অতিথি যেন আপদ না হন

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

মার্কিন পণ্ডিত বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন, ‘মাছ আর অতিথি তিন দিন পার হলেই গন্ধ ছড়াতে শুরু করে।’ বাঙালির বেলায় এমন কথা খাটে না। আর আমরা বলি ‘অতিথি ঘরের লক্ষ্মী’। অতিথির বিদায়বেলায় কখনো কখনো মুখ ভার করে ‘আর কটা দিন থেকে যান’ বলাই যেন রীতি। রীতি মেনে বিদায়ের সময় অতিথিও বলেন, ‘কষ্ট দিয়ে গেলাম ভাই।’

মুশকিল হলো, আতিথেয়তায় আমরা যতটা পটু, অতিথি হিসেবে ততখানি সুনাম আমাদের নেই। ভালো হতে গিয়ে কেউ কেউ ‘আপদ’ হিসেবে গণ্য হন। বাড়ির কর্তা তখন মিষ্টি হেসে মাছের মুড়োটা অতিথির পাতে তুলে দিয়ে মনে মনে বলেন, ‘খেয়েদেয়ে বিদেয় হলে বাঁচি!’

আতিথেয়তার যেমন আদবকেতা আছে, অতিথিরও কিন্তু কিছু বিষয় মাথায় রাখা উচিত। চাঁদপুরের শহীদুল ইসলামের (ছদ্মনাম) অবস্থাটা তুলে ধরলে বোধ হয় বুঝতে কিছুটা সুবিধা হবে। গত শুক্রবার মুঠোফোনে কথা হলো তাঁর সঙ্গে। দুঃখ করে বলছিলেন, ‘আমার আব্বারা সাত ভাইবোন। চাচা-ফুফুরা সবাই থাকেন ঢাকায়। বাড়িতে আমি, ছোট বোন, বাবা আর মা। ঢাকা থেকে আত্মীয়স্বজন বেড়াতে আসেন, আমাদের আনন্দই হয়। কিন্তু সমস্যা হলো, আব্বা অসুস্থ। আম্মারও বয়স হয়েছে। আত্মীয়স্বজন এলে আম্মার সারা দিন কাটে রান্নাঘরে। ফুপুরা তিন দিন থেকে গেলেন, পরের সপ্তাহে দেখা গেল ছেলেমেয়ে নিয়ে এক চাচা এসে হাজির। পরের সপ্তাহে অন্য কেউ। আম্মার আর বিশ্রাম হয় না। মুখে কিছু বলেন না। কিন্তু তাঁর কষ্টটা তো বুঝি। গ্রামে কাজের মানুষ পাওয়া যায় না, ধকলটা আম্মার ওপর দিয়েই যায়।’

এবার ঢাকার বাসিন্দা শারলিনের সমস্যাটা শুনুন। কদিন আগে বিয়ে করেছেন। দুজনের ছোট্ট সংসার। ‘যদি হয় স্বজন, তেঁতুল পাতায় নজন’—প্রবাদ মেনে দুই ঘরের ছোট্ট ফ্ল্যাটে অতিথিদের আপ্যায়ন করেন ঠিক। তবু মাঝেমধ্যে হিমশিম খেতে হয়। বলছিলেন, ‘বিয়ে, নতুন সংসার—সব মিলিয়ে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। আত্মীয়স্বজন এসে দীর্ঘদিন থাকলে সত্যি বলতে হিসাবে গন্ডগোল হয়ে যায়। মাসের শেষে কেউ এলে সবচেয়ে সমস্যা। তখন তো হাতে কিছু থাকে না। কী করব, বুঝে উঠতে পারি না।’

শারলিনদের মানিয়ে চলতে হবে, সেটা যেমন ঠিক তেমনি ‘বুঝে চলার’ দায়িত্ব খানিকটা অতিথিদেরও। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মেখলা সরকার মনে করেন, এই সংকটের সমাধান নির্ভর করে সম্পর্কের ওপর। আন্তরিকতা থাকলে সমস্যাগুলো সহজেই কাটিয়ে ওঠা যায়। তিনি বলেন, ‘সম্পর্ক ভালো হলে সরাসরি জিজ্ঞেস করে নেওয়া যেতে পারে। “আমি তো কয়েকটা দিন থাকব। তোমাদের সমস্যা হবে না তো?” বাড়ির কর্তা হয়তো মুখ ফুটে বলবেন না। কিন্তু অতিথি যে ব্যাপারটা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আছেন, সেটা তাঁকে মানসিক শান্তি দেবে।’

প্রতিটা পরিবারের নিজস্ব কিছু নিয়মকানুন থাকে। সকালে কী খাওয়া হবে, রাতে কখন সবাই ঘুমিয়ে পড়বে, কতটুকু ‘ভলিউমে’ টিভি দেখা হবে—অতিথির উচিত এই স্বাভাবিক নিয়মগুলোয় ব্যাঘাত না ঘটানো। সম্পর্ক আন্তরিক হলে ঘরের কাজে অতিথি আগ্রহ নিয়ে সাহায্য করতে পারেন। অনেক গৃহকর্ত্রী আবার রান্নাঘরে অতিথির ঢুকে পড়াটা পছন্দ করেন না, সেটাও মাথায় রাখতে হবে। এসব ছোটখাটো বিষয় বুঝেশুনে সাহায্যের হাত বাড়ানো উচিত। দিন শেষে ‘কষ্ট দিয়ে গেলাম ভাই’ যেন স্রেফ মুখের কথা না হয়। তবেই ‘আর কটা দিন থেকে যান’—অনুরোধ বাড়ির বাসিন্দাদের মনের কথা হবে।