অনন্য উচ্চতা

তুলনাটা কার সঙ্গে করব? কোনো মানুষের সঙ্গে অবশ্যই নয়। কারণ, ওঁর মাপের মানুষ, যাঁরা পাবলিক লাইফে রয়েছেন, তাঁদের সবার জীবনই প্রায় খোলা বই। জানি না, মানে অজানা, আগ্রহ প্রবল অথচ উত্তর নেই এমন উপকরণ সেসব বইয়ের দুই মলাটের মধ্যে খুঁজে পাওয়া কঠিন।
সে কী? তার মানে এই ছয় ফুট দুই ইঞ্চির মানুষটার অনেক কিছুই আমাদের জানা নেই? কিন্তু কী এমন অজানা থাকতে পারে? তাঁর পারিবারিক জীবন, মা-বাবা, নেহরু-গান্ধী পরিবারের সঙ্গে তাঁদের সখ্য, কলকাতায় যাওয়া, সেখান থেকে মুম্বাই এবং এই আজও বিনোদনের জগতের মুকুটহীন সম্রাট, যাঁর নাম অমিতাভ বচ্চন, তাঁর সম্পর্কে এখনো অনেক কিছুই অজানা আছে? আপনি বলছেন, ওঁর জীবনটা আর পাঁচজনের মতো বইয়ের খোলা পাতা নয়?

না নয়। কেন নয়, তা এক এক করে বলতে শুরু করলে অজানার একটা টিলা তৈরি হয়ে যাবে। তখন বিস্মিত হয়ে দেখতে হবে এবং অনুধাবনও হবে এই রকম, সত্যিই তো, এভাবে তো ভেবে দেখিনি?
আমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে ছিলাম। আমার দিকেও তাকিয়ে ছিলেন জাভেদ আখতার। তাঁর চোখে-মুখে কৌতুকের একটা আভা খেলা করছিল যেন। ভাবখানা এমন যে এই একটিমাত্র ক্ষেত্রে কেউই সবজান্তা নয়!
একটা সময় জাভেদ আখতার বলেছিলেন, অমিতকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখবেন তো কে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড? এইটা আপনার প্রথম পরীক্ষা। ইন্ডাস্ট্রির কারও নাম ও করে কি না, একটু দেখা যাক।
একদিন আমি জিজ্ঞেস করলাম। অমিতাভ বচ্চন তখনো বাজার থেকে চুল কেনার (এই কাহিনিটা পরে বলব) কথা ভাবেননি। কেননা, চুল কেনার প্রয়োজনই ছিল না। কপালের সামনের দিকটা, যেখান থেকে সিঁথিটা শুরু হয়, সেখানটা কিছুটা হালকা হালকা লাগে। তবে আহামরি চোখে লাগার মতো নয়। দিব্যি চলে যায়।
অমিতাভ সেই চুলে আঙুল বোলাতে বোলাতে বললেন, অনেকেই আমার বন্ধু। প্রায় সবাই।

আমি বলি, বন্ধুর কথা জানতে চাইনি। সে তো সেটে গিয়ে অন্যদের কাছে আমাকেও আপনি বন্ধু বলে পরিচয় দেন। অথচ খুব ভালোই জানি, আমি আপনার বন্ধু নই। আপনিও তা জানেন। আমি বড়জোর পরিচিতের চেয়ে কিছুটা বেশি হতে পারি। ওই ইংরেজিতে যাকে আ লিটল মোর দ্যান অ্যাকোয়েনট্যান্স বলে। যাকগে, আমি আপনার বেস্ট ফ্রেন্ডের নাম জানতে চাইছি।
অমিতাভ আমার চোখে চোখ ভাসিয়ে রাখলেন। সেই চোখে কোনো ভাষা নেই। মৃত মাছের ঘোলাটে চোখের মতো। দৃষ্টি স্থির। মাথার চুলে বিলি কাটা আঙুলগুলোও থমকে গেছে। এই দৃষ্টির মানে তত দিনে আমার জানা।
বেস্ট ফ্রেন্ড, বেস্ট ফ্রেন্ড, বেস্ট ফ্রেন্ড মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে অমিতাভ আমার দিকে চেয়ে থেকে থেকে চুপ হয়ে গেলেন। একটা সময় সেই স্বগতোক্তিও মিলিয়ে গেল। আমি বুঝে গেলাম, জাভেদসাবই ঠিক। বেস্ট ফ্রেন্ড সত্যিই থাকলে এতক্ষণ ঠিক নামটা বলে দিতেন। এতক্ষণ ধরে ভাবনার অবকাশ থাকত না। তাহলে? এর দুটি মানে হতে পারে। এক. হতে পারে বেস্ট ফ্রেন্ড আছে কিন্তু কোনো এক কারণে সেই নামোচ্চারণে তাঁর আপত্তি রয়েছে। দুই. বেস্ট ফ্রেন্ড সত্যিই নেই। তাই বানিয়ে বানিয়ে কোনো নাম বলতে পারছেন না।
আমি একটু হেসে বলি, মনে হয় ইন্ডাস্ট্রিতে বেস্ট ফ্রেন্ড বলে কিছু হয়তো হয় না। তাই কি?
অমিতাভ একটু চুপ থেকে বলেছিলেন, না, ঠিক তা নয়। বন্ধুত্বের অনেক রকমফের আছে। বন্ধু, স্টেডি বন্ধু, ভালো বন্ধু, উপকারী বন্ধু, প্রয়োজনের বন্ধু। বেস্ট ফ্রেন্ড যে তার মধ্যে এই সব কটা উপকরণই কিন্তু থাকতে হয়।

সে রকম কেউ তাহলে আপনার নেই?
অমিতাভ উসখুস করতে করতে বললেন, ওয়েল ইউ নো, দেয়ার আর সো মেনি হুম আই ট্রাস্ট...অ্যান্ড ডিপেন্ড...ইট ডাজ নট লুক গুড টু নেম এনিওয়ান অব দেম।
আমি মৃদু হেসেছিলাম। মনে মনে বলেছিলাম, উত্তরটা আমি পেয়ে গেছি। জাভেদসাব, আপনি এক শ ভাগ ঠিক।
জাভেদসাবের অবজারভেশনের কথাটা ওঁকে শুনিয়েছিলাম। বলেছিলাম, জাভেদ আখতার মনে করেন, ইন্ডাস্ট্রিতে কেউ আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড নন।
অমিতাভ শুনলেন। মন্তব্য করলেন না।
ওঁকে বললাম, জাভেদ আখতারের ধারণা, আপনার সবচেয়ে কাছের বন্ধু সম্ভবত আপনার ছোট ভাই অজিতাভ, যাঁর ডাক নাম বান্টি।
এবারও ছয় ফুট দুই কোনো মন্তব্য করলেন না। আমি কথা ঘোরাতে বাধ্য হয়েছিলাম।

অমিতাভ বচ্চন কেমন ধরনের মানুষ, এই প্রশ্ন আমাকে বারবার তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। জাভেদ আখতার বলার পর থেকে আমি অনেকবার ভেবেছি, সত্যিই তো, আমাদের প্রত্যেকেরই এমন একজন কি দুজন থাকে, যার বা যাদের কাছে আমরা নিজেদের উন্মুক্ত করি। যার কাছে সত্যি-মিথ্যে কনফেস করি। আনন্দ বা কষ্টের সময় প্রথমেই যে মুখটা মনে পড়ে। যার সঙ্গে কথা বললে বুকের চাপ কমে যায়। ভার নেমে যায়। হালকা লাগে। অথবা আনন্দটা বহুগুণ বেড়ে যায়। যার পরামর্শ নেওয়া যায়। যার ওপর ডিপেন্ড করা যায়। তাকেই হয়তো বেস্ট ফ্রেন্ড বলে। সেই ফ্রেন্ড পুরুষ হতে পারে, নারী হতে পারে, স্ত্রী হতে পারে, স্বামী হতে পারে, রক্তের সম্পর্ক থাকতে পারে, না–ও থাকতে পারে। অমিতাভর জীবনে যদি তেমন কেউ না থাকে তাহলে তিনি কী ধরনের মানুষ?
তবে অমন ধরনের সত্যিই কি কেউ নেই? থাকবে না, তা–ও কখনো হয় নাকি? কেউ কি কখনো এমন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বাঁচতে পারে? নাকি অবশ্যই আছে। আমরা শুধু জানি না। যদি থেকে থাকে অথচ তা আমরা জানি না, তাহলে সেটাও তো অজানার তালিকায় পড়ে যাচ্ছে! তাহলে তো জাভেদ আখতারই ঠিক? তিনিই তাহলে অমিতাভ বচ্চনকে ঠিকঠাকভাবে চিনে ফেলেছেন?
অনেকেই আবার জানতে চেয়েছেন, মানুষটা কী রকম বলো তো? শুনেছি খুব নাকি সেলফিশ আর কিপ্টে?

