
বাসা, অফিস ও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েই দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে আমাদের। এসব জায়গায় আগুনের হাত থেকে বাঁচতে আমাদের থাকা চাই পূর্বপ্রস্তুতি। অনেক সময়ই আমরা বুঝতে পারি না কোথাও আগুন লাগলে কী করব, তৎক্ষণাৎ কীভাবে নিরাপদে বের হতে পারব? সে জন্য যদি পূর্বপরিকল্পনা থাকে, তবে সহজেই নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে জীবন বাঁচানো যায়। আগুন নেভানোর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও কিনে রাখা উচিত হাতের কাছেই।
ঢাকার সিদ্দিকবাজারে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের জ্যেষ্ঠ স্টেশন অফিসার খন্দকার আব্দুল জলিল বলেন, পূর্বপরিকল্পনা হবে লিখিত আকারে। কোন তলায় কয়টি ঘর, কোন ঘরে আগুন লাগার ঝুঁকি আছে, কোথায় গ্যাস কিংবা দাহ্য বস্তু রয়েছে, এর সবই চিহ্নিত থাকবে সেখানে। থাকবে দরজা, জানালা, সিঁড়ির অবস্থান ও দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার বিকল্প কোনো রাস্তা। শিশু থেকে প্রবীণ পরিবারের সবাইকে এ পূর্বপরিকল্পনা সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। মাসে মাসে দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার মহড়াও করতে পারেন।
বাসায় দাহ্য বস্তু থাকলে খেয়াল রাখতে হবে তা যেন আগুনের উৎস থেকে যথেষ্ট দূরে থাকে। বৈদ্যুতিক সুইচ বোর্ড বা মাল্টিপ্লাগের আশপাশে কাগজপত্র বা বাক্সপ্যাটরা না রাখাই ভালো। একই মাল্টিপ্লাগে টিভি, ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, মুঠোফোন চার্জার থেকে শুরু করে ইস্তিরি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু একটি মাল্টিপ্লাগ একসঙ্গে এতটা চাপ নিতে সক্ষম না। ফলে মাল্টিপ্লাগ উত্তপ্ত হয়ে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ফলে সে ক্ষেত্রে উন্নত মানের ও প্রতিটি প্লাগের জন্য পৃথক সুইচসংবলিত মাল্টিপ্লাগ ব্যবহার করা উচিত।
নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে একটি জায়গা আগে থেকে নির্ধারণ করে রাখা ভালো। যেখানে এসে সবাই জড়ো হবে—একে বলে অ্যাসেম্বলি পয়েন্ট। পরে পরিবারের সদস্যসংখ্যা গুনে নিয়ে নিশ্চিত হতে হবে সবাই নিরাপদে আছে কি না। কলকারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের জন্যও এমনটা প্রযোজ্য।
অগ্নিদুর্ঘটনার সময় করণীয়
lসহজ পথে বের হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু কোনো কারণে মূল দরজা বন্ধ থাকলে, কোনোভাবেই খোলা না গেলে, তখন বিকল্প উপায় খুঁজে বের করতে হবে। বের হওয়ার বিকল্প উপায় আগে থেকেই ‘হোম সেফটি প্ল্যান’-এ উল্লেখ থাকবে। জানালা হতে পারে বিকল্প উপায়। জানালা ভেঙে বের হওয়ার জন্য আগে থেকেই জানালার পাশে হাতুড়ি বা রড রাখা যেতে পারে। জানালার গ্রিলের একটা অংশ তালাবদ্ধ করেও রাখা যেতে পারে, যাতে সহজে তালা খুলে বের হওয়া যায়। এটা শুধু নিচতলা বা দোতলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
l বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে প্রথমে ‘ইমারজেন্সি এক্সিট’ খুঁজে বেরিয়ে আসতে হবে। সম্ভব না হলে ছাদে উঠতে হবে। তা-ও সম্ভব না হলে নিজ কক্ষেই অবস্থান করুন। কক্ষ থেকে বের হতে না পারলে জানালায় কাপড় নেড়ে বাইরের লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করুন। একই সঙ্গে নিজেকে শান্ত রেখে টেলিফোন বা মুঠোফোনে কাছের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতে হবে।
