আট আনার শিঙাড়া!

সময় চলে গেছে ২৮ বছর৷ সাত টাকা কেজির ময়দা হয়েছে ৪০ টাকা৷ আলুর দাম উঠেছিল ৪০ টাকা কেজি, তেলের দাম ৪০ টাকা লিটার থেকে হয়েছে ১২০ টাকা, কিন্তু সুবল ২৮ বছর ধরে আট আনায় শিঙাড়া বিক্রি করেন৷ ২৭ বছর আগে যেমন করে সকালে শিঙাড়ার ভার কাঁধে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতেন, নয় কিলোমিটার পথ হেঁটে দিঘা হাটে যেতেন—এত বছরে এক দিনও এর ব্যতিক্রম হয়নি৷ তবে তিনি সমাজের একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ৷ বেশি টাকাপয়সা না থাকলেও যে মানুষ সুখী হতে পারে, সুবল তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন৷ তাঁর মুখের হাসি কখনো ম্লান হয় না৷
সুবলের পুরো নাম সুবল চন্দ্র দাস (৬২)৷ বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানী পূর্বপাড়া গ্রামে৷ পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন৷ প্রথম জীবনে দিনমজুর ছিলেন৷ কিন্তু বিয়ে করার পর আর ওই কাজে সংসার চলত না৷ তাঁর অবস্থা দেখে প্রতিবেশী শ্যামল সরকার তাঁকে ছোটখাটো ব্যবসা করার জন্য ৫০ টাকা পুঁজি দেন৷ সুবল তা দিয়ে আড়ানী বাজারে ডিমের দোকান করেন৷ তিনি দেখলেন, শীতের সময় ডিমের ব্যবসা ভালো চলে, কিন্তু গ্রীষ্মে চলে না৷ তখন তিনি শিঙাড়ার ব্যবসা শুরু করলেন৷ সেই থেকে শুরু৷ আজও সেই শিঙাড়া আছে৷ তবে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আলুর চপ ও পিয়াজু৷
প্রতিদিন ভোরে স্ত্রী আশা রানী দাস, মেয়ে সপ্তমী, রুমা, ঝুমা, সুমি, ছেলে ষষ্ঠী চন্দ্র দাস ও ছেলের বউ তৃপ্তি রানী দাসকে নিয়ে সুবল শিঙাড়া তৈরি করতে বসেন৷ সন্ধ্যারাতেই আলুর ভাজি তৈরি করে রাখা হয়৷ ভোরে উঠে শুরু করেন শিঙাড়া তৈরির কাজ৷ ক্ষিপ্র হাতে কাজ করেন সবাই৷ আশা রানী অথবা সুবল নিজেই রুটি তৈরি করেন ৷ আর সবাই শিঙাড়া বানাতে থাকেন৷ সকাল ১০টার মধ্যে তাঁরা প্রায় ৫০০ শিঙাড়া তৈরি করে ফেলেন৷ এই কাজ করে ইতিমধ্যে চার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন৷ কয়েক দিন আগে এক সকালে সুবলের বাড়িতে গিয়ে মনে হয়েছে, শিঙাড়া তৈরি উৎসব চলছে৷
সকালে কাঁচা শিঙাড়ার ভার নিয়ে বের হয়ে পড়েন সুবল৷ সপ্তাহে ছয় দিনই দোকান নিয়ে গ্রামের বিভিন্ন হাট-বাজারে যান তিনি৷ হাটে গিয়ে শিঙাড়া ভেজে গরম গরম বিক্রি করেন৷
একই বাজারে তিন টাকার শিঙাড়া বিক্রি হচ্ছে৷ আর সুবল বিক্রি করেন আট আনায়৷ আকারে তাঁর শিঙাড়া ছোট, কিন্তু খদ্দের বেশি৷ এত বছর ধরে আট আনায় কীভাবে শিঙাড়া বিক্রি করেছেন—জানতে চাইলে সুবল বলেন, তিনি হিসাব করে দেখেছেন, কম দামের শিঙাড়ার খদ্দের বেশি৷ তাঁর অল্প লাভ হয়, কিন্তু বেশি বিক্রির কারণে পুষিয়ে যায়৷ আলাপের ফাঁকে সুবল শোনালেন তাঁর নিজস্ব দর্শনের কথা৷ সংসার চলার মতো কিছু হলেই হয়৷ শুধু টাকাপয়সা তো আর মানুষকে শান্তি দিতে পারে না৷ সুবল ছেলের বিয়েতে কোনো যৌতুক নেননি; যদিও মেয়ের বিয়েতে যৌতুক দিতে বাধ্য হয়েছিলেন৷
সব জিনিসের দাম বেড়েছে৷ বাজারে বেশি দামের শিঙাড়া বিক্রি হচ্ছে৷ তিনি তাঁর শিঙাড়ার দাম সামনে এক টাকা করার কথা ভাবছেন৷