অভ্যাস বদলানোর সূত্র

জেমস ক্লিয়ারের অ্যাটমিক হ্যাবিটস
ছবি: সংগৃহীত

ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল যেমন মহাদেশ আর অতল সাগর গড়ে তোলে; তেমনি আমাদের ছোট ছোট দৈনন্দিন অভ্যাসও জীবনকে বদলে দিতে পারে ইতিবাচকভাবে—অল্প কথায় বলতে গেলে এই হলো জেমস ক্লিয়ারের অ্যাটমিক হ্যাবিটস বইয়ের মূল কথা।

লেখক, উদ্যোক্তা, আলোকচিত্রী জেমস ক্লিয়ার তাঁর বইয়ের শুরুটা করেছেন নিজের গল্প দিয়ে। লিখেছেন, প্রতিনিয়ত ছোট ছোট অভ্যাস কীভাবে তাঁর জীবনকে বদলে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। রোজ সকালে পাঁচ মিনিট ব্যায়াম হয়তো সারা দিনের হিসাবে খুব বেশি কিছু নয়। বা এর ফলে যে পরিবর্তন আসে, তা তেমন লক্ষণীয়ও নয়। কিন্তু এই একই ব্যায়াম যদি কেউ বছরের পর বছর করতে থাকেন, তবে তাঁর শরীর ও মন ইতিবাচকভাবে বদলে যাবে, এটাই আশা করা যায়।

আবার খারাপ অভ্যাসের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এমনই। ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে একটি সিগারেট হয়তো শরীরে তেমন কোনো নেতিবাচক পরিবর্তনই আনে না, কিন্তু একজন ধূমপায়ী যখন তাঁর এই বদ-অভ্যাসটি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর চালিয়ে যান, তখন তাঁর শরীরে তৈরি হয় আলসার, হৃদ্‌রোগসহ নানা জটিল দীর্ঘমেয়াদি অসুখ।

লেখকের মতে, অভ্যাস গড়ার আগে দরকার নিজের পরিচয় বদল। কেউ যদি নিয়মিত বই পড়তে চান, তবে তাঁর পরিচয় হবে একজন পাঠক। আবার কেউ যদি ধূমপান ছাড়তে চান, তবে অধূমপায়ী পরিচয়টি নিজের মধ্যে গেঁথে ফেলতে হবে। আমি ধূমপান ছাড়ার চেষ্টা করছি—এই চিন্তা করার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর নিজেকে এটা বিশ্বাস করানো যে আমি একজন অধূমপায়ী।

অভ্যাস তৈরির জন্য বোঝা দরকার অভ্যাসের চক্রটি কীভাবে কাজ করে।

প্রথমে আমরা মস্তিষ্কে একটি সংকেত পাই। সেই সংকেত পেলে আমাদের কোনো একটি কাজ করার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়, তারপর আমরা কাজটি করি। কাজটি করার পর আমাদের ভালো লাগা বা একটি ভালো অনুভূতি সৃষ্টি হয়। এই ভালো অনুভূতির জন্য আমরা সেই কাজ আবার করি। এভাবেই একটি অভ্যাস দাঁড়িয়ে যায়।

অভ্যাস তৈরির জন্য নিয়মিত ভিত্তিতে এই অভ্যাসের চক্রটি চালিয়ে যাওয়া দরকার। ভালো অভ্যাস তৈরির ক্ষেত্রে লেখক চারটি নিয়ম মানার কথা বলেছেন:

১. অভ্যাসটিকে স্পষ্ট করুন।

২. এটিকে আকর্ষণীয় করুন।

৩. অভ্যাসটি যেন হয় সহজ।

৪. এটি যেন আপনাকে তৃপ্তি দেয়।

আবার বদ-অভ্যাস ত্যাগের ক্ষেত্রে মানতে হবে এর উল্টো নিয়ম:

