করে নেওয়ারও সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।
ভোজ্যতেলের বাজারে আরও দুই প্রকারের তেলের চল আছে। তবে সীমিত আকারে। সূর্যমুখীর তেল ও জলপাই তেল। এই দুটি তেল আসে বিদেশ থেকে। বাজারে চার থেকে ছয়টি প্রতিষ্ঠানের সূর্যমুখী তেল পাওয়া যায়। জলপাই তেলও আছে একাধিক প্রতিষ্ঠানের। এ দুটির দাম বেশ চড়া। স্বাস্থ্যসচেতন এবং সামর্থ্যবানেরাই এর খদ্দের।


দরদাম : (লিটারপ্রতি)

সরিষা ২০০-২২০ টাকা। সয়াবিন ১০০-১১২ টকা। রাইস ব্রান দেশি ১১৬-১২৪ টাকা, ভারতীয় ২৪০ টাকা। সূর্যমুখী ২২৪-২৪২ টাকা। জলপাই তেল ৩৫০-৭০০ টাকা।

দোষ–গুণ

সয়াবিন তেল আমরা দীর্ঘদিন থেকে খাচ্ছি। স্বাভাবিক তাপে তেমন ক্ষতি হয় না। তবে ভাজাপোড়ায় ব্যবহারের সময় তেলটি লম্বা সময় ধরে চড়া উত্তাপে গরম করলে এর যে “আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড” (অসম্পৃক্ত চর্বি) আছে, তা “ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিডে” পরিণত হয়। এটি অনেক সময় শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।’ রাইস ব্র্যান অয়েল নিয়ে সম্প্রতি যেসব গবেষণা হয়েছে, তাতে দেখা গেছে, এর ‘ফ্যাটি অ্যাসিড কম্পাউন্ড’ শরীরের জন্য বেশ ভালো। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ওজন বৃদ্ধি, ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমায়। পাকস্থলী ও কোলন ক্যানসার এবং হৃদ্রোগের প্রতিরোধক। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। তবে তেলটি প্রস্তুত করার সময় এটিকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় শোধন করা প্রয়োজন, নয়তো ক্ষতির কারণ হবে। খাঁটি পাওয়া গেলে সরিষার তেলও ভালো। তবে সব তেলের সেরা হলো জলপাই তেল। একেক তেলের একেক গুণ। তাই কোনোটিতে চিরস্থায়ী বাঁধা না পড়ে মাঝে মাঝে বদলে নিলে তা স্বাস্থ্যের জন্য যথার্থ উপকারী হবে।

* সয়াবিন তেল ভাজাপোড়ায় বেশি সময় ধরে তপ্ত না করাই ভাল|
* সরিষা তেলের ব্যবহার কমেছে। ঘানি ভাঙা খাঁটি সরিষার তেল এখন প্রায় দূর্লভ|
* বাজারে নতুন আসা ধানের তুষের তেল স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি। বাড়ায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা|
* দাম যদিও চড়া, তবে সবতেলের সেরা জলপাই তেল|
* সূর্যমুখীর তেল স্বাস্থ্যসম্মত, বাজারেও সুলভ|

অধ্যাপক নাজমা শাহীন, খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়