আমি উত্তরে বলতাম, কিপ্টে? কিপ্টে কি না বলতে পারব না। কারণ, আমি ওঁর কাছে কোনো দিন টাকা ধার চাইনি। অর্থ সাহায্যের আবেদনও জানাইনি। তবে হ্যাঁ, শুটিংয়ে যাওয়ার সময় ওঁর পকেটে কোনো দিন পার্স দেখিনি। থাকলেও তা বের করতে দেখিনি।
একদিন দুজনে ফিল্মিস্তান স্টুডিওতে যাচ্ছি। একটা জায়গায় ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি থেমেছে। অমিতাভকে দেখতাম সব সময় গাড়ির বাঁ দিকে বসতে। ডান পাশে একটা মাথার বালিশ। তার পাশের আসনে ডান দিকে আমি। দেখলাম, একজন ভিখারি অমিতাভের দিকের তোলা কাচে গাল ঠেকিয়ে হাত বাড়িয়ে তাকিয়ে আছে। চিনতে পেরেছে কি পারেনি জানি না, কিন্তু চাহনিতে ভিক্ষার প্রবল আরজি।
অমিতাভ স্পষ্ট বিড়ম্বিত। একবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন, একবার ওই মুখটার দিকে। পাঞ্জাবির পকেটে একবার হাত দিলেন। বুঝলাম, পার্সের খোঁজ করলেন। নেই। আমি দেব কি না জিজ্ঞেস করতেই গাড়ি ছেড়ে দিল। অমিতাভও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। গাড়িটা একটু এগোতে বললেন, আমি আগে আগে এমন লোকজনকে ভিক্ষে দিতাম। জয়া আবার ভিক্ষে দেওয়াটা একদম পছন্দ করত না। বারবার বলত, পারলে কাজের সুযোগ করে দাও। কিন্তু ভিক্ষে দিয়ো না। ভিখারিদের নাকি বিরাট সিন্ডিকেট রয়েছে।
কথাগুলো সাফাই দেওয়ার মতোই শোনাল। কিন্তু সেই কথার পিঠে আমি কোনো কথা বলিনি। ওঁর বিড়ম্বনার সাক্ষী হয়ে থাকলাম।

এ থেকে কি বোঝা যায় কিংবা বলা যায় মানুষটা কিপ্টে কি না? যাঁরা জানতে চেয়েছিলেন তাঁদের বলেছি, কিপ্টেমির কিছু আমি অন্তত দেখিনি। বুঝতেও পারিনি। তাই বলতে পারব না।
তবে উনি যে চ্যারিটি করেন, তার একটা হালকা প্রমাণ পেয়েছিলাম।
কলকাতার লেডিজ স্টাডি গ্রুপ একবার কোনো একটা অনুষ্ঠানে অমিতাভকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সংস্থাটা আমাকে ধরেছিল।
অমিতাভ রাজি হওয়ার কথাটা আমার মারফত জানিয়ে বলেছিলেন, একটি বেসরকারি সংস্থাকে তিনি অর্থ সাহায্য করেন। লেডিজ স্টাডি গ্রুপ যেন সেই সংস্থাকে কিছু ডোনেশন দেয়। টাকাটা সেই সংস্থার নামে অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক কেটে দিতে হবে। নগদে নয়।
কথাটা পাড়তে লেডিজ স্টাডি গ্রুপের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। বারবার আমাকে বলতে থাকে, একেবারে নতুন গোষ্ঠী। ফান্ড নিতান্তই কম। এবারটা অমিতাভ যেন মাফ করে দেন। পরেরবার নিশ্চয় তারা অর্থ সাহায্য করবে।
অমিতাভ আর কথা বাড়াননি। মুচকি হেসেছিলেন শুধু। বিনা পারিশ্রমিক ও বিনা অর্থ সাহায্যেই কলকাতায় ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। আমি সংস্থাটার নাম জানতে চেয়েছিলাম। অমিতাভ জানাননি। বলেছিলেন, এসব বিষয় তিনি গোপনই করতে ভালোবাসেন।
কিপ্টেরা কি কেউ চ্যারিটি করে? জানি না। বলতে পারব না। অমিতাভ কিপ্টে কি না, তার উত্তর আমার অজানা।
তাহলে উনি কি সেলফিশ?

আচ্ছা সেলফিশ মানে কী হতে পারে? নিজের ভালোমন্দ বুঝে নেওয়ার অর্থ কি সেলফিশ? তাহলে তো দুনিয়ায় সবাই সেলফিশ। অন্যদের আপদে-বিপদে সাহায্য করার মানে কি? সেলফিশনেসের সংজ্ঞাটাই বা কী? পারিপার্শ্বিক থেকে চোখ বুজে থাকা? আত্মকেন্দ্রিকতা? অমিতাভ তাহলে কেমন?
হিন্দি ফিল্মের বিখ্যাত কমেডিয়ান মেহমুদ আলির ভাই আনোয়ার একই সময় অমিতাভের সঙ্গে অভিনেতা হওয়ার লড়াই শুরু করেছিলেন। অমিতাভ চড়চড় করে এগিয়ে গেলেও আনোয়ার তেমন কিছু একটা করে উঠতে পারেননি। সেই আনোয়ারকে সাহায্য করতে অমিতাভ একটা সিনেমা প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে করে দিয়েছিলেন। ‘কালিয়া’।আনোয়ার বলেছিলেন, ওই একটি সিনেমা তাঁর জীবনের হিল্লে করে দিয়েছিল।
অমিতাভের হেয়ার ড্রেসার ছিলেন যিনি, তাঁকে সাহায্য করতেও তিনি তাঁর তৈরি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন।
মনোজ দেশাই ছিলেন অমিতাভ ফ্যানস ক্লাবের হর্তাকর্তা। তাঁর বড় সাধ ছিল একটা সিনেমা প্রযোজনা করবেন, যেখানে অমিতাভই হবেন এক থেকে এক শ। একদিন হতাশ হয়ে মনোজ আমাকে বললেন, কী করি বলুন তো? দা (অমিতাভকে ভাই বান্টি ‘দা’ বলে ডাকতেন। সেই দেখাদেখি আরও অনেকেই তাঁকে ‘দা’ সম্বোধন শুরু করেন। মানে বড় ভাই।) কথাটা কানেই তুলছেন না!
মনোজের কথা শুনে মনে হলো, ও বোধ হয় চাইছে আমি ওর হয়ে আরজিটা অমিতাভের কানে তুলি। একদিন বলে ফেলি। কথাটা শুনে অমিতাভ গম্ভীর হয়ে গেলেন। মনে হলো যেন একটু অসন্তুষ্টও। সারাটা দিন দুজনে সেটে কাটালাম। তেমন একটা বাক্যালাপ হলো না। রাতে হোটেলে ফেরার আগে শুধু বললেন, তোমার সঙ্গে পরিচয়ের আগে থেকেই কিন্তু আমি মনোজকে চিনি।

কথাটার মানে বুঝে আমি চুপ। বুঝলাম, আমাকে বলার মধ্য দিয়ে ওঁর সিনসিয়ারিটি নিয়ে মনোজ যে সন্দেহটা প্রকাশ করে ফেলেছে, অমিতাভের তা পছন্দ হয়নি। আমি তাই আর কথা বাড়ালাম না।
মাস কয়েক পর একদিন কী একটা ম্যাগাজিনে পড়লাম, মনোজ দেশাইয়ের প্রযোজনায় অমিতাভের নতুন সিনেমা ‘খুদা গাওয়া’র শুটিং শুরু হচ্ছে আফগানিস্তানে। পরিচালক মুকুল আনন্দ।
‘খুদা গাওয়া’ তাঁর ঝুলি এভাবে ভরিয়ে দেবে মনোজ কোনো দিন কি ভেবেছিলেন? অমিতাভকে তাহলে কী বিশেষণ দেব? সেলফিশ?
এই সেদিন ‘পিঙ্ক’ সিনেমার শুটিংয়ে দেখা। দিল্লিতে। সকালে ফোনে কথা হলো। বললেন, গুলমোহর পার্কে শুটিং করছেন। ওখানেই তাঁর ভ্যানিটি ভ্যান পার্ক করা থাকবে। যেন চলে আসি।
গেলাম। কী আশ্চর্য! তিরিশ বছর আগে প্রথম যেদিন অমিতাভের সঙ্গে দেখা ও কথা হয়েছিল, সেদিন যাঁকে তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী দেখেছিলাম, সেই প্রবীণকে দেখলাম যথারীতি ভ্যানিটির বাইরে বসে গুলতানি করছে। আমাকে দেখে সে গদগদ হয়ে পড়ল। অবাক আমি জিজ্ঞেস করি, কেমন আছ? প্রবীণ এক গাল হাসল ও ঘাড় হেলাল। শরীর ভালো তো? শুনে প্রবীণ পরনের জামাটা বুকের ওপর তুলে ধরে পেটে ইয়া বড় একটা কাটা দাগ দেখিয়ে বলল, মাঝে খুব ভুগলাম। এখন ভালো। স্যর না দেখলে মরেই যেতাম।
এরপর ওইটুকু সময়ের মধ্যে গড়গড় করে সে যা বলে গেল, তার অর্থ, চিকিৎসার পুরো খরচই শুধু অমিতাভ দেননি, সুস্থ হওয়া পর্যন্ত সবেতন ছুটিও দিয়েছিলেন এবং অন্য কাউকে প্রবীণের কাজে নিয়োগ করেননি। এই যে অন্য কাউকে নিয়োগ না করা, এটাই প্রবীণকে আপ্লুত করে দিয়েছে। ভ্যানিটিতে ঢোকার আগে প্রবীণ মোবাইলে ধরে রাখা ছবি খুলে দেখিয়ে বলেছিল, স্যারের দৌলতে মুম্বাইয়ে ফ্ল্যাটও হয়ে গেছে অনেক দিন। বেশির ভাগ টাকা স্যারই দিয়েছেন।
কী বলব? সেলফিশ?

