মেজবানে একদিন

মেজবানি খানায় শামিল সবাই। ছবি: সৌরভ দাশ
মেজবানি খানায় শামিল সবাই। ছবি: সৌরভ দাশ

ঝপাস করে শব্দ হলো একটা। তারপর সাদা ভাপে ভরে গেল চারপাশ। পেছন থেকে হইহই করে উঠল কেউ একজন, ‘সরেন। সরেন।’ কোন দিকে সরব। সামনে লাকড়ির চুলায় গনগনে আগুন। একযোগে রান্না হচ্ছে সারি সারি তামার পাতিলে। নিজের দৈর্ঘ্যের সমান একটা চামচ দিয়ে পাতিলে জোরসে আরেকটা নাড়ান দিলেন বাবুর্চি। তারপর বললেন, ‘জীবনে বহুত কষ্ট করছি, বুঝছেন। তারপর এই মেজবানি রান্না শিখছি। এখন কপাল ফিরছে। গরুর গোশ, নলা, সব রান্না পারি।’
দ্বিতীয় দফায় খানা পাকানো হচ্ছে মেজবানের। পাকঘরে যখন এই এলাহি কারবার, ওপরে তখন খাওয়াদাওয়া চলছে ধুমসে। বয়-বেয়ারারা ছুটছেন হাওয়ার বেগে। সাদা বাটি থেকে প্রায় উছলে পড়ছে ঘন ঝোল। মানুষের যেন খাওয়ার বিরাম নেই। একদল উঠছে তো আরেক দল বসছে। আর কে নেই সেই দলে। পাড়াতো চাচা-মামা, ভাইবোন, ময়মুরব্বি, গলির মোড়ের দোকানদার, অথবা নিছক ‘মুখচেনা’ লোকজন। আছেন একদম দ্বীনহীন গরিব মানুষও। কে কার পাশে বসল, কে পেল, কে পেল না, সেসব হিসাব-নিকাশ পরে। এ যেন শুধু ভোজের মহা আয়োজন।
বড়সড় হলঘরে ভোজ চলছে মহা সমারোহে। এক পাশে পর্দা দিয়ে ঘেরা, সেখানে নারীদের আলাদা খাওয়ার বন্দোবস্ত। হাত ধুতে বেসিন খুঁজতে যাওয়ার ঝামেলা নেই। বেয়ারা মেলামিনের বাটিতে পানি নিয়ে এসেছেন, সেখানেই হাত ধুয়ে নিন।

মেজবানের অন্যতম অনুষঙ্গ বড়সড় তামার পাতিলে রান্না
মেজবানের অন্যতম অনুষঙ্গ বড়সড় তামার পাতিলে রান্না

এককালে বাড়ির উঠোনের আয়োজন এখন চলে এসেছে পাড়াতো কমিউনিটি সেন্টারে। কিন্তু মেজবানের খাবার তালিকায় খুব পরিবর্তন আসেনি। গেটের কাছেই হাসিমুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন মো. হাসান। তিনি মেজবানের মূল আয়োজক। হুড়মুড় করে দাওয়াতিরা ঢুকছে। সবার সঙ্গে হাসিমুখে হাত মেলানোর কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। জানা গেল ২৭ ডিসেম্বর বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর এলাকা আসকার দিঘীর পাড়ের পাড়া-প্রতিবেশীকে নিয়ে এই মেজবানি আয়োজন।
কত লোক খাবে এখানে আনুমানিক? হাসান জানান, সন্ধ্যায় শুরু হয়েছে। অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ তো খাবেই। আর কিছু বলার আগেই তিনি আবার ছুটে গেলেন সামনের দিকে। আলোকচিত্রী সৌরভ দাশ ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে গেছেন। আমরা বসে আছি আমাদের পালার অপেক্ষায়। একজন বসে আছেন মাথায় লুঙ্গি পেঁচিয়ে। ষাটের ওপরে বয়স। খানিক পরপর জুলজুল করে তাকাচ্ছেন সামনে ছুটন্ত গরুর গোশত আর নলার ঝোলের বাটির দিকে।
—চাচা কি খাবেন?
—আল্লাহর হুকুম হইলে খাব।
রাত ১০টার দিকে খেতে বসার সুযোগ মিলল। হাতের ভিক্ষার থলেটা নিয়ে খানিকটা সংকোচ নিয়ে আমাদের পাশে এসে বসলেন বয়স্ক মানুষটা। আরেক দফা খাবার পর্ব শুরু হলো। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানের অন্যতম সৌন্দর্য সম্ভবত খানাপিনার বাড়াবাড়িতে নয়, এর সর্বজনীনতায়। মেজবান মানে, অন্যকে খাইয়ে তৃপ্তি পাওয়ার খুশি। মেজবান মানে, ধনী-গরিব সবাই একই মেন্যুতে খেতে পারা।

