অন্তঃসত্ত্বা মায়ের চাই সঠিক যত্ন

২৮ বছর বয়সী জেসমিন আনোয়ার সদ্য পুত্রসন্তানের মা হয়েছেন। সুস্থ আছেন মা ও শিশু দুজনেই। তিনি আদৌ একটি সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে পারবেন কি না এ নিয়ে গত কয়েক মাস দুশ্চিন্তায় কেটেছে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত জেসমিনের। তবে তাঁর আশঙ্কা অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। ‘প্রেগন্যান্সির পুরোটা সময় সঠিক যত্ন ও চিকিৎসা পাওয়ায় মা-ছেলে ভালো আছি, সুস্থ আছি।’ মন্তব্য জেসমিনের। তিনি জানান, সন্তান হওয়ার এক মাস আগে থেকে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসকদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে ছিলেন।
অন্যদিকে, রুমানা খন্দকার প্রথমবারের মতো অন্তঃসত্ত্বা হলেও মা হতে পারেননি। ১৮ সপ্তাহের মাথায় তাঁর গর্ভপাত হয়ে যায়। এর একমাত্র কারণ, গর্ভকালীন সঠিক পরিচর্যার অভাব। রুমানা জানান, অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর তাঁর বেশ কয়েকবার শরীর খারাপ লাগলেও তাঁকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়নি। স্বামীর ব্যস্ততা ছিল। পাশাপাশি শাশুড়ি বলেছেন, এ সময় এমন হতেই পারে। এর মধ্যে তিনি আবার ভারী জিনিস তুলেছেন। এরপরই গর্ভপাত হয় তাঁর। সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়া ও পারিবারিক অবহেলাকেই এ জন্য দায়ী করছেন রুমানা।
একটি সুস্থ শিশুর জন্ম দিতে এবং নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে দরকার গর্ভকালে মায়ের সঠিক যত্ন ও পরিচর্যা। বিশেষ করে প্রথমবারের মতো যাঁরা মা হতে যাচ্ছেন, তাঁদের জন্য প্রয়োজন বাড়তি সতর্কতা ও যত্ন। অনেক বিষয়ই তখন অজানা থাকে। এ জন্য অন্তঃসত্ত্বা মা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি মায়ের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক বলে মনে করেন প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা। তা না হলে গর্ভের শিশু ও মায়ের নানা সমস্যা সৃষ্টি হওয়াসহ মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের চিকিৎসক গুলশান আরা অন্তঃসত্ত্বা মায়ের যত্ন সম্পর্কে বলেন, গর্ভকালকে তিনটি ভাগে ভাগ করে মায়েদের যত্ন নিশ্চিত করতে হবে। গর্ভকালীন প্রথম তিন মাস (১ থেকে ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত) মা ও শিশু উভয়ের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে মায়ের পেটব্যথা, বমি বমি ভাবসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। তাই এই সময়টাতে মায়ের বেশি যত্ন প্রয়োজন। এ সময় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবনের পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। মায়ের খাওয়া ও বিশ্রামকে একটি নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। পর্যাপ্ত পানি ও বেশি বেশি তরল খাবার খেতে হবে মাকে। এই সময় বেশি চলাফেরা করা ঝুঁকিপূর্ণ।
দ্বিতীয় স্তরের মেয়াদ ১৩ থেকে ২৪ সপ্তাহ। এই সময়ে বমিভাব বা খারাপ লাগার অনুভূতি চলে যায়। তবে মায়েদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, পানিভাঙা, রক্তপাত, সময়ের আগেই সন্তান প্রসব—এ ধরনের সমস্যা হতে পারে। তাই এই সময়েও বেশি যত্ন প্রয়োজন। এই সময়ে নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা, হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা, রক্তচাপ পরীক্ষা, ব্লাড সুগার পরিমাপ করা জরুরি। এই সময়ে খাওয়ার পরিমাণও বাড়াতে হবে।
শেষ স্তরে (২৭-৪০ সপ্তাহ) সপ্তাহে একবার করে ডাক্তার দেখানো উচিত। এই সময় ঘন ঘন পরীক্ষা করা উচিত। মায়ের অন্যান্য পরিচর্যাও প্রথম দুই স্তরের মতোই চলবে।
গুলশান আরা বলেন, মায়ের ঘুম শিশুর সুস্থতার জন্য অত্যাবশ্যক। মাকে দিনে দুই ঘণ্টাসহ মোট ১০ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। শিশুটি গর্ভে কেমন আছে, কোনো সমস্যা আছে কি না দেখার জন্য আলট্রাসনোগ্রাম করতে হবে। তবে প্রয়োজন না হলে ঘন ঘন আলট্রাসনোগ্রাম করানো উচিত নয়। শিশুর নিয়মিত নড়াচড়া অনুভব না করলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
অন্তঃসত্ত্বা মায়ের প্রতি পরিবারের সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ জরুরি উল্লেখ করে গুলশান আরা আরও বলেন, আজকাল নারীদের অনেকেই চাকরিজীবী হওয়ায় কর্মস্থলে সহকর্মীদের বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে এগিয়ে আসতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, অন্তঃসত্ত্বা মাকে অন্তত চারবার চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। নির্ধারিত সময়গুলো হলো, ১৬ সপ্তাহ, ২৪-২৮ সপ্তাহ, ৩২ সপ্তাহ ও ৩৬ সপ্তাহ। কিন্তু এখন নারীরা আগের তুলনায় বেশি বয়সে মা হওয়াসহ নানা জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় গর্ভবতী মাকে ছয়বার চিকিৎসক দেখানো দরকার বলে জানান ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসক ইসমত আরা।
স্বাস্থ্যবিষয়ক জার্নাল, ল্যানসেটের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ২১ জন মায়ের মৃত্যু হয়। তাই অন্তঃসত্ত্বা মায়ের যত্ন নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসক নূরুন নাহার। তিনি বলেন, গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসব-পরবর্তী নানা ধরনের সমস্যা যেমন রক্তক্ষরণ, গর্ভজনিত খিঁচুনি, গর্ভপাত, ফিস্টুলা ও কম ওজনের সন্তান প্রসব এড়াতে মাসহ পরিবারকে সচেতন থাকতে হবে।