দিল্লিতে গুলমোহর পার্কে সিনিয়র বচ্চনের তৈরি বাড়িটির নাম ‘সোপান’। এখনো দিল্লি এলে অমিতাভ-জয়ার ঠিকানা ওটাই। সেই বাড়ির কাজের মানুষেরা আজও অপরিবর্তিত। দিল্লিতে তাঁর গাড়ি যে চালাত, সেই ছেলেটার নাম সুনীল। অমিতাভের মতোই লম্বা। প্রথম যেদিন দেখেছিলাম, মনে হয়েছিল লম্বা হওয়াটাই বোধ হয় ওর চাকরি পাওয়ার ছাড়পত্র ছিল। ওকে বলেওছিলাম তা। সুনীল লজ্জা পেয়েছিল। একদিন বলেছিল, স্যার আমাকে প্রথম দিনই বলে দিয়েছিলেন, স্টিয়ারিংয়ে বসে যেন স্টেডি থাকি। মনে রাখতে বলেছিলেন আমি দমকলের ড্রাইভার নই। আর বলেছিলেন, কখনো যেন রেড লাইট জাম্প না করি।
দেখা হলেই সুনীল ‘নমস্তে’ বলে। এই সেদিন পার্লামেন্টে দেখা। ম্যাডাম, মানে জয়া বচ্চনকে নিয়ে এসেছে। জয়া রাজ্যসভায় ঢুকে গেছেন। আমি লোকসভায় যাব বলে হাঁটছি। আমাকে দেখে সুনীল এগিয়ে এল। চুলে পাক ধরেছে। হাসিটা যদিও একই রকম। কেমন আছ জিজ্ঞেস করতে বলল, ভালো আছি। সোপানের অন্যদের কথা জানতে চাইলাম। ও হেসে বলল, আমাদের এই বাড়িতে যে যেমন ছিল, তেমনই আছে। এ বাড়িতে কেউ রিটায়ার করে না!

কী বলব? সেলফিশ?
মিঠুন চক্রবর্তী অবশ্য বলেছিলেন। বলেছিলেন, উনি সেলফিশই শুধু নন, ইনসিকিয়র্ডও।
মিঠুন অবশ্য তখন রেগে ছিলেন। রেগে ছিলেন, কারণ, তাঁর বিশ্বাস, অমিতাভ নাকি পরিচালক মুকুল আনন্দকে বলে ‘অগ্নিপথ’ সিনেমায় তাঁর রোলটা কাটছাঁট করে দিয়েছেন।
সে কি? কেন? আমাকে অবাক হতে দেখে মিঠুন বলেছিলেন, আমি বেশি প্রমিনেন্সি পেলে ওঁর ফিল্মি ইমেজটা নাকি খাটো হয়ে যেত।
‘অগ্নিপথ’ রিলিজ হয় ১৯৯০ সালে। তার দুই বছর আগের সিনেমা ‘গঙ্গা যমুনা সরস্বতী’। সেখানেও অমিতাভ ও মিঠুনের যুগলবন্দী। মহীশুরে অমিতাভের সঙ্গে শুটিংয়ে গেছি। মিঠুনও হাজির। তখন কিন্তু অমিতাভকে নিয়ে মিঠুন গদগদ। অনেক ভালো ভালো কথা বলেছিলেন। দুই বছরের মধ্যেই অমিতাভ হয়ে গেলেন ভিলেন!
মিঠুনের অভিযোগটা একদিন বলেই ফেললাম। অমিতাভ একটু শুকনো হাসলেন। ‘অগ্নিপথ’ তত দিনে তাঁকে সেরা অভিনেতার প্রথম জাতীয় পুরস্কারটা এনে দিয়েছে। শুনে বললেন, মিঠুনটা চিরকালের পাগল। বড় ভালো মনের ছেলে। অনেক স্ট্রাগল করে এই জায়গাটায় ও পৌঁছেছে। জয়া ওকে খুব ভালোবাসে।
আমি ওঁর মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে ছিলাম। অবাক হয়ে ভাবলাম, যে লোকটা ওঁকে সেলফিশ মনে করছেন, অবলীলায় তিনি তাঁর প্রশংসা করছেন! আচ্ছা মানুষ তো!

‘পিঙ্ক’-এর শুটিংয়ের সময় ভ্যানিটিতে ঢুকে প্রথমেই বলেছিলাম, স্যার, আমাদের প্রথম আলাপের পর থেকে তিরিশটা বছর কোথা থেকে যেন কেটে গেল!
থার্টি ইয়ার্স! অমিতাভ ভুরু তুলে গোল গোল চোখে চাইলেন।
ইয়েস স্যার। থার্টি ইয়ার্স। সেই নাইন্টিন এইট্টি সিক্স। এলাহাবাদ ট্রিপ। দিল্লি থেকে বায়ুদূতের বিমানে এলাহাবাদ যাওয়া। টানা তিন দিন একসঙ্গে আপনার কন্সটিটিউয়েন্সি ঘোরা।
ঠিক বলেছ। বায়ুদূতের ইনাগুরাল ফ্লাইট। জার্নালিস্টদের ইনভাইট করেছিলাম। সময় কীভাবে কেটে যায়, তাই না?
সেদিন বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য ক্রিকেট নিয়ে, মাবিয়া আক্তারের কান্না নিয়ে, বাংলাদেশ যাওয়ার ইচ্ছে নিয়ে, সুন্দরবন দেখার বাসনা নিয়ে অমিতাভ অনেক কথা বলেছিলেন। প্রথম আলোয় সে কথা লিখেছিলাম।
বাড়ি ফিরে ভাবলাম, এই এতগুলো বছর কেটে গেল, এতবার মানুষটার সঙ্গে কাজে-অকাজে এত কথা হলো, এত ব্যক্তিগত কথা জানতেও চাইলাম, অথচ কয়েকটি বিষয় এখনো তো অজানাই থেকে গেল। হয় তিনি নিজের মতো করে এড়িয়ে গেছেন। নয় বুঝিয়ে দিয়েছেন এ নিয়ে তিনি কথা বলতে চান না।
আমি তো আমি, আচ্ছা আচ্ছা জার্নালিস্টরাও কেউ এ বিষয়গুলোয় বিন্দুমাত্র আলো ফেলতে পারেননি! একটা মন্তব্যও ছয় ফুট দুইকে দিয়ে কেউ করাতে পারেনি!
নিট রেজাল্ট, যে ঘেরাটোপের মধ্যে এতগুলো বছর নিজেকে আটকে রেখেছেন, সেখান থেকে নাকটাকেও তিনি বের করেননি।

আমরা তাই আজও তাঁর মুখ থেকে জানতে পারিনি, গান্ধী পরিবারের সঙ্গে তাঁর ঠিক কী হয়েছিল যে সম্পর্কটা একেবারে কাঠ কাঠ হয়ে গেল! কিংবা ‘বন্ধু’ অমর সিং কী করেছিলেন, যার জন্য বচ্চন পরিবারের দরজা তাঁর জন্য চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল! অথবা ‘কুলি’র দুর্ঘটনা না ঘটলে রেখার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা স্বাভাবিক পরিণতির দিকে এগিয়ে যেত কি না। এ কথাও আজ পর্যন্ত জানা গেল না, বফর্সের অপবাদের পরও অমিতাভ-অজিতাভ দুই ভাইয়ের যে জুটিকে রাম-লক্ষ্মণের মতো অবিচ্ছেদ্য মনে করা হতো, গত পনেরো বছর ধরে সেই অজিতাভ বড় ভাই থেকে কেন বিচ্ছিন্ন? অমিতাভের সঙ্গে কেন তাঁকে আর এক ফ্রেমে দেখা যায় না! কিংবা, এত ভালো অভিনেতা হয়েও পুত্র অভিষেকের ক্যারিয়ার গ্রাফ সাদামাটা হয়ে থাকাটা বাবা হিসেবে তাঁকে কতটা যন্ত্রণা দেয়। অথবা সমাজবাদী পার্টির টিকিটে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়ে জয়ার সরাসরি রাজনীতিতে ঢুকে পড়ার সিদ্ধান্তে তাঁর অনুমোদন ছিল কি না।
গান্ধী পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কহানির ব্যাপারটা আমি কিন্তু জানতে চেয়েছিলাম। সুসম্পর্ক যখন ছিল, তখন ইন্ডিয়ার ফার্স্ট ফ্যামিলি সম্পর্কে অমিতাভ কত কথা বলেছিলেন। ছাপার অক্ষরে বহু জায়গায় সেসব কথা প্রকাশও হয়েছে। কিন্তু, সম্পর্কহানি কেন, সে নিয়ে অমিতাভ আজও স্পিকটি নট।
আমি হলফ করে বলতে পারি, এই একই প্রশ্ন অমিতাভকে হয়তো আরও অনেকেই করেছেন। সবাইকে আশাহত হতে হয়েছে।