ঐতিহ্যের মেজবান
আশরাফ উল্লাহ, চট্টগ্রাম
মেজবানের রান্নার রয়েছে আলাদা বিশেষত্ব। মূল পদ গরুর মাংস হলেও এই মাংস রান্নার ধরন আলাদা। মসলাও ভিন্ন। শুধু তা-ই নয়, রান্নার ডেকচি থেকে শুরু করে চুলা পর্যন্ত আলাদা। এই কাজে দক্ষ চট্টগ্রামের বাবুর্চিরা। বংশপরম্পরায় তাঁরা এই ঐতিহ্যের ধারা অব্যাহত রেখেছেন। তবে চট্টগ্রামে কবে থেকে মেজবানের প্রচলন শুরু হয়েছে, তা সঠিকভাবে জানা যায়নি।

.
.

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের সাবেক কিউরেটর ও গবেষক শামসুল হোসাইন জানান, ‘মেজবান’ ফারসি শব্দ। হয়তো ‘মেজমান’ থেকে ‘মেজবানে’ রূপ নিয়েছে। ১৫০০ ও ১৬০০ শতাব্দীর প্রাচীন পুঁথি সাহিত্যে ‘মেজোয়ানি’ ও ‘মেজমান’ দুটি শব্দ পাওয়া যায়। মেজোয়ানি অর্থ আপ্যায়নকারী ও মেজমান অর্থ আপ্যায়ন। ১৫০০ শতকের কবি বিজয় গুপ্তের পদ্মপুরাণ কাব্যগ্রন্থে একটি পঙ্ক্তি আছে, ‘কাজীর মেজমান হইলে আগে করে আনে।’ আরেক কবি শাহ বারিদ খানের রচনায় ‘মেজোয়ানি’ শব্দটা পাওয়া যায়। আবার ১৬০০ শতাব্দীর সৈয়দ সুলতানের নবীবংশ কাব্যগ্রন্থে একটি লাইন রয়েছে, ‘ভালারূপ করিলা বিভার মেজোয়ানি।’ যা বোঝানো হয়েছে ভোজ অর্থে।
শামসুল হোসাইন বলেন, মেজবান চট্টগ্রামের মুসলমানদের একটি উৎসব। এর বিশেষত্ব খাবারে। খাবার তালিকায় থাকে, ভাত, গরুর মাংস ও নলা (গরুর পায়ের হাড় দিয়ে করা ঝোল-জাতীয় বিশেষ খাবার)। তা ছাড়া মাংসের ছাঁটছুট দিয়ে মুলা ও লাউয়ের এবং ডাল দিয়ে দুটি পদ থাকত। মাটির শানকিতে খাবার পরিবেশন করা ছিল অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মেজবানের আগে তা চট্টগ্রামের দেওয়ানহাটের একটি দোকান থেকে কিনে আনতে হতো। অবশ্য এখন পরিবেশনে আধুনিক অনুষঙ্গ যোগ হলেও খাবারের পদ একই রয়ে গেছে।