আত্মহত্যার চিন্তা ঝেড়ে সফল হয়েছেন তাঁরা

মন খারাপের অনেক কবিতাই এখানে উদাহরণ হিসেবে আনা যেতে পারে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কবি শ্রীজাতের একটি