অমিতাভ আমাকে একটা যুক্তি অবশ্য দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, দেখো, পণ্ডিতজি, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, ইন্দিরাজি, রাজীব, সঞ্জয়, সোনিয়াজি প্রত্যেকের সঙ্গে আমার বাবা-মা বা আমাদের সম্পর্ক একেবারেই ব্যক্তিগত। এ সম্পর্কের বাইরের কেউ এই সম্পর্ক দ্বারা কোনোভাবেই প্রভাবিত নন। তাই এই সম্পর্ক বা রিলেশনশিপ কিছুতেই মিডিয়া বা আম-পাবলিকের লক্ষ্য হতে পারে না। প্রাইভেট সম্পর্ক প্রাইভেট থাকাই উচিত। পাবলিক করার প্রয়োজন কী?
অমিতাভ বলেছিলেন, এটা আমাদের শিক্ষার বিপরীত এবং রুচিবিরোধী।
জয়া বচ্চনের রাজনীতিতে প্রবেশের বিষয়টাও বারদুয়েক জানতে চেয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, এটা জানা জরুরি, কারণ রাজনীতির কালি মুখে লেপে যাওয়ার পর এই অমিতাভই পলিটিক্সকে গন্ধা নালার সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন, জীবনে আর কোনো দিন রাজনীতির সঙ্গে সংস্রব রাখবেন না। অথচ, জয়া সেই রাজনীতিকেই শুধু আঁকড়ে ধরলেন যে তা নয়, রীতিমতো সিরিয়াসলি তাতে মজে গেলেন। অমিতাভ সেই রাজনীতিক বউয়ের ঘর করছেন!
প্রশ্নটা অমিতাভ পছন্দ করেননি। বলেছিলেন, এটা বাজে ও অবান্তর প্রশ্ন। একটু ব্যাখ্যা দেওয়ারও চেষ্টা করেছিলেন এই বলে যে ওটা রাজ্যসভা। ডাইরেক্ট ইলেকশন নয়। এ কথাও বলেছিলেন, জয়া পলিটিক্যাল পারসন নন। ওঁর একটা উজ্জ্বল অতীত রয়েছে।

সেসব নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। বিস্ময় শুধু এটাই যে আপনি কেন বারণ করলেন না? বলতে তো পারতেন, যে রাজনীতি এতটা সম্মান কেড়ে নিয়েছে, সেই রাজনীতিতে যেয়ো না?
অমিতাভ বিতর্ক না বাড়িয়ে বলেছিলেন, ওটা জয়ার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।
আমরা কেউই কিন্তু আজও জানি না, কেন জয়া সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দিলেন, কেন অমিতাভ তাঁকে আটকালেন না।
কিংবা কী কারণে অমর সিংয়ের সঙ্গে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গেল! সেই অমর, যাঁকে একটা সময় অমিতাভ নিজের পরিবারের একজন বলে মনে করতেন! ভাইয়ের আসন পেতে দিয়েছিলেন!
অমর সিং দু-একবার ঠারেঠোরে কিছু একটা বলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অমিতাভ ছিলেন প্রতিক্রিয়াহীন।
কথার পিঠেই কথা বাড়ে। অমর প্রসঙ্গও অমিতাভ বাড়তে দেননি কথার পিঠে অনেক কথা উঠে আসতে পারে বলেই হয়তো। ঠিক ওই গান্ধী পরিবারের মতোই।

অজিতাভ বা বান্টির সঙ্গে অমিতাভের সম্পর্কটা অবশ্যই ছিল বন্ধুর মতো। বান্টি ছিল ‘দা’ অন্তঃপ্রাণ। ফিল্মফেয়ার ট্যালেন্ট হান্ট প্রতিযোগিতায় অমিতাভ যে ছবিগুলো পাঠিয়েছিলেন, সেগুলো ছিল বান্টিরই তোলা। কলকাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের ব্যাকড্রপে বক্স ক্যামেরায় ছবিগুলো তোলা হয়েছিল। এমন কিছু আহামরি ছবি সেগুলো ছিল না। কিন্তু বড় ভাইকে মুম্বাইতে পাঠাতে ও অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার তাগিদ ছোট ভাইয়ের মধ্যে কতটা তীব্র ছিল, প্রমাণ ছিল তার। ‘দা’কে নিরন্তর উৎসাহও দিত বান্টি। কলকাতার ওই রকম চমৎকার একটা চাকরি ছেড়ে হঠাৎই মুম্বাই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে বান্টির ক্রমাগত উসকানি (দা তুই পারবি। তোর মধ্যে ওই স্পার্কটা আছে) ছিল একটা প্রধান কারণ।
যখন লিখলাম ‘একটা প্রধান কারণ’, তার মানে অন্য আরও কিছু কারণও ছিল। সেটা যে ছিল তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু স্পষ্ট করে আজ পর্যন্ত কেউই তার উল্লেখ করেনি।
কেন করেনি? কারণ, সেটা ছিল একটা প্রেমের কাহিনি। কে জানে, হয়তো কিছুটা অনুচ্চারিত।
কলকাতায় অমিতাভ শখের থিয়েটার গ্রুপ ‘দ্য অ্যামেচার্স’-এ যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে আরও অনেকের সঙ্গে ছিলেন ভিক্টর ব্যানার্জি ও কিশোর ভিমানি। ভিক্টরকে আমরা সবাই চিনি অভিনেতা হিসেবে। দুই বাংলাতেই তিনি অতিপরিচিত। কিশোর ভিমানিও কম পরিচিত নন। এ উপমহাদেশের দিকপাল ক্রিকেট সাংবাদিক। কিশোরের স্ত্রী রীতাও অতিপরিচিত। করপোরেট কমিউনিকেশনসের জগতে রীতার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়।

‘দ্য অ্যামেচার্স’-এ যাঁরা অভিনয় করতেন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন, যাঁর মায়াজালে আবিষ্ট হয়েছিলেন অমিতাভ। সম্ভবত (সম্ভবত বলছি এই কারণে যে সেই সময়কার কেউই খুব একটা নিশ্চিত করে এই কথাটা আমাকে বলতে পারেননি) অমিতাভ তখনো জানতেন না, ভিক্টর ওই মায়াজালে আগেই আটকা পড়েছেন। অমিতাভ না জেনেই হয়তো একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। এটা জানাজানি হওয়ায় অমিতাভ-ভিক্টরের মধ্যে সম্ভবত (আবার সম্ভবত, কারণও সেই এক) একটা মন-কষাকষি হয়। সেটা ছিল অমিতাভের কাছে একটা বড় ধাক্কা। কারণ, (এবার আর সম্ভবত নয়, কেননা, দিল্লিতে কলেজ জীবনে তেমন একটা সিরিয়াস অ্যাফেয়ার অমিতাভের হয়েছিল বলে আজ পর্যন্ত কেউ দাবি করেনি) সেটাই ছিল অমিতাভের জীবনের প্রথম মায়াজাল!
এই ডুয়েলের কারণেই সম্ভবত কলকাতার ওপর থেকে অমিতাভের মন উড়ে গিয়েছিল। ভিক্টরের সঙ্গে তাঁর কথাও বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় একসঙ্গে অভিনয়ও। কার দিক থেকে এই রেষারেষি বেশি ছিল, তা আজ পর্যন্ত কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারেননি। তবে এটা সত্য, আজ পর্যন্ত কোনো সিনেমাতেই অমিতাভ ও ভিক্টরকে একসঙ্গে দেখা যায়নি।

কলকাতার এমন একটা ভালো চাকরি ছেড়ে অমিতাভ যে অনিশ্চিত মুম্বাইতে ঝাঁপ দেবেন এবং এমন একটা ব্যর্থ প্রেমের কারণে, কলকাতায় তাঁর সেই সময়কার সতীর্থরা কেউ ভাবতেও পারেননি। কেউ কেউ আমায় বলেছিলেন, তাঁদের মনে হয়েছিল, মারাত্মক একটা ভুল ছেলেটা করল। কেউ কেউ এ কথাও কবুল করেছিলেন, তাঁরা ভাবতেও পারেননি, ওই বাঁশের মতো ঢ্যাঙা, তে ধিরিঙ্গে ছেলেটা একটা দিন গোটা দেশের হার্টথ্রব হয়ে দাঁড়াবে। এমন একটা জায়গায় নিজেকে নিয়ে যাবে, যা কিনা সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। যার দিকে গোটা দুনিয়া জুলজুল চোখে তাকিয়ে থাকবে। যে কিনা হয়ে দাঁড়াবে সাফল্যের আলটিমেট প্রতীক!
অমিতাভকে আমি মায়াজালের এই প্রচারের কথাটা কিন্তু কখনো জিজ্ঞেস করিনি। ইচ্ছে করেই করিনি। কারণ, প্রথমত, বিষয়টি শালীনতার বেড়া টপকে যায়। প্রসঙ্গটা অমিতাভ এযাবৎ যখন কাউকে বলেননি, তখন বোঝাই যায় বিষয়টি তিনি পাঁচকান করতে চান না। তা ছাড়া ওই ঘটনার সঙ্গে আরও দুটি জীবন জড়িত। দ্বিতীয়ত, এটাও জানতাম, এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে হ্যাঁ বা না কোনোটাই তিনি বলবেন না। মানুষটার মানসিকতা কী রকম, তত দিনে অনেকটাই আমার জানা। কাজেই ওই মায়াজাল নিয়ে আমি বাড়তি সময় নষ্ট করিনি। আমাদের সংস্কৃতিও এসব প্রেম-ট্রেম নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। তা ছাড়া অমিতাভ সেই সময় এমন একটা উচ্চতা ছুঁয়ে ফেলেছিলেন, যেখানে এসব খুচরো মায়াজালের সত্যি সত্যিই কোনো দাম ছিল না। কিন্তু তবুও, এটা ছিল একজনের বড় হওয়ার পেছনে এক অন্য ধরনের অনুঘটক। কে বলতে পারে, মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে জীবনের সব পাওয়া পেয়ে গেলে আজকের অমিতাভকে ভারত পেত কি না?

