আজ আমি ধনী বলে...

আঁকা: সাদমান মুন্তাসির
আঁকা: সাদমান মুন্তাসির

ফেসবুকে একটা শ্রেণি অদ্ভুত খেলায় নেমেছে। একটা ইভেন্ট খোলা হয়েছে। নাম ‘আজ আমি গরিব বলে...’! সেখানে দুনিয়ার বাঙালি এককাট্টা হয়ে নিজেদের দারিদ্র্য জাহির করছে! আজ তারা গরিব বলে কী হচ্ছে আর কী হচ্ছে না, তারই ফিরিস্তি! নিম্নমধ্যম আয়ের একটা দেশের মানুষ এভাবে যেচে গরিব হয়ে যাচ্ছে, বিষয়টা চিন্তার!
এসব দেখে আমি নিজেও একটা খেলা খেলতে শুরু করলাম, ‘আজ আমি ধনী হলে...’ খেলা! কী করতাম আমি আজ ধনী হলে? প্রথমেই অফিসের কাছাকাছি একটা ভালো মানের হোটেল ভাড়া করে ফেলতাম। অনেক সময় এমন হয়, সারা দিন কাজ করে লোকাল বাসে ঝুলে বাসায় ফিরতে ইচ্ছা করে না। যেদিন এমন ইচ্ছা করবে, সেদিন হোটেলে থেকে যাব। পরদিন আরামসে অফিসেও যাওয়া যাবে।

পরক্ষণেই মনে হলো, হোটেল ভাড়া না করে বরং একটা গাড়ি কিনে ফেলি। গাড়ি কিনলেই যাতায়াত কষ্টের সমাধান। প্রতিদিন বাসের পেছনে দৌড়াতে হবে না। গাড়িতে উঠেই এসি ছেড়ে রবীন্দ্রসংগীত শুনতে শুনতে বাড়ি ফিরব! কিন্তু গাড়ি তো কেনাই যায়। যেহেতু আমি ধনী, সেহেতু অফিসের সামনে একটা বাড়ি কিনে ফেলি না কেন? ভালো হবে। অফিসের সামনেই বাড়ি। বাড়ির সামনে অফিস। যাব আর আসব। খাব আর ঘুমাব!

আচ্ছা, আমি অফিসের কথা ভাবছি কেন? আমি ধনী হলে এই অফিসেই বা চাকরি করব কেন? আমার চাকরি হবে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। কিন্তু সমস্যা হলো, তখন অফিস অন্য এলাকায় হতে পারে। আবার নতুন করে বাড়ি কেনাটেনার ঝামেলায় জড়াতে ইচ্ছা করছে না। ধনীদের এত ঝামেলা ভালো লাগে, বলুন? আমি বরং বাড়ি না কিনে অফিসটাই কিনে ফেলি। নিজের অফিস, যখন যা খুশি তা-ই করা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ।

অফিসটা কিনেই বিপাকে পড়লাম। অফিস যদি কিনি, তার সামনে যদি বাড়ি হয়, তা হলে তো ঝামেলা মিটল না। তারপরও তো আমাকে প্রতিদিন ঘুম থেকে জেগে কষ্ট করে অফিসে যেতে হবে। তার চেয়ে বরং অফিসটাই বাড়িতে নিয়ে আসি। ব্রাশ করতে করতে জব লিস্ট দেখা যাবে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথা বলা যাবে। আরাম আর আরাম।

কিন্তু নিজের শোবার ঘরে ক্লায়েন্ট আসার ব্যাপারটা ঠিক মানতে পারলাম না। তা ছাড়া অন্যের অফিস কিনে আসলে কোনো লাভও নেই। আমি ধনী, আমার অনেক টাকা; চাইলেই যেকোনো ব্যবসা করতে পারি! ইয়েস, আমি ব্যবসা করব!

কী ব্যবসা করা যায়? একটা চায়ের দোকান দিলে মন্দ হয় না। দেশি-বিদেশি সিগারেট রাখতে হবে। চা রাখতে হবে কয়েক রকমের। সাথে পানও থাকা চাই। তবে বাকিতে দেওয়া যাবে না, তা হলেই লস। গলির করিম মিয়া চায়ের দোকান করত। বাকি দিতে দিতে এখন সে চায়ের দোকানে চা বানানোর কাজ করে। দিনে ৫০ টাকা বেতন।

গরিবের মতো চায়ের দোকানের ব্যবসার কথা ভাবছি দেখে নিজেই অবাক হলাম। আমার সঙ্গে এটা যায়? ধনীদের সঙ্গে চায়ের দোকানের ব্যবসা যায় না। অতএব ধনীদের ব্যবসার কথা ভাবতে হবে। আমি বরং মোবাইল ফোনের বিজনেস করি। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে দামি জিনিস। গলির মোড়ে একটা মোবাইল হ্যান্ডসেটের দোকান দিয়ে দিলাম। ভালো ব্র্যান্ডের কয়েকটা মোবাইল ফোন রাখার পাশাপাশি বেশি করে চায়নিজ মোবাইল ফোন রাখতে হবে। সঙ্গে ভিডিও ট্রান্সফারের ব্যবস্থাও। কাস্টমাররা যাতে ফিরে না যায়, কাস্টমার হলো ঘরের লক্ষ্মী। ঘরের লক্ষ্মীকে অবহেলা করতে নেই।

পরক্ষণেই মনে হলো, ধুর! মোবাইল ফোনের দোকানের বিজনেস তো গরিবের। আমি বরং একটা মোবাইল হ্যান্ডসেট কোম্পানি দিয়ে ফেলি। একটা আইফোন কোম্পানি দিলে কেমন হয়?

