গত শতকের আশির দশকে যাঁরা জন্মেছেন, তাঁরা অ্যানালগ পৃথিবীর শেষ প্রজন্ম আর ডিজিটাল দুনিয়ার প্রথম। সংগীতবিশ্বের সেরা শিল্পীদের একেবারে প্রথম সারির একজন বিয়ন্সে। কুয়ার কাছে গিয়ে চিৎকার করে নিজের প্রতিধ্বনি শুনেছেন, আবার একটু বড় হতে হতে হাতে পেয়েছেন রেকর্ডার। তরুণ অবস্থায় গড়েছেন নিজের কোম্পানি পার্কউড এন্টারটেইনমেন্ট। গড়েছেন নিজের ফ্যাশন লাইন—আইভি পার্ক। এসবের বাইরে পপ আইকন বিয়ন্সে তিন সন্তানের মা। বড় মেয়ে ব্লু আইভির বয়স ৯। চার বছর বয়সী যমজ দুই সন্তান রুমি আর স্যার কার্টার। বিয়ন্সে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও ক্ষমতাবান শিল্পীদের একজন। ২০২১ সালে দাঁড়িয়ে তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ ৫০০ মিলিয়ন ডলার বা ৪ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা। সম্প্রতি তিনি ও তাঁর জীবনসঙ্গী জে–জেড বিশ্বখ্যাত লাক্সারি ব্র্যান্ড টিফানি অ্যান্ড কোম্পানির যাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন। ৪ সেপ্টেম্বর ৪০-এ পা দিতে চলেছেন বিয়ন্সে। হার্পার’স বাজারের সঙ্গে কথা বলেছেন তাঁর জীবনের চার দশক আর নানা কিছু নিয়ে।
ছোটবেলায় অন্তর্মুখী গম্ভীর ধরনের শিশু ছিলেন বিয়ন্সে। কারও সঙ্গে বিশেষ কথা বলতেন না। প্রচুর ভাবতেন। তবে সেই সময়ের নিঃশব্দ দিনগুলোর জন্য এখন তিনি কৃতজ্ঞ। কেননা, মনে মনে ভবিষ্যতের দিনগুলো এঁকেছিলেন বিয়ন্সে। সাত বছর বয়স থেকে স্টেজে গাইতে শুরু করলেন বিয়ন্সে। তখন থেকেই স্টেজকে তাঁর বড্ড আপন বলে মনে হতো।
একদম ছোটবেলা থেকেই বিয়ন্সে দেখেছিলেন, স্টেজে একমাত্র তিনিই কৃষ্ণাঙ্গ। আর তিনিই হতে চেয়েছিলেন সবার সেরা। তাই অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করতে অন্যরা যা করে না, তিনি তা–ই করবেন বলে ভাবলেন। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি গান গাওয়ার সঙ্গে নাচতে শুরু করলেন। অন্তর্মুখী সেই ছোট্ট বিয়ন্সে গান ও নাচের ফাঁকে ফাঁকে দর্শকদের সঙ্গে তাঁর ‘রেডি উইট’ দিয়ে হৃদয় জয় করে নিতে শুরু করল। ৯ বছর বয়স থেকে একজন অপেরা শিল্পীর কাছ থেকে ভয়েস লেসন নেওয়া শুরু করলেন। আর দশম জন্মদিন আসার আগে তিনি ৫০–৬০টি গান রেকর্ড করে ফেললেন।
টানা গানের রেকর্ডিং করছিলেন। ১৩ বছর বয়সে প্রথম ভোকাল ইনজুরি হলো বিয়ন্সের। ভয় হলো যে ক্যারিয়ার শুরুর আগেই না শেষ হয়ে যায়! চিকিৎসক বললেন, ছয় মাস কথা বলা যাবে না। আবারও ছোটবেলার মতো চুপ হয়ে গেলেন বিয়ন্সে। স্কুলে থাকতে কেউ জানতই না যে বিয়ন্সে গান। কেননা, বিয়ন্সে তো কথাই বলতেন না। স্কুল শেষে গানের ক্লাসে যেতেন, রেকর্ডিং করতেন। বাড়ি ফিরে চুপচাপ ঘুমিয়ে যেতেন। সকালে উঠে আবার স্কুলে। বন্ধুবান্ধব, আড্ডাবাজি—এগুলোর পেছনে কখনোই সময় নষ্ট করেননি তিনি।
স্কুল শেষেই পেশাদার শিল্পী হতে যা কিছু প্রয়োজন, তার পেছনে ছুটেছেন। কৃষ্ণাঙ্গ সুপারস্টারদের যেসব ‘দুর্নাম’ ছিল, বিয়ন্সে সেগুলোকে সঙ্গী করতে চাননি। কিছুতেই না। তিনি কখনোই মাদক স্পর্শ করেননি। সব সময় সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছেন। জনসমক্ষে তাঁকে কখনো মেজাজ হারাতে দেখা যায়নি। প্রেম, বিয়ে নিয়েও গুজব ওঠেনি। ১৩ বছরের সংসারে সম্পর্ক নিয়ে কোনো দিন কোনো নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হননি।