অমিতাভ বচ্চন মানুষটাকে যতটা চিনতে পেরেছি, যতটা তাঁকে বিশ্লেষণ করেছি তাতে একটা বিষয় খুবই স্পষ্ট করে বলে দেওয়া যায়, উনি নিজেকে যতটা উন্মুক্ত করবেন, ততটাই আমরা দেখতে পাব। উদাহরণ হিসেবে উত্তর কোরিয়া ও চীনকে টানা যেতে পারে। উত্তর কোরিয়া নিজেকে নিশ্ছিদ্র ঘেরাটোপের মধ্যে রেখে দিয়েছে। সেখানে বহির্বিশ্বের আলোর প্রবেশ নিষিদ্ধ। চীন কিন্তু ধীরে ধীরে তার দরজা-জানালা খুলে দিয়েছে। তবে সেখানেও একটা বিষয় আছে। চীন ততটাই খুলেছে যতটা তারা খুলে দিতে চায়। দুনিয়াকে যা তারা দেখাতে চায় না, চেষ্টা করলেও তা আপনি দেখতে পাবেন না।
অমিতাভও ঠিক চীনের মতো। তাঁর জীবনে অনেকগুলো কম্পার্টমেন্ট বা কুলুঙ্গি। সেই কম্পার্টমেন্টগুলোর কোনো কোনোটার দরজা-জানালা খোলা, কোনো কোনোটায় তিনি আলো-হাওয়া একেবারেই ঢুকতে দিতে চান না। সেখানে উঁকি মারার অধিকার কারও নেই। আপনি জানতে চাইলে উনি এমনভাবে হুঁ হাঁ করবেন যে পরের প্রশ্ন করার আগ্রহই হারিয়ে যাবে।
কলকাতার মায়াজাল, গান্ধী পরিবার, অমর সিং, জয়ার রাজনীতি, পুত্রের ক্যারিয়ারজনিত আক্ষেপ বা এমন ধরনের বেশ কিছু জিজ্ঞাসা একেকটা কম্পার্টমেন্ট। এমনই একটা স্বতন্ত্র কম্পার্টমেন্টের গায়ে ‘রেখা’ নামটি লেখা রয়েছে।

অথচ রেখার সঙ্গে তাঁর প্রেম-কাহিনি অজানা কিছু নয়। যে গতিতে সেই প্রেম এগিয়ে চলছিল, তাতে একটা সময় প্রমাদ গনেছিলেন জয়াও। সেই সময় একটা ফিল্মি ম্যাগাজিন জয়াকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেছিল। বিরক্ত জয়া একটিমাত্র বাক্যে মোক্ষম উত্তরটা দিয়েছিলেন। আমি ভিকট্রি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে রয়েছি। কে দ্বিতীয়, কেই বা তৃতীয় আমার কাছে তা অবান্তর।
বলেছিলেন বটে, কিন্তু টলিউডের কাহিনি অনুযায়ী, রেখা তাঁর রাতের ঘুম উড়ে কেড়ে নিয়েছিলেন।
ওই সময়েই ‘কুলি’র অ্যাকসিডেন্ট এবং জীবন-মৃত্যুর সেই ধুন্ধুমার লড়াই। ঈশ্বরের সন্তান যমরাজার দরজা থেকে ফিরে মৃত্যুকে টা টা করেছিলেন। এই বেঁচে ফেরা, ওই অসহনীয় দিনগুলোতে তাঁর সুস্থতার জন্য পরিবারের আকুলতা, স্বামীর জন্য জয়ার কৃচ্ছ্রসাধন এবং গোটা দেশের মানুষের অসীম নির্ভেজাল ভালোবাসা অমিতাভের মনে অন্য এক উপলব্ধি এনে দেয়। সেই উপলব্ধির পাশাপাশি নতুন এক বোধোদয় অমিতাভের মানসিকতাকে এক ভিন্ন খাতে টেনে নিয়ে যায়। পারিবারিক তিনি শুরু থেকেই ছিলেন, নতুন জীবন তাঁকে পরিবারের মূল্যবোধগুলো চিনিয়ে দেয়। যত সুস্থ তিনি হতে থাকেন, ততই দূরে সরে যান রেখা। অমিতাভ বুঝতে পারেন, এই পারিবারিক ও মূল্যবোধের জন্যই তিনি মানুষের এত কাছের। এতখানি ভালোবাসার। এতটা আদৃত।
রেখাকে তিনি অস্বীকার করেননি। রেখাকে তিনি গ্রহণও করেননি। রেখার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আজ পর্যন্ত কারও কাছে একটা কথাও তিনি বলেননি। আজ এমন একটা উচ্চতায় তিনি নিজেকে তুলে দিয়েছেন, যেখানে এসব ‘অপছন্দের’ বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার ধৃষ্টতা দেখানোর সাহসও কেউ অর্জন করতে পারবে না। ‘পিঙ্ক’-এ তাঁর মুখের ডায়লগটা মনে আছে কি? নো মিনস নো? নিজের বিষয়েও যেটাতে তিনি ‘নো’ বলবেন, সেটা নো-ই।

কী রকম ‘নো’, তার একটা উদাহরণ এই অবসরে দেওয়া যেতে পারে। ওই যে লেখার শুরুতে চুল কেনার একটা প্রসঙ্গ তুলেছিলাম? সেই কাহিনিটা এবার শোনাই।
অমিতাভ খুব কম সিনেমায় পরচুল পরেছেন। ‘শাহেনশা’ সিনেমাটার কথা মনে আছে তো? সেখানে তিনি দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। একটা ঘুষখোর পুলিশ অফিসার, অন্যটা ‘শাহেনশা’র ভূমিকায়, যে কিনা দুষ্টের দমন করে। শাহেনশার ভূমিকায় তাঁর কস্টিউমটা ছিল দেখার মতো। চুলের ঝাপটায় একটা চোখ ঢাকা। হাতের বর্মে লাগলে গুলি ঠিকরে যায়। সেটা ছিল একটা অন্য ধরনের লুক।
‘শাহেনশা’ ছিল অমিতাভর কামব্যাক ফিল্ম। প্রায় দুই বছর কোনো কাজ না করার পর ওই সিনেমা দিয়ে তাঁর মারমার কাটকাট প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল।
তখনো কিন্তু তাঁর মাথা হালকা হয়নি।
মাথাটা যখন হালকা হতে শুরু করে, সেই সময়ই তাঁর পরচুল লাগানোর সিদ্ধান্ত। ‘ইন্দ্রজিৎ’ নামে একটা সিনেমা করেছিলেন তিনি। তাতে পরচুল লাগিয়েছিলেন। যে ধাঁচে তিনি চুল আঁচড়াতেন, অনেকটা সেই রকমই ছিল উইগটা। জয়ার সেটা মোটেই পছন্দ হয়নি। আমাকে সে কথাটা নিজেই বলেছিলেন ছবির রাশ দেখতে দেখতে।
আমি বলেছিলাম, উইগ পরার দরকারটা কী? অমিতাভ উসখুস করে বলেছিলেন, আরে বয়স হচ্ছে না? চুলও তো পাতলা হয়ে যাচ্ছে। ক্যামেরা কিছু ছাড়ে না বুঝলে?
এই নব্বইয়ের দশকের কয়েকটা সিনেমার কথা মনে করুন। ‘মৃত্যুদাতা’, ‘বড়ে মিয়া ছোটে মিয়া’, ‘লাল বাদশা’, ‘মেজর সাব’, ‘সূর্যবংশ’, ‘হিন্দুস্তান কি কসম’। সব কটিই প্রায় অতি সাধারণ সিনেমা। মাথার সামনের দিকটা খালি খালি, গ্ল্যামারলেস। একে বয়সের স্পষ্ট ছাপ, অন্যদিকে সেই অ্যাংরি ইয়ংম্যানের ইমেজ ধরে রাখার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। লোকে নিতে চায়নি। একটা সিনেমাও চলল না।
এই সময়েই নিজেকে নিয়ে অমিতাভের নতুন ভাবনা শুরু। উনি বুঝে গেলেন, চেহারায় বদল ঘটাতে হবে। নতুনভাবে নতুন ঢঙে ফিরে আসতে হবে। হিরো হয়ে নায়িকার সঙ্গে আগের মতো নাচানাচির দিন শেষ হতে চলেছে।