১. অভ্যাসটিকে অস্পষ্ট করুন বা খারাপ অভ্যাসের সংকেতকে ত্যাগ করুন।

২. এটিকে অনাকর্ষণীয় করুন।

৩. অভ্যাসটিকে কঠিন করে ফেলুন।

৪. অভ্যাসটি যেন আপনাকে তৃপ্তি না দেয়।

উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে। কেউ যদি ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করতে চান, তবে তাকে এটি ঠিক করতে হবে যে তিনি কখন ঘুম থেকে উঠতে চান। আগামীকাল ভোরে ঘুম থেকে উঠব—এমনটা বললে স্পষ্টতা থাকে না। তার চেয়ে এটা বলা ভালো, আমি আগামীকাল ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠব।

কেউ যদি বই পড়ার অভ্যাসটিকে আকর্ষণীয় করতে চান, তবে তিনি পাঠচক্রে যোগ দিতে পারেন। এর ফলে পড়ার অভ্যাসটি হতে পারে আরও মজাদার। নিয়মিত কম্পিউটার প্রোগ্রামিং চালিয়ে নিতে চাইলে প্রোগ্রামারদের ফোরাম বা ফেসবুক গ্রুপে যোগ দেওয়া যায়। এর ফলে শুধু অন্য প্রোগ্রামারদের কাছ থেকে শেখাই যায় না, বরং প্রোগ্রামিং শেখার পুরো প্রক্রিয়াটি হয়ে ওঠে বেশ আকর্ষণীয় ও চমকপ্রদ।

হুট করে কোনো কঠিন অভ্যাস তৈরি করার চেয়ে বেশি কার্যকর হলো নিজের সাধ্যের মধ্যে সেটি শুরু করা। এ ক্ষেত্রে লেখকের বর্ণিত ‘২ মিনিট পদ্ধতি’ ব্যবহার করা যেতে পারে। ‘২ মিনিট পদ্ধতি’ অনুযায়ী, কঠিন অভ্যাসের ক্ষেত্রে নিয়মিত চালিয়ে যাওয়া খুব জরুরি। তাই অভ্যাসের যে অংশটুকু দুই মিনিটের মধ্যে করা সম্ভব, সেটুকু করে ফেলতে হবে শুরুতে। যাঁদের বই পড়ার অভ্যাস নেই, কিন্তু পড়ার অভ্যাস করতে চান, তাঁরা প্রতিদিন ভোরে এক পৃষ্ঠা দিয়ে শুরু করতে পারেন। বেশ কিছুদিন ধারাবাহিকভাবে এক পৃষ্ঠা পড়তে পড়তে ভালো লাগা সৃষ্টি হলে একসময় এই রোজকার পৃষ্ঠা সংখ্যাটি বাড়তে থাকবে। আর দীর্ঘসূত্রতাও পেয়ে বসবে না।

অভ্যাসে তৃপ্তি পাওয়া চাই। নিয়মিত দাঁত মাজার অভ্যাস করতে বেছে নিতে পারেন একটি চমৎকার ফ্লেভারের টুথপেস্ট। আবার রাতে সময়মতো ঘুমানোর তৃপ্তিকে বাড়াতে পারে একটি ভালো বিছানার চাদর ব্যবহার।

জেমস ক্লিয়ারের মতে, লক্ষ্য বা পরিকল্পনা ঠিক করে আমি কোন দিকে যাব। কিন্তু জীবনে নিয়মিত পরিবর্তন নিশ্চিত করে সত্যিকারের উন্নতি। তাই লক্ষ্য নির্ধারণের পাশাপাশি দরকার সেটিকে বাস্তবায়ন করা, অভ্যাসটিকে উপভোগ করা। অ্যাটমিক হ্যাবিটস বইয়ে আরও বেশ কিছু মজাদার বিষয় আলোচনা করা হয়েছে—কীভাবে একটি পুরোনো অভ্যাসের সঙ্গে একটি নতুন অভ্যাস জোড়া লাগানো যায়, জিনগত বিষয় সফলতার ক্ষেত্রে কীভাবে ভূমিকা রাখে, কীভাবে অভ্যাস বা দক্ষতাকে আরও একটু ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়া যায় প্রতিদিন।
অ্যাটমিক হ্যাবিটস
সম্পর্কে আরও জানতে পারেন এই ওয়েব ঠিকানায়: jamesclear.com/atomic-habits