আমার মা রৌশন আরা

নোয়াখালী জেলা হানাদার পাকিস্তানিদের জন্য মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাসই ছিল অপ্রতিরোধ্য। ফেনী, ছাগলনাইয়া, বেলুনিয়াসহ বিস্তৃত এলাকা যুদ্ধের কোনো সময়ই বর্বর হানাদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসেনি। প্রতিনিয়ত তাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে মার খেতে হয়েছিল। যুদ্ধ জয়ের সব কৃতিত্ব সম্মুখসমরে যুদ্ধ করা সব মুক্তিযোদ্ধার। তবে তাঁদের আশ্রয়-প্রশ্রয়, খাবারদাবার, পোশাকসহ সব রকমের সহযোগিতা করে যুদ্ধ জয় সহজ করে দিয়েছিলেন এ দেশের সাধারণ মানুষ।

এ দেশের নারীরাও এ ক্ষেত্রে পিছপা ছিলেন না। এমনই এক নারী রৌশন আরার কথা বলছি। তিনি থাকতেন মাইজদী কোর্ট কাজী কলোনির পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের ৮৪৫ নম্বর বাসায়। তার পাশেই ছিল কলোনির পুলিশ ফাঁড়ি (বর্তমানে রুহুল আমিন উকিল সাহেবের বাড়ির সামনের পুকুরপাড়)। ২৬ মার্চ যুদ্ধ শুরু হলে নোয়াখালী ছিল মুক্তাঞ্চল। পুলিশের সদস্যরা পাকিস্তানপক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শুরু করেন ছাত্র-জনতারা প্রশিক্ষণ। রৌশন আরার বড় দুই ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে চট্টগ্রামে নিখোঁজ, ছোট দুই ছেলে স্থানীয় কোর্ট বিল্ডিং ময়দানে মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। আমি হ​লাম তাঁর সবচেয়ে ছোট ছে​েল।

শত শত প্রশিক্ষণার্থীর জন্য খাবার, পোশাক, থাকার জায়গার জোগান দেওয়া একটা বড় সমস্যা। এগিয়ে এলেন রৌশন আরার মতো নারীরা। রৌশন আরা নিজের দুই সন্তানের সঙ্গে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদেরও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন নিজের বাড়িতে।

৬ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মাইজদী দখল করে নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা শহর ছেড়ে গ্রামে অবস্থান নেন। কাজী কলোনির পুলিশ ফাঁড়ির ৪০ জন পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাও ফাঁড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিলেন। তবে যাওয়ার সময় তাঁদের সব পোশাক-আশাক, বাক্স-পেটরা, কিছু অস্ত্র-গোলাবারুদ গচ্ছিত রেখে গেলেন তাঁদের ‘মা’ রৌশন আরার কাছে। পাশে রেলস্টেশনে রাজাকার ক্যাম্প, যখন-তখন টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে, যেকোনোভাবে খবর ফাঁস হলেই মৃত্যু অবধারিত। দুঃখজনকভাবে তত দিনে রৌশন আরার মেয়ের জামাই মুক্তিযোদ্ধা কিবরিয়া উত্তরবঙ্গ চিনিকলে পাকিস্তানিদের হাতে শহীদ হয়েছেন।

রৌশন আরা সব কষ্ট বুকে চেপে রেখে পুরো যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সব মালামাল আগলে রাখেন নিজ বাড়ির ছাদে ও উঠোনে, মাটিচাপা দিয়ে। রাতের অন্ধকারে মুক্তিযোদ্ধারা আসতেন, নিজেদের জিনিসপত্র নিয়ে যেতেন।

মাইজদী শত্রুমুক্ত হয় ৭ ডিসেম্বর। তখনো রৌশন আরা বেঁচে ছিলেন। জীবিত পুলিশ সদস্যরা একে একে ফেরত এলেন বীরবেশে, অভিনন্দন জানালেন রৌশন আরাকে, ফেরত নিয়ে যান তাঁদের মালামাল। সেই পুলিশ সদস্যদের কেউ কেউ হয়তো এখনো বেঁচে আছেন।

রৌশন আরা স্বাধীন বাংলাদেশে বেশি দিন বেঁচে ছিলেন না, ১৯৮৩ সালের ১৬ এপ্রিল ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তিনি শায়িত আছেন পারিবারিক গোরস্তানে, পাশে তাঁর মেজো ছেলে মুক্তিযোদ্ধা আতোয়ার হোসেন। রৌশন আরাকে সহস্র সালাম।

আমি আমার মায়ের জন্য গর্বিত।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা এবং রৌশন আরার ছেলে