অসুস্থ শরীরেও মা আমার খোঁজ নিতেন

মাখা ভাতে মায়ের মমতা। ছবি: অধুনা
মাখা ভাতে মায়ের মমতা। ছবি: অধুনা

ছোটবেলার মাকে বড্ড আজব মনে হতো। এত রাগী, খটমটে, ভালোবাসাহীন, পাষাণ মানুষও হতে পারে! কথায় কথায় মার খেতাম। খেলতে গিয়ে দেরিতে ফেরা, ভাইদের সঙ্গে মারামারি, সময়-অসময় নেই, দল বেঁধে বেরিয়ে পড়া। আরও কত কি! যা করতাম সবই ঠিক করছি—এমনই মনে হতো; শুধু মায়ের হাতে মার খাওয়াটা সহ্য হতো না। প্রায়ই মার খেয়ে খুব কাঁদতাম। প্রথমে গলা ছেড়ে। তারপর ক্লান্ত হয়ে ধীরে ধীরে...শেষে খুব ইনিয়ে-বিনিয়ে অভিমানী সুরে। যেন মা এসে আদর করে কান্না থামিয়ে দেন। কিন্তু মা কখনো কাছে আসতেন না। সময় গড়িয়ে বিকেল হলেও খেতে বলতেন না। আব্বা বিকেলে অফিস থেকে ফিরলে তবে সব অভিমান সাঙ্গ হতো। অনেক নালিশ হতো। অনেক আদর। তারপর পরদিন থেকে আবার যেই-সেই। খুব সুবিধা হতো মা অসুস্থ হলে। মায়ের কঠিন ধরনের হাঁপানির সমস্যা ছিল। প্রায়ই বিছানা নিতেন। আমিও সারা দিন বাইরে বাইরে। শুধু ক্ষুধা লাগলে চুপ করে কলতলায় এসে হাত-পায়ের মাটি ধুয়ে খেতে বসে যেতাম। মা ওই শরীর নিয়েই আমাদের জন্য রান্না করতেন। শুধু বাউন্ডুলে আমার সঙ্গে লড়ার সামর্থ্য তখন তার আর থাকত না।
খুব ছোট্ট বয়সে মায়ের বিয়ে হয়। একুশ বছর বয়সেই তাঁর তিন সন্তান। সন্তান নিয়ে আহ্লাদ বা আদিখ্যেতা করার অবস্থা মায়ের কখনোই ছিল না। আমাকে কোনো দিন মা ‘মা’ বলে ডাকতেন না। খুব কড়াভাবে নাম উচ্চারণ করে ডাকতেন। মাকে জড়িয়ে ধরে আবদার বা আদর নেওয়া কাকে বলে কোনো দিন বুঝিনি। কঠিন কঠোর এক শাসক হিসেবেই তাঁকে চিনেছি ছোটবেলায়।

মাকে বোঝার ধরনটা পাল্টেছে ঠিক ১৬-১৭তে এসে। খানিকটা সময় মায়ের পিছু পিছু ঘুরি। একসঙ্গে সিনেমা দেখতে যাই। প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে আড্ডা দিই। মা সোয়েটার বুনলে পাশে বসে আমি মাফলার কিংবা মোজা বুনি। খেতে বসলে দুই ভাইয়ের থেকে আমাকেই বেশি যত্ন করতেন মা। দুধের সর, মুরগির কলিজাটা আমার পাতেই দিতেন। শীতের দিনে হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখতাম, মা আমার ঠান্ডা পা তেল দিয়ে মালিশ করে দিচ্ছেন। মায়ের যত্নটাই যে ভালোবাসা, সেটা যখন ভালো করে বুঝতে পারলাম, তখন আমি পরের ঘরে।

 মা একটা সময় আমার মাঝে তার অপূর্ণতাগুলো পূর্ণ করতে চাইতেন। কখনো কোনো বিষয়ে চাপ দিতেন না, কিন্তু আমি যা-ই করতাম, গান, কবিতা, আঁকাআঁকি মা মুগ্ধ হয়ে যেতেন। সেটাতেই উৎসাহ দিতেন। আমার কথা, চিন্তাচেতনাও তাঁকে প্রভাবিত করত। আমার ওপর তাঁর বিশ্বাস ছিল। কখনো কোনো বিষয়ে আমাকে নিষেধ করতেও দেখিনি তাঁকে। বন্ধুর মতো সব বিষয়ে আলোচনা করতেন। মনের দিক দিয়ে মা ছিলেন প্রচণ্ড মুক্ত, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। কোনো দিনও মাকে কোনো সংস্কার মানতে দেখিনি আমি। সারা জীবন অসুখে ভুগেছেন, কিন্তু কাউকে কষ্ট দেননি, খুব কষ্ট নিয়েও মাকে প্রাণ খুলে হাসতে দেখেছি। খুব অল্প বয়সে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মা জীবনের শেষ কয়েকটা দিন খুব কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু তবু কেউ বেড়াতে এলে তাঁকে বুঝতে দেননি। হেসেছেন, গল্প করেছেন, ক্যানসার থেকে সাবধান থাকতে বলেছেন। মৃত্যু নিয়ে মৃদু ঠাট্টা-রসিকতাও করতেন। এত মানসিক শক্তি কোনো মানুষের থাকতে পারে, এটা মাকে না দেখলে কোনো দিন বুঝতাম না।

আজ মা নেই। মাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদ করিনি কখনো, ভালোবাসি বলব, সে সম্পর্কটা কখনো তৈরি হয়নি...কিন্তু বুকের মাঝে, মনের মাঝে একটা শূন্যতা অনুভব করি সব সময়...একজন সুহৃদের, প্রিয় বন্ধুর।

আফসানা জাহান

রংপুর।