এই ভাবনার মধ্যেই একদিন সোজা চলে গেলেন যশ চোপড়ার বাড়ি। বিন্দুমাত্র ভণিতা না করে বললেন, যশজি, আমার হাতে কোনো কাজ নেই। আমি কাজ চাইতে এসেছি। আমায় কাজ দিন।
যশ চোপড়া হতবাক! কাজ চাইছে অমিতাভ বচ্চন? যাকে নিয়ে ১৯৭৬-এ তাঁরই করা ‘কভি কভি’। তারপর ১৯৭৯তে ‘কালা পাত্থর’, ১৯৮১তে ‘সিলসিলা’! সেদিন যশ চোপড়া-অমিতাভ অনেক কথা হয়েছিল। যশ তাঁকে ফেরাননি। ২০০০ সালে যশরাজ ফিল্মসের ‘মোহাব্বতে’ নিউ লুক অমিতাভকে এনে দিল। বয়সের সঙ্গে মানানসই। মাথায় মানানসই উইগ।
ওই বছরেই তাঁর টেলিভিশনে ঢুকে যাওয়া। ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ এনে দিল এক নতুন পরিচিতি।
পরের বছর করণ জোহরের ‘কভি খুশি কভি গম’ নতুন অমিতাভের স্থান নতুন প্রজন্মের কাছে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করে দেয়।
মাথা ভর্তি নতুন চুলের নতুন উইগ। একটার পর একটা সিনেমা এসেছে। উইগে কালোর সঙ্গে সোনালি আভাও জায়গা করে নিয়েছে। সেটা উইগ নাকি নতুন প্রযুক্তির ‘হেয়ার উইভিং’ বুঝতাম না। জিজ্ঞাসাটা ছিল।
এক দিন দিল্লিতে একটা বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে দেখা। অমর সিংয়ের সঙ্গে অমিতাভ এসেছিলেন। অমর সিং তখন অমিতাভের ‘পরিবারের সদস্য’। যেন দ্বিতীয় ভাই। যেখানেই যান অমর দোসর। অমর সিংয়ের কাছে সেদিন চুপিচুপি অমিতাভের চুল নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম। অমর হাসতে হাসতে বলেছিলেন, অনেক নারীকে আমি চিনি, যাঁরা সকালে ঘুম ঘুম চোখে বালিশের পাশে রাখা লিপস্টিক হাতড়ান। অমিতজিও তেমনই। ঘুম ভাঙা মাত্র প্রথম কাজ মাথা সামলানো।
অমর সিং ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির রেশ রেখে সরে গিয়েছিলেন।
‘বুড্ঢা হোগা তেরা বাপ’ সিনেমা রিলিজের আগে দিল্লি ও কলকাতায় অমিতাভের সঙ্গে খানিকটা সময় নিছক আড্ডা মারার সুযোগ হয়েছিল। সেই সময় কথায় কথায় চুল প্রসঙ্গ তুলেছিলাম। উইগ না হেয়ার উইভিং জানার চেষ্টা করেছিলাম। অমিতাভ আগ্রহকে আমলই দিলেন না। গম্ভীর মুখে আলগোছে শুধু বললেন, হোয়েন ইউ নিড সামথিং হোয়াট ডু ইউ ডু? ইউ বাই! হোয়েন আই নিড সামথিং আই অলসো ম্যানেজ টু গেট।
একবারের জন্যও সত্যিটা কী তা জানালেন না!
এসব ভালোমন্দ নিয়েই অমিতাভ। মন্দর চেয়ে ভালো অবশ্যই বেশি, না হলে এত মানুষের চোখের মণি হিসেবে এত দিন ধরে কেই বা কবে টিকে থেকেছেন? কেই বা ধরে রাখতে পেরেছেন নিজের প্রতি আপামর জনতার অপার আগ্রহ? শ্রদ্ধার আসন?
আমি বলেছিলাম, আপনি ঈশ্বরের সন্তান।
কথাটা শুনে ওঁর ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি যেন খেলে গিয়েছিল।
পরক্ষণেই বলেছিলাম, এটা আমার কথা নয়। কথাটা আমাকে বলেছিলেন রেখাজি।
শুনে অমিতাভের মুখে কোনো প্রতিক্রিয়ার সন্ধান পাইনি।
ওঁর চরিত্রের এটা একটা অদ্ভুত দিক। ঠিক শামুকের মতো। সামান্যতম বিপদের গন্ধ পেলে শামুক শক্ত খোলের মধ্যে গুটিয়ে যায়। সামান্যতম বিতর্কের আঁচ পেলে অমিতাভও ঠিক সেভাবে সতর্ক হয়ে পড়েন। নিজেকে গুটিয়ে নেন। কোনো প্ররোচনা, কোনো প্রলোভনেই তাঁকে আর টলানো যায় না।
এতটাই সাবধানী তিনি। এতটাই। কোনো বিতর্কে কেউ তাঁকে কোনো দিন টেনে আনতে পারেনি। নিজের চারদিকে নিজেরই কেটে দেওয়া গণ্ডির বাইরে আজ পর্যন্ত তিনি পা বাড়াননি।
যে অপরাধে কেউ কেউ যাবজ্জীবন জেলে পচছে, রিচ অ্যান্ড পাওয়ারফুল বলে সে ধরনের অপরাধে সঞ্জয় দত্তর নামমাত্র জেল হলে সামাজিক মাধ্যম মারফত দেশে চিল চিৎকার ছড়িয়ে পড়ল। ফিল্ম ফ্র্যাটারনিটির সহানুভূতি চুইয়ে চুইয়ে পড়তে লাগল সঞ্জয়ের জন্য। কেন এই অকারণ সহানুভূতি? সঞ্জয়কে ভালো মানুষ প্রমাণের চেষ্টা?
অমিতাভ মুখে কুলুপ এঁটে রইলেন না, ঠিকই কিন্তু টুকরোটাকরা যে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন, তা যুক্তিগ্রাহ্য ও গ্রহণযোগ্য বলে মনে হলো না।
সালমান খানও রিচ অ্যান্ড পাওয়ারফুল। হিট অ্যান্ড রান মামলায় তাঁর প্রতিও ফিল্মি বেরাদরির বেনজির সহানুভূতি উথলে উঠল! মারাত্মক ধরনের অপরাধে কেন সহানুভূতি পাবেন, সেই প্রশ্ন উঠল। অমিতাভ চুপ। হিন্দুত্ববাদীদের দাপাদাপির বিরুদ্ধেও তিনি নির্বাক। কেন তিনি চুপ, তার উত্তরও পাওয়া যায় না। কে কী খাবে বা কে কী পরবে, রাষ্ট্র তা ঠিক করে দিতে পারে কি না, এই বিতর্কেও তাঁর কোনো মতামত নেই। কেন তিনি ‘বুচার অব গুজরাট’-এর কথায় সেই রাজ্যের পর্যটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হলেন, তার জবাবদিহিও শোনা গেল না। পাকিস্তানকে সবক শেখাতে পাকিস্তানি শিল্পীদের হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে পাততাড়ি গোটানোর নির্দেশ দেওয়া তাঁকে বিচলিত করে না। কেন তিনি চুপ, কেন সর্বত্র সাবধানী, কেন এই শামুক-চরিত্র, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে লাগল। অথচ কোনো সমালোচনাই তাঁর মুখ খোলাতে পারল না। শেষ পর্যন্ত এক টিভি ইন্টারভিউয়ে নিজেকে খোলাসা করলেন অমিতাভ।
সেই বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল কি না জানি না, আমার কাছে দুর্বল যুক্তি বলে মনে হয়েছিল।
ক্রমাগত চাপের মুখে তিনি বলেছিলেন, হ্যাঁ, আমি সাবধানী। হ্যাঁ, আমি কোনো বিতর্কেই কোনো অবস্থান নিই না। নিতেই হবে এমন মাথার দিব্যিও কেউ দেয়নি। আমি আমার মতো। আমি সাবধানী। জীবন আমাকে এই রকম সাবধানী হতে শিখিয়েছে।
কীভাবে শিখিয়েছে? কবে থেকে শিখিয়েছে?