নিজেই বুঝলাম, একটা যুগান্তকারী ব্যবসার আইডিয়া ভেবে ফেলেছি! তবে ভেবে ঠিক জুত পাচ্ছি না। আমার এক বন্ধু আছে। নাম রহিম। তার ব্যবসা-জ্ঞান অসম্ভব ভালো। তাকে যদি দুই হাজার টাকা দামের নষ্ট চায়নিজ ফোন দিয়ে বলা হয়, ‘যাও, এটা বিক্রি করে দিয়ে আসো।’

সে এক দিনের জন্য উধাও হয়ে যাবে। ফিরে এসে মুখ কালো করে বলবে, ‘না রে ভাই, বাজার খুব একটা ভালো না। আশানুরূপ দাম পাইলাম না। এমন হইলে মানুষ ব্যবসা করব ক্যামনে!’

তখন আপনি খুব আপসেট হয়ে জিজ্ঞেস করবেন, ‘কত বিক্রি করেছ?’

সে মুখ আরও কালো করবে বলবে, ‘মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা। এর বেশি পারলামই না!’

রহিমের সঙ্গে আলাপ করা প্রয়োজন। তাকে ফোন দিলাম, ‘দোস্ত, আমি ব্যবসা করব।’

: কিসের ব্যবসা?

: আইফোনের।

: কিসের?

: আইফোনের, অ্যাপলের আইফোন।

: ক্যামনে?

: ধর, আমি আইফোন বানাব। সারা পৃথিবীতে বিক্রি হবে। আমার পকেটে টাকা আসবে, আর নাম-ডাক-খ্যাতি ছড়াবে সারা বিশ্বে।

: আইফোনের এই ব্যবসা করা যাবে না।

: কেন যাবে না? আমার টাকার অভাব নাই। কত টাকা লাগবে?

: টাকার ব্যাপার না।

: তো কিসের ব্যাপার? ক্ষমতার? কোন মন্ত্রীকে দিয়ে ফোন করাতে হবে, বল শুধু।

: না, এই সবও ব্যাপার না। আইফোনের ব্যবসা করা যাবে না।

: তা হলে কী ব্যাপার? কেন আমি আইফোনের ব্যবসা করতে পারব না?

: যে কারণে তুই কখনো রবীন্দ্রসংগীত নিজে লিখতে পারবি না, সেই কারণে তুই কখনো আইফোনের ব্যবসা করতে পারবি না!

ফোনটা রেখে দিলাম। বোকা ছেলে। আইফোনের ব্যবসা সম্পর্কে সে ভাবতেই পারছে না। ওর আর দোষ কী? মানুষের চিন্তাশক্তি তো টাকার ওপর নির্ভর করে। আইফোনের ব্যবসার সম্ভাবনা নিয়ে সে ভাববে কীভাবে? সে তো এত ধনী না। যা হোক, আইফোনের কোম্পানি আমি দিচ্ছিই।

কিন্তু কার সঙ্গে কথা বললে ঠিক পরামর্শ পাব, বুঝতে পারছি না। এই মুহূর্তে বাংলাদেশি কেউ আইফোনের ব্যবসা করছে না। তাই কেউ জানবে বলেও মনে হয় না। আমার কী ইউএসএতে গিয়ে স্টিভ জবসের সঙ্গে কথা বলা উচিত? তিনিই আমাকে সঠিক পরামর্শ দিতে পারবেন। তখনই মনে পড়ল, বেচারা তো মারা গেছেন! তার মানে এই মুহূর্তে আমাকে পরামর্শ দেওয়ার মতো দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি পৃথিবীতে বেঁচে নেই। প্রথম ব্যক্তিটি এখনো বেঁচে আছে এবং সেটি আমি। তাই নিজেকে দাঁড় করালাম নিজের সামনে। আমি এবং আমি দুজন মুখোমুখি। বললাম, ‘এখন কয়টা বাজে?’

: তিনটা।

: রাত না দুপুর।

: রাত।

: সকাল হয় কয়টায়?

: সাড়ে পাঁচটায় বা ছয়টায়, শিওর বলতে পারব না। ঘুমে থাকি।

: যদি ছয়টায় সকাল হয়, তা হলে সকাল হতে আর কত দেরি?

আমার প্রশ্নে আমি আঙুলের কর গোনা শুরু করলাম, তিনটা, চারটা, পাঁচটা, ছয়টা...

: তিন ঘণ্টা।

: অফিস কয়টায়?

: নয়টায়।

: উঠতে হয় কয়টায়?

: সাতটায়।

: তা হলে আর কয় ঘণ্টা বাকি?

: চার ঘণ্টা।

: বেকুব, আজেবাজে চিন্তা না করে জলদি ঘুমা! ঠিক সময়ে অফিসে যেতে না পারলে বেতন কাটা যাবে। তখন মাস শেষে না খেয়ে ‘আমি আজ ধনী হলে কী করতাম’—এটা ভেবে রাত কাটাতে হবে।

: আমি তো সেটাই করছি!