নিজের কোম্পানিতে শক্তিশালী নারী ব্যক্তিত্বদের যুক্ত করেছেন বিয়ন্সে। তাঁদের চিন্তার বৈচিত্র্য, সৌন্দর্য, শক্তি আর ক্ষমতাকে নিজের কোম্পানির যাত্রায় সংযোজিত করেছেন। যেকোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। এরপর বিয়ন্সে নিজের পরিবারের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী হিপহপ আর্টিস্ট, ব্যবসায়ী আর মিডিয়া মোগলকে বিয়ে করেছেন। সন্তান আর ব্যবসা সামলাচ্ছেন দুই হাতে। সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশ কিছু ফেলোশিপের চুক্তি হয়েছে তাঁর উদ্যোগে। দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিগুড নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। এই প্রতিষ্ঠান বিশ্বের নারীদের ক্ষমতায়নের কাজে নিয়োজিত।
ফোনের ভেতর নয়, বরং সত্যিকারের দুনিয়ায় তাঁর মিউজিক, সিনেমা, শিল্প আর বার্তা নিয়ে একজন হয়ে উঠতে চেয়েছেন বিয়ন্সে। মডেলিংয়ের জগতেও সব স্টেরিওটাইপ ধারণা ভেঙে নিজেকে অন্য সবার চেয়ে আলাদা করে উপস্থাপন করেছেন। বিয়ন্সে নিজেকে সুন্দর দেখানোর ক্ষেত্রে একচুলও ছাড় দেননি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পারফর্ম করতে গিয়ে স্টেজে ভেতরে–ভেতরে ঘেমেনেয়ে একশা হয়েছেন। কিন্তু বাইরে নিজের সবচেয়ে সুন্দর রূপটি যাতে বজায় থাকে, সে জন্য চলতি পথে নানা টিপসও শিখেছেন। তবে নিজের সৌন্দর্য নিয়ে বিশেষ কথা বলেননি। কেবল বলেছেন, ‘মধুর রোগ সারিয়ে তোলার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। তাই আমি এখন মধুর খামার গড়ার দিকে মনোযোগী হচ্ছি। আমার বাড়িতেই একটি মধুর চাক আছে। মধু একটা চমৎকার ব্যাপার।’
বিয়ন্সে যে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেন, সেখানে অনেকেই তারকা হতে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। সুপারস্টারের তুমুল খ্যাতি, আলোর ঝলকানি থেকে ব্যক্তিগত জীবনকে সযত্নে সচেতনভাবে আলাদা করেছেন। তিনি বলেন, ‘মানসিক প্রশান্তির জন্য আমি আমার ব্যক্তিজীবনকে ক্যামেরার বাইরে রেখেছি। আমি কেবল সেটুকুই দেখিয়েছি, যেটুকু আমি দেখাতে চাই। মাত্র ১৯ বছর বয়সে আমি মোটা হলে লোকে যা খুশি তা–ই বলতে লাগল। আর আমি তাতে ব্যাপক আহত হয়ে ঘুমুতে গেলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে লিখে ফেললাম “বুটিলিসিয়াস”।
আমি সব সময় আঘাত, ক্ষোভ, ব্যর্থতা আর শোককে শক্তিতে পরিণত করাকে কেবল বাগ্ধারা হিসেবে নিইনি, বিশ্বাস করেছি। আর তাই করেই প্রতিবার নতুন শক্তিতে উঠে দাঁড়িয়েছি। আমার সেরা কাজগুলো সেভাবেই হয়েছে। আমি সব সময় পশ্চিমা ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে কৃষ্ণাঙ্গদের অবদান নতুন করে লিখতে চেয়েছি। বিশ্বের ইতিহাসে নারীর অবদান নতুন করে রচনা করতে চেয়েছি।’
ছোটবেলার কথা মনে করে বিয়ন্সে বলেন, ‘আমার মায়ের একটা সেলুন ছিল। আমি প্রায়ই সেখানে বসে থাকতাম। সেখানে বিভিন্ন শ্রেণি– পেশার লোক আসতেন। তাঁদের একজন ছিলেন অপেরা শিল্পী। তিনি বিশ্বের নানা দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। যখনই চুল কাটাতে আসতেন, গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসতেন। আর আমি গল্প শুনতে ভালোবাসতাম। তাঁর কাছ থেকে গল্প শুনে মনে মনে সংকল্প করেছিলাম, আমিও একদিন বিশ্ব ভ্রমণ করতে চাই।’
বিয়ন্সে আরও বলেন, ‘আমার মা কেবল চুল কাটত না। প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলত। তাঁদের সুখ, দুঃখের অংশীদার হতো। আমি নিজেও এমন একটা স্পেস তৈরি করতে চাই, যেখানে নারীরা সবাই নিজেদের গূঢ় কথাগুলো একজন আরেকজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পারবে। একে অন্যের শক্তিকে জাগিয়ে তুলবে। সবার জীবনের গল্প এক সুতায় বাঁধার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতার বিস্ফোরণ ঘটবে।’
ছবি: বিয়ন্সের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল