অনুশাসন, না হৃদয় - কে বাঁচায় মানুষকে

তির্যক আয়োজিত নাট্য উৎসবে টিআইসি মঞ্চে মণিপুরি থিয়েটারের দেবতার গ্রাস নাটকের একটি দৃশ্য l ছবি: সংগৃহীত
তির্যক আয়োজিত নাট্য উৎসবে টিআইসি মঞ্চে মণিপুরি থিয়েটারের দেবতার গ্রাস নাটকের একটি দৃশ্য l ছবি: সংগৃহীত

সমকালের পটভূমিতে স্থাপন করে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকে নবরূপ দেওয়ার চেষ্টা নতুন নয়। তবে শুভাশিস সিনহার মণিপুরি থিয়েটারের দেবতার গ্রাস নাটক নব রূপায়ণের চেয়ে বেশি কিছু। একই নামের বিখ্যাত কবিতাটিতে গল্প ও নাটকের উপাদান তো আছেই। তাই মনে হতে পারে, মঞ্চে কেবল কাহিনির সম্প্রসারণই ঘটবে। কিন্তু দেবতার গ্রাস নাটকে কেবল কবিতায় বর্ণিত কাহিনি অনুসরণ করা হয়নি, নতুন দার্শনিক সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা আছে এতে।
১৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় থিয়েটার ইনস্টিটিউট মঞ্চে তির্যক নাট্যদল আয়োজিত নাট্য উৎসবে মণিপুরি থিয়েটারের বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষায় রচিত নাটকটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের কাছে সন্ধ্যাটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তবু অভিনয়ের দক্ষতা, বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষায় অনূদিত রবীন্দ্রসংগীত কিংবা জমাট কোরিওগ্রাফি এই নাটকের একমাত্র বলার বিষয় নয়। তাৎক্ষণিক মুগ্ধতা ছাপিয়ে নাটকটি দর্শককে জীবনের এক পরম প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়, তা হলো, কোনটি বড়—হৃদয়, নাকি অনুশাসন? কোনটি শেষ পর্যন্ত বাঁচায় মানুষকে?
দুরন্ত ছেলে রাখালকে মাসির কাছে রেখে তীর্থস্নানে যাবে মা মোক্ষদা। তবে মায়ের সঙ্গে যাওয়ার বায়না ধরে রাখালও। অতিষ্ঠ মা রেগে বলে, ‘চল তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে!’ সন্তানের জন্য উৎকণ্ঠা থেকে বলা এ কথা দেবতার প্রতি মানত হয়ে উঠবে, ভাবেনি মোক্ষদা। রবীন্দ্রনাথের কথা ও কাহিনী কাব্যগ্রন্থের ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতার এই কাহিনি অনেক পাঠকের জানা। তবে নির্দেশক শুভাশিস সিনহা নতুন সব উপাদান যোগ করে নাটকটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছেন।
মণিপুরি সংস্কৃতিতে পরম মুক্তির স্থান বৃন্দাবনকে এই নাটকে তীর্থস্থান দেখানো হয়। সেই তীর্থের উদ্দেশে ঠাকুরের নৌকায় যারা চড়ে বসে, তাদের মধ্যে আছে পাগল, মাতাল, প্রেমিক, বৈষয়িক, ভাবুকসহ সংসারের সব ধরনের মানুষ। আর নৌকাটিও যেন সাধারণ কোনো নৌকা নয়। এ যেন এক জীবনতরি, যেখানে অমোঘ নিয়মে মৃত্যু, প্রেম, ব্যাধি এসে হাজির হয়। জীবনের এই আবর্তনে নিয়তি বিশ্বাসী মানুষ অনুশাসনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। যেমন করেছেন নাটকের ব্রাহ্মণ ঠাকুর। শিষ্য রামকান্তের প্রেমকে যিনি নিতে পারেননি, তিনিই তো রাখালকে জলে বিসর্জন দেবেন। কিন্তু কখনো নিজের হৃদয়ের কথা শুনেছেন কি তিনি? মৃত রাখাল যেন তাঁর কান খুলে দিল। শেষ পর্যন্ত অনুশাসনের কঠিন দেয়াল ভাঙলেন তিনি। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানবপ্রেমের নব আনন্দে জেগে উঠলেন পুরোহিত। তবে সার্বিক অর্থে ঠাকুরের এই জাগরণ তো আসলে মানুষের সামনে এক শুভ আশাবাদেরই উচ্চারণ।
বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষায় নয়টি রবীন্দ্রসংগীতসহ এতে ব্যবহৃত হয়েছে ১৫টি গান। সংগীতায়োজনে ছিলেন শিল্পী শর্মিলা সিনহা। নন্দিত অভিনেত্রী জ্যোতি সিনহা এই নাটকে আরও একবার তাঁর জাত চেনালেন। এ ছাড়া বলতেই হবে ঠাকুরের চরিত্রে সুশান্ত সিংহ ও রাখালের চরিত্রে স্মৃতি সিনহার অসামান্য অভিনয়ের কথা।
ভাষার ব্যবধান এই নাটকে দর্শকদের সামনে দেয়াল তোলেনি। মঞ্চের ভাষা যে সর্বজনীন ও বোধগম্য, সেটাই প্রমাণিত হলো আরও একবার।