l ফায়ার অ্যালার্ম শোনামাত্রই, কক্ষের ভেতর থেকেই দরজায় হাত রেখে অনুভব করতে পারেন আগুন ঠিক দরজার ওপাশেই কি না? তারপর অতি সাবধানে দরজা খুলে বেরিয়ে আসুন। ঘরভর্তি ধোঁয়ার হাত থেকে বাঁচতে সোজা হয়ে না হেঁটে হামাগুড়ি দিয়ে বা ক্রোলিং করে বের হতে পারেন। ধোঁয়া ওপরের দিকে থাকে, ফলে মেঝে থেকে কমপক্ষে ১ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত ধোঁয়ামুক্ত থাকে। যদি মনে হয়, আগুন কাছাকাছিই আছে, তবে আতঙ্কিত হবেন না—একটি দরজা পুড়তে ঘণ্টা খানেক সময় লাগে। এর মাঝে বারবার পানি দিয়ে দরজা ভিজিয়ে দিতে পারেন। দরজার নিচ দিয়ে ধোঁয়া প্রবেশ করতে দেখলে কাঁথা বা অন্য কিছু দিয়ে তা আটকে দিন। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতে হবে।
l বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে আগুন লাগলে প্রথমেই মূল সুইচ বন্ধ করে দিন।
l সব সময় একটি বালতিতে পানি রাখা উচিত। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার আগেই নেভানোর চেষ্টা করতে হবে। আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে অতি দ্রুত ফায়ার সার্ভিসে খবর দিতে হবে।
আগুন নেভানোর যন্ত্র
বাড়িতে প্রতি তলায় ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখা উচিত। বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে সৃষ্ট আগুন নেভানোর জন্য আছে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসভর্তি ফায়ার এক্সটিংগুইশার। আর অন্য সব ধরনের আগুন নেভানোর জন্য আছে ড্রাই কেমিক্যাল পাউডার এক্সটিংগুইশার। পাওয়া যাবে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকার মধ্যেই। রান্নাঘর ছাড়াও প্রায় সব ঘরে লাগাতে পারেন স্মোক ডিটেক্টর। নির্দিষ্ট তাপমাত্রা অতিক্রম করলেই তা সাইরেন বাজিয়ে সংকেত দেবে। মিলবে ৮০০ টাকার মধ্যেই। পাবেন পুরান ঢাকার নবাবপুরে।
অফিসের জন্য
অফিস বা কলকারখানার জন্য প্রয়োজন হয় ইমারজেন্সি অ্যাকশন প্ল্যান। সহজে বের হওয়ার বিকল্প উপায়, ফায়ার ডোর ও আরও বাড়তি কিছু আগুন নেভানোর যন্ত্র যেমন: ফায়ার এক্সটিংগুইশার, স্মোক ডিটেক্টর, ফায়ার ডোর, হাইড্রেন্ট সিস্টেম (পানি সরবরাহের উৎস), স্প্রিংকলার সিস্টেম (স্বয়ংক্রিয়ভাবে, অতিরিক্ত তাপমাত্রার উপস্থিতিতে স্প্রিংকলার ফেটে পানি ছড়িয়ে আগুন নেভায়) ও হোজ বক্স (কাচের বাক্সে লাল প্যাঁচানো নল, যা যুক্ত থাকে হাইড্রেন্টের সঙ্গে। যে তলায় আগুন লাগবে, সেখানে কাচের বাক্স খুলে প্যাঁচানো নলটি ৫-১০ ফুট সামনে নিলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি বেরোতে থাকবে, আগুন নেভাবে) যন্ত্র ব্যবহারের ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও নির্দিষ্ট সময় পরপর মহড়ার ব্যবস্থা করা উচিত।
কোথায় পাবেন
বাড়িতেআগুননেভানোর যন্ত্রগুলো পাবেন ঢাকার নবাবপুরেই। কর্মক্ষেত্রে ব্যবহৃত যন্ত্রের বেশির ভাগই আমদানি পণ্য। সে ক্ষেত্রে সেসব পণ্য সরবরাহের জন্য ঢাকায় আছে তেমনি কিছু বেসরকারি কোম্পানি। যেমন: বাংলাদেশ টেকনোলজিক্যাল করপোরেশন লিমিটেড, নয়াপল্টনে আছে ইন্টিগ্রেটেড কন্ট্রোল ইকুয়েপমেন্ট, ধানমন্ডিতে আছে এসআর ফায়ার ফাইটিং ইকুয়েপমেন্ট, পুরানা পল্টনে আছে সেফটি ফায়ার প্রটেকশন কো, নবাবপুর রোডে আছে শোয়েব এন্টারপ্রাইজ ইত্যাদি।
প্রশিক্ষণ
হাতের কাছে যন্ত্র থাকলেও অনেকেই ব্যবহার করতে জানেন না প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও প্রশিক্ষণের অভাবে। সে ক্ষেত্রে তিন দিনের প্রাথমিক কোর্স করে নিতে পারেন আগুন নেভানোর ওপর আপনার কাছের কোনো ফায়ার স্টেশনে। প্রশিক্ষণ শেষে আবার সনদও দেওয়া হয়।