অমিতাভের স্বীকারোক্তি, বোফর্স বিতর্ক। জীবন কত নিষ্ঠুর, আমি কতখানি ভঙ্গুর, রাজনীতিতে না ঢুকলে আমি তা জানতাম না। বোফর্স বিতর্ক আমার চোখ খুলে দিয়েছে। পলিটিক্যাল পাওয়ারফুল মানুষজন আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন। সেই রণাঙ্গনে আমি একা। আমার পাশে কেউ নেই। আমি দেখছি, খাপ থেকে তলোয়ার বেরিয়ে এসেছে। হিস হুস শব্দ করে তা আমাকে ক্ষতবিক্ষত করছে। অথচ আমাকে একাই লড়তে হচ্ছে আমার লড়াই! একজন প্রতিদিন নিয়ম করে একটি খবরের কাগজে আমায় প্রশ্ন করতে লাগলেন। একদিন আমি ঠিকানা জোগাড় করে সেই মানুষটির বাড়ি গেলাম। গিয়ে বললাম, আমি অমিতাভ বচ্চন। আপনি আমায় এত এত প্রশ্ন করেছেন, করেই চলেছেন। আজ আপনার প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিতে আপনারই বাড়ি এসেছি। সেদিন সেই মানুষটিকে সন্তুষ্ট করে বাড়ি ফিরেছিলাম। কিন্তু এভাবে কতজনকে সন্তুষ্ট করা যায়? একটা সময় আমি অসহায় বোধ করতাম। নিজের লড়াই নিজেই লড়ে যেদিন নিজেকে নির্দোষ প্রতিপন্ন করলাম, সেদিনটা ছিল বড় তৃপ্তির। বোফর্স বিতর্কই আমাকে শিখিয়েছে রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক শক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে কোনো রকম টক্করে না যেতে। জীবন আমাকে বারবার বলেছে, স্রেফ নিজের কাজটুকু করে যাও। আমি জানি, আমার জীবন কতটা ভঙ্গুর। আমি তাই সাহস দেখাতে পারি না। আমি তাই পক্ষ নিতে পারি না। যাঁরা পারেন তাঁরা পারেন। আমি পারি না। আমি পরিবারের সঙ্গে শান্তিতে থাকতে চাই।
তা যতই আপনার প্রতিবেশী অশান্তিতে থাকুক? অসহিষ্ণুতা মাথাচাড়া দিক?
হ্যাঁ। গরু নিয়ে বাড়াবাড়ি হলেও নয়। মানুষের প্রাণ গেলেও নয়। বাক্স্বাধীনতা লুট হয়ে গেলেও নয়। অমিতাভ বচ্চন কখনোই আমির খান হতে পারবেন না। হতে চানও না।
তিনি শুধু কাজ করে যেতে চান। ছুটি নয়। বিশ্রাম নয়। এই বয়সে পৌঁছে একটা কাজও হারাতে চান না! কেন যেন তাঁর খালি মনে হয়, বসে গেলেই তিনি শেষ হয়ে যাবেন!
অদ্ভুত একটা ধারণা আজ অনেক দিন ধরেই তাঁকে গ্রাস করে রেখেছে। পাওয়ারফুলদের সঙ্গে টক্কর দিতে গেলে কেন যেন আশঙ্কা, তিনি কর্মহীন হয়ে পড়বেন। কর্মহীন হলে তিনি জবুথবু হয়ে যাবেন। জবুথবু হয়ে যাওয়ার সঙ্গে মৃত্যুর কোনো পার্থক্য আছে বলে তিনি মনে করেন না।
এ এক অদ্ভুত মানসিকতা। এর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও রয়েছে।
এই মানসিকতায় ঘুরপাক খায় অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যাওয়ার ভয়। এলেবেলে হয়ে যাওয়ার ভয়। বসে যাওয়ার ভয়। করুণার পাত্র হওয়ার ভয়। সে জন্য একটার পর একটা কাজ পাওয়ার আশায় তিনি নিজেকে তৈরি রাখতে ভালোবাসেন। গ্লাভস খুলে রিংয়ের বাইরে চলে যেতে চান না। বরং তিনি চান, শুটিং করতে করতে যদি চিরতরে চলে যেতে পারেন, মনে করবেন, ঈশ্বর তাঁর প্রতি সদয়।
ইতিহাসে লেখা থাকবে, হি ডায়েড ইন হার্নেস।
রাজেশ খান্নার জীবন তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। সুপারস্টারের অর্থ কী, রাজেশই তার সংজ্ঞা। স্টারডম কী বস্তু, রাজেশকে না দেখলে অমিতাভ জানতেন না। আমাকে বলেছিলেন, উফ, সে কী উন্মাদনা! রাজেশ খান্নার ক্রেজ দেখে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। ফ্যানরা তো পাগলামি করবেই, কিন্তু প্রযোজক, পরিচালক, পরিদর্শক ও ফিল্ম ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত তাবৎ মানুষেরা রাজেশ খান্নার কৃপাধন্য হওয়ার জন্য জীবনপণ করে থাকবেন, এটা আমি ওঁকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। হৃষিদাকে (হৃষিকেশ মুখার্জি) বলেছিলাম, রাজেশ খান্নার সঙ্গে আমি কাজ করব? সত্যি বলছেন হৃষিদা?
হৃষিকেশ মুখার্জি শুনে হেসে মাথা হেলিয়েছিলেন।
সেই রাজেশ খান্নাই একদিন হৃষিকেশকে বলেছিলেন, আমার মৃত্যুটা কিন্তু আপনি বদলাবেন না।
এটা ছিল ‘আনন্দ’-এর সময়। অথচ ‘নমক হারাম’-এ হৃষিদার কাছে এই অমিতাভই অনুযোগ করেছিলেন, আপনি সব সময় রাজেশজির কোলে ঝোল টানেন। ওঁকে মেরে ফেলে পুরো সহানুভূতি ওর দিকে ঢেলে দেন।
সেই রাজেশ খান্নাকে সিন থেকে পুরো আউট করে দিলেন অমিতাভ! অনুশাসিত জীবনকে বাই বাই করে চলে আসা রাজেশ আর ঘুরে দাঁড়াতে পারলেন না! সুপারস্টারডমের মনগড়া ঘেরাটোপে স্তাবক পরিবৃত থেকে একসময় পরিত্যক্ত ও নির্বান্ধব হয়ে নির্জন মৃত্যুর প্রতীক্ষায় তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন!
তখন তিনি একা। স্ত্রী, কন্যা দ্বারা পরিত্যক্ত। সে ছিল এক দুঃসহ জীবন।
রাজেশ খান্নার জীবন থেকে অমিতাভ জীবনের শিক্ষা নিয়েছিলেন। এই যে বারবার তিনি বলেন, এক নম্বর দুই নম্বরে তাঁর কোনো বিশ্বাস নেই, তিনি শুধু কাজ করে যেতে চান, বিনয় নয়, এটা তাঁর বোধোদয়। এই বোধোদয় একান্তই আন্তরিক। এই উপলব্ধিতে কোনো ভেজাল নেই।
অমিতাভ বচ্চন ঈশ্বরের কাছে প্রতিদিন প্রার্থনা করেন, তাঁর পরিণতি যেন রাজেশ খান্নার মতো না হয়। একাকী, নির্বান্ধব, স্ত্রী-সংসার-পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তিনি বাঁচতে চান না। চান না, জনতার মন থেকে হারিয়ে যেতে। শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তাঁর নিজের শর্তে বেঁচে থাকতে চান। রাত তাই যত গভীরই হোক, নিজস্ব ব্লগে এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলির জন্য দুলাইন লিখতে তিনি ভোলেন না।
একদিন বলেছিলেন, শশীজিকে দেখলে বড় কষ্ট পাই। চোখের জল ধরে রাখতে পারি না।
শশীজি। শশী কাপুর। এই মানুষটাই একদিন তাঁকে শিখিয়েছিলেন, চোখে পড়ার জন্য ভিড়ের মুখ হয়ে যেয়ো না।
সেটা ছিল অমিতাভের স্ট্রাগলিং পিরিয়ড। টাকার টানাটানি। অভিনয়ের সুযোগ পাওয়ার জন্য প্রতিদিন চরকির মতো এ-স্টুডিও থেকে ও-স্টুডিও ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পরের দিনের থাকা-খাওয়ার টাকা রোজগারের সে এক প্রাণান্ত প্রচেষ্টা।
একদিন কেউ একজন বলেছিল ক্রাউড হয়ে যেতে। ভিড়ের দৃশ্য ছিল একটা। দাঁড়ালেই এক শ টাকা। অমিতাভ দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন।
দাঁড়ালেন বটে ভিড় হয়ে, কিন্তু শশী কাপুরের নজর এড়াতে পারলেন না। শট শেষ হলে ভিড়ের মধ্য থেকে অমিতাভকে ডেকে নিয়ে শশী বলেছিলেন, আর কোনো দিন এমনটা কোরো না। নিজেকে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে ফেলো না।
অমিতাভ বুঝলেন, উপদেশটা হলো, নিজেকে খেলো করে দিয়ো না এবং সস্তায় বিকিও না।
অমিতাভের কাছে সেটা ছিল বীজমন্ত্র।
শশী কাপুরের সঙ্গে অমিতাভের অন্য একটা বন্ডিং তৈরি হয়ে যায় সেই থেকে। সেই শশী হুইলচেয়ারে বন্দী, সেই শশীর শারীরিক অসুন্দর হয়ে যাওয়া, সেই শশীর জড়ভরত জীবন অমিতাভের অন্য এক বোধোদয়ের কারণ। মাথা একেবারে ফাঁকা হয়ে যাওয়ার আগেই তাই তিনি ‘প্রয়োজনটুকু জোগাড়’ করে নিতে ভোলেননি।
অমিতাভ কোনো দিনই শশী কাপুর হতে চান না। কারণ, তেমন হলে তিনিও যে হয়ে যাবেন করুণার পাত্র!
আবার এ কারণেই তিনি রজনীকান্ত হওয়ার সাহসও দেখাতে পারেননি। পারবেনও না।
