অকারণে মিথ্যা

প্রতীকী ছবি: সন্তান যখন মিথ্যা বললে তাকে অভিযুক্ত না করে অন্যভাবে বলা যেতে পারেছবি: প্রথম আলো

১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থী স্বচ্ছ। পড়ালেখায় ভালো। শান্তশিষ্ট। বন্ধুদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল ঘোরাঘুরি নিয়ে। স্বচ্ছ বলল, ছোটবেলায় সে বাবা–মায়ের সঙ্গে প্যারিস ঘুরতে গিয়েছিল। সেখানে আইফেল টাওয়ার দেখে এসেছে। সে তার প্যারিস ভ্রমণের সবকিছুর প্রায় খুঁটিনাটি বর্ণনা দিল বন্ধুদের কাছে। কয়েক মাস পর তার এক বন্ধুর মা স্বচ্ছর মায়ের কাছে ফোন করে কথায় কথায় প্যারিস ভ্রমণের বিষয় তুলতেই তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন! তিনি জানালেন, তাঁরা প্যারিস কেন, ইউরোপের কোনো দেশেই কখনো বেড়াতে যাননি, স্বচ্ছও যায়নি। কেবল এই একটি ঘটনাই নয়, স্বচ্ছ যেকোনো বিষয়ে অবলীলায় মিথ্যা বলে ফেলে।

স্বচ্ছর মতো অনেকে আছে, যারা বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে, যাতে কারও কোনো ক্ষতিও হয় না বা কারও কোনো লাভ হয় না। গবেষণার তথ্য বলছে, একজন মানুষ কারণে-অকারণে দৈনন্দিন গড়ে ১ দশমিক ৬৫টি মিথ্যা কথা বলে।

এই মিথ্যা বলার জন্য ব্যক্তি নিজের মধ্যে একধরনের অপ্রতিরোধ্য তাড়না অনুভব করে। বাধ্য হয়। কখনো এটি ইম্পালসিভ (তাড়নাগত) আবার কখনো হয়ে ওঠে কম্পালসিভ (বাধ্যতাধর্মী)। এই অকারণে মিথ্যা বলার অভ্যাসকে বলা হয় ‘প্যাথলজিক্যাল লাইয়িং’, অর্থাৎ বানিয়ে বানিয়ে কথা বলা। এই পরিস্থিতির আরেকটি নাম ‘মিথোম্যানিয়া’, অর্থাৎ বানিয়ে বানিয়ে, বাড়িয়ে বাড়িয়ে কথা বলা।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু সিরিজের বইয়ে জোজো চরিত্রটিতে আমরা এ ধরনের মিথ্যা আর বানিয়ে কথা বলার প্রবণতা দেখি। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মিসির আলির অমীমাংসিত রহস্য লেখায় লিখেছিলেন, ‘কারণে মিথ্যা বলার চেয়ে অকারণে মিথ্যা বলতে মানুষ বেশি পছন্দ করে।’

কেন অকারণে মিথ্যা

অকারণে মিথ্যা বলার সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ স্বভাবগতভাবে অকারণে মিথ্যা বলে। তবে পাসোর্নালিটি ডিজঅর্ডার, ইম্পালস কন্ট্রোল ডিজঅর্ডার, ওসিডি, ফ্যাক্টিসিয়াস ডিজঅর্ডার, ডিমেনশিয়া, মাদকাসক্তিসহ বেশ কিছু মানসিক সমস্যার লক্ষণ হিসেবে অকারণে মিথ্যা বলার প্রবণতা থাকতে পারে। যাদের আত্মবিশ্বাস কম, যারা নিজেদেরকে সামাজিক বৈষম্যের শিকার বলে মনে করে, যাদের প্যারেন্টিং ত্রুটিযুক্ত হয় এবং যাদের সামাজিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তাদের মধ্যে অকারণে মিথ্যা বলার প্রবণতা থাকতে পারে।

যারা অকারণে মিথ্যা বলে, তারা খুব ভালো ‘স্টোরিটেলার’। বলার সময় পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে মিথ্যার বর্ণনা দেয়। তারা কখনো সেই মিথ্যা ঘটনায় নিজেকে একজন নায়ক আবার কখনো ঘটনার শিকার হিসেবে পরিচিত করে। অনেক সময় তারা এই মিথ্যাকে নিজেরা শক্তভাবে বিশ্বাস করা শুরু করে। তারা খুব দ্রুত চিন্তা করতে পারে, তাদের কারও কারও মধ্যে সৃষ্টিশীল কাজ করার গুণও থাকে। এই অকারণে মিথ্যা বলার জন্য যে বলছে, তার পরিবারের সদস্যরা প্রায়ই বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। তবে মিথ্যাটি ধরা পড়ার পরও ব্যক্তি নিজের মধ্যে কোনো গ্লানি অনুভব করে না।

করণীয় কী

অকারণে মিথ্যা বলা ব্যক্তির প্রতি ক্ষুব্ধ হওয়া চলবে না। তার এই আচরণকে রোগের লক্ষণ হিসেবে মনে করতে হবে। সে মিথ্যা বলার বিষয়টি অস্বীকার করতে পারে, সে সময় তার সঙ্গে তর্ক করা চলবে না। বরং তার প্রতি সহানুভূতি দেখাতে হবে। তাকে নিয়ে হাসাহাসি বা বিদ্রূপ করা যাবে না। কেউ করলে সেটাকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। আবার সে যখন মিথ্যা বলছে, সেটা বুঝতে পেরেও তার মিথ্যাকে তাল দেওয়া যাবে না। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে হবে, যাতে সে মিথ্যা বলা থেকে দূরে চলে যায়। অকারণে মিথ্যা বলার পেছনে যদি কোনো মানসিক রোগ নির্ণিত হয়ে থাকে, তবে সেটির বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। সাইকোথেরাপি আর ওষুধ, দুটিরই প্রয়োজন হতে পারে।