তামিল সিনেমা ও রজনীকান্ত প্রায় কতখানি সমার্থক, তা দাক্ষিণাত্যে না গেলে কোনো দিনই জানা যাবে না। যাঁর জন্য এখনো চূড়ান্ত পাগলেপনার অন্ত নেই, আজও যাঁর যেকোনো সিনেমায় ঢালা টাকার তিন ভাগের দুই ভাগ স্রেফ তাঁর নামের কল্যাণেই উঠে আসে, জনজীবনে তাঁকে দেখলে কেউ কোনো দিন বলবে না তিনিই ইনি! মাথাজোড়া টাক। কালোকুলো চেহারা পালিশের বিন্দুমাত্র কোনো তাগিদ নেই। সাদা পাজামা ও পাঞ্জাবি ছাড়া পোশাকেও নেই বিন্দুমাত্র বাহুল্য। এতখানি নির্লিপ্ততায় ডুবে থেকেও যখন তিনি সিনেমার চরিত্রে সাজগোজ করে নেমে আসেন, তামিল মননে তখন সুনামি ঘটে যায়। এই রসায়নের কোনো ব্যাখ্যা অমিতাভের কাছে নেই। তিনি শুধু জানেন, তিনি আর্যাবর্তের ভঙ্গুর এক অভিনেতা। কল্পজগতের মানুষ। রজনীকান্তর মতো তিনি নির্বিকার চিত্তে মর্তে নেমে আসতে পারবেন না।
তাঁকে ঘিরে মুগ্ধতার যে বলয়, এতটা কাল ধরে তৈরি হয়ে এসেছে, যা একান্তই তাঁরই সৃষ্টি, রজনীকান্তদের মতো সর্বজনীন হয়ে কিংবা শশী কাপুরদের মতো ভাগ্যহত হয়ে সেই বলয়ে পিন ফুটিয়ে বিলীন করে দিতে তিনি নারাজ। গলার রিঙ্কলগুলো ঢাকতে তাই তিনি স্কার্ফের সাহায্য নেন! বড় কলার জামা পরেন।
দেব আনন্দের মধ্যেও এই ব্যাপারটি ছিল। এই মানসিকতা। অমিতাভ বচ্চনের মধ্যেও রয়েছে!
এটাই কি নারসিসিজম? কী জানি? হতেও পারে। বলতে পারব না। আমি কোনো দিন জানতে চাইনি। কারও দুর্বলতায় আঘাত করতে আমার মন সায় দেয় না।
অমিতাভকে বড় কষ্ট দিয়েছে বিনোদ খান্নার চলে যাওয়া।
মাত্র সত্তর বছরেই বিনোদ চলে গেলেন! চলে গেলেন ক্যানসারের কাছে হেরে। জীবন এমনই নিষ্ঠুর! বিনোদের চেয়ে চার বছরের বড় অমিতাভ এখনো সুস্থ ও কর্মক্ষম! সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকা, জীবনের গোধূলিবেলায় এটাই ওঁর বেঁচে থাকার রসদ।
সমবয়সী শত্রুঘ্ন সিনহা প্রায় দেশান্তরি। কোথাও তেমন চাহিদা নেই, সম্ভবত রাজনীতি ছাড়া। ড্যানি ও প্রেম চোপড়ারা স্বেচ্ছানির্বাসনে। কিছুটা বড় ধর্মেন্দ্র, ‘শোলে’র জন্য অমিতাভ যাঁর কাছে চিরকালের চিরকৃতজ্ঞ। কিন্তু তাঁর কথা ভেবে গত ১০ বছর কেউ কোনো স্ক্রিপ্টও লেখেননি। কিংবা দিলীপ কুমার! যাঁর অভিনয় অমিতাভ জুলজুল চোখে দেখতেন। এখনো দেখেন। কিন্তু বাড়ি ও হাসপাতালের মধ্যে আসা-যাওয়া অব্যাহত থাকায় আজ বহুকাল তাঁকে নিয়ে কেউ নতুন কোনো স্বপ্ন দেখার সাহস পাননি।
অথচ এই চুয়াত্তরেও অমিতাভকে নিয়ে আজকের প্রজন্ম বিভোর! তাঁর কথা ভেবে এখনো কেউ কেউ ছবির স্ক্রিপ্ট লেখেন! এখনো প্রতিবার ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র প্রথম পঞ্চাশজনের তালিকায় অমিতাভ একেবারে ওপরের দিকে থাকেন।
একই রকম বিভোর আজকের প্রজন্ম, তাঁকে নিয়ে।
‘পিঙ্ক’-এর পরিচালক অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী, যাঁর ডাকনাম টোনি কিংবা ‘পিকু’র সুজিত সরকার অথবা ‘কাহানি’র সুজয় ঘোষ—এঁরা প্রত্যেকেই অমিতজি বলতে বর্তে যান। ‘পিঙ্ক’-এর শুটিংয়ের ফাঁকে টোনি আমাকে একদিন এক পাশে টেনে নিয়ে বলেছিলেন, এই মানুষটা আমার দিব্যচক্ষু খুলে দিয়েছেন।
আমি হেসে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দিব্যচক্ষু খুলে গেল? কীভাবে?
টোনি বলেছিল, পারফেকশনিস্ট বলতে কী বোঝায় মিস্টার বচ্চনের সঙ্গে কাজ না করলে বুঝতে পারতাম না। সুজিত বলল, রাত দেড়টার সময় ফোন করে অমিতাভ বচ্চন বলছেন, সুজিত, অমুক শটটা নিয়ে খুঁতখুঁতুনি যাচ্ছে না। আর একবার কি টেক করা যায়? ভেবে দেখুন একবার! আমি তো শুনে হাঁ! নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকিও একই রকম বিস্মিত অমিতাভ যেভাবে তাঁর প্রশংসা করেছেন তা পড়ে। যীশু সেনগুপ্ত অভিভূত পেশার প্রতি অমিতাভের কমিটমেন্ট দেখে। যে শট ডামি দিয়ে করা যায়, সেখানে টানা তিন ঘণ্টা অমিতাভ নিজে হাজির! কেন? যীশুর কথায়, অমিতজি আমায় বললেন, দেখো যীশু, সিনেমাটাও কিন্তু একটা টিম গেম। একজন দুর্দান্ত অভিনয় করল অথচ অন্যরা সাপোর্ট দিতে পারল না, তাহলে কি সিনেমাটা দাঁড়াবে? কথাটা শুনে যীশুর প্রথমেই যা মনে হয়েছিল, এভাবে কোনো দিন কাউকে একবারের জন্যও তো বলতে শুনিনি! তারপরেই তিনি বিস্মিত! কথাটা কে বলছেন? না, এক ও অদ্বিতীয় অমিতাভ বচ্চন!
এই মুগ্ধতাই অমিতাভের প্রতিদিনের প্রেরণা। নতুন প্রজন্মের এই বিস্ময়ই অমিতাভের জীবনশক্তি। তাদের মুগ্ধতা অমিতাভকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
রাজেশ খান্না হতে চান না বলেই তিনি অনুশাসিত জীবন বেছে নিয়েছেন। তিনি বিনোদ খান্নাও হতে চান না। সে জন্যও তিনি খাদ্যাভ্যাসে অনুশাসিত জীবন বেছে নিয়েছেন। তিনি অপাঙ্ক্তেয় হতে চান না। সে জন্য নবীন প্রজন্মের সঙ্গে তিনি মেলামেশা করে যেতে চান। তাঁদের মুগ্ধতায় নিজেকে মিশিয়ে দিতে চান। জীবনকে তিনি জীবিতদের চোখে, তাঁদের মূল্যবোধের আলোয় দেখতে চান। তিনি চান, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রাসঙ্গিক থাকতে। এলেবেলে হয়ে বাকি জীবনটা সবার করুণার পাত্র হয়ে বিস্মৃতির অন্তরালে কাটাতে তিনি চান না। তিনি অমিতাভ বচ্চন! এই দেশে এই বেশে এই ভাবে কাজ করতে করতে জীবনের শেষ দিনটা কাটিয়ে দিতে পারলে তিনি সর্বশক্তিমানের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবেন।
বহু ভাষা, বহু বর্ণ, বহু ধর্ম, বহু জাত, বহু খাদ্যাভ্যাস, বহু আচার ও বহু সংস্কৃতির এই ভারতে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমের এত ধরনের বিভাজন সত্ত্বেও আজও যে আমরা ভারতীয়, তা এই অমিতাভ বচ্চনদের জন্যই! অমিতাভদের জন্যই আমরা আজও ‘এক জাত এক প্রাণ একতা’।
কীভাবে তাহলে মানুষ তাঁকে মনে রাখবে?
বিস্ময়কর অভিনেতা হিসেবে? অবশ্যই। ব্যারিটোন কণ্ঠস্বরের দরুন? অবশ্যই। নিশ্চিত বক্স অফিসের জন্য? নিশ্চয়। ওয়ান ম্যান ইন্ডাস্ট্রির তকমা কপালে সাঁটা ছিল বলে? অবশ্যই। কাজ চাওয়া ও পাওয়ার অফুরন্ত খিদের জন্য? হতে পারে। শেষ দিন পর্যন্ত শেখার আগ্রহের জন্য? অবশ্যই হতে পারে। পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে অবলীলায় কানেক্ট করতে পারার দক্ষতার দরুন? হুমমমমমম।
কিন্তু শুধু এই নয়। অমিতাভ বচ্চনকে মানুষ মনে রাখবে তাঁর ভদ্রতাবোধ ও শালীনতার জন্য। কখনো কারও সম্বন্ধে একটাও কটু কথা না বলার জন্য। মনে রাখবে সংযমের জন্য। ঘর ও বাইরে আগাগোড়া এক শ ভাগ পারফেক্ট থাকার চেষ্টার জন্য। মনে রাখবে ভারতীয় মূল্যবোধগুলো অন্তর থেকে লালনের জন্য। ঐতিহ্যের প্রতি বিনম্র থাকার জন্য। আদ্যন্ত পারিবারিক থেকে যাওয়ার জন্য। মা-বাবাকে ত্যাগ না করার জন্য। শেষ দিন পর্যন্ত নিজেদের কাছে তাঁদের সম্মান ও শ্রদ্ধার আসনে রেখে দেওয়ার জন্য। একটা নরম মনের অধিকারী হওয়ার জন্য। উপকারীর উপকার স্বীকার করার মানসিকতার জন্য।
যাবতীয় সামাজিক অসুস্থতার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়ার প্রয়োজন যাঁরা অনুভব করেন, ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ অমিতাভ বচ্চনের দিকে তাঁরা অনুযোগের দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেই যাবেন। করবেন কেননা, তাঁদের বিশ্বাস, কোনো বিষয়ে অমিতাভ বচ্চনের স্পষ্ট অবস্থান মানুষকে ভাবাবেই শুধু নয়, মন ও মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতেও সাহায্য করবে।
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।
আমি শুধু চেয়ে চেয়ে ও ভেবে ভেবে কাটিয়ে দেব, যে-কুলুঙ্গিগুলোয় মানুষটা আজও আলো ফেলতে দিলেন না, কোনো দিন কি সেখানে উঁকি মারা সম্ভব হবে? ভেবেই যাব, সেই কোটরগুলোতে কী কী রহস্য কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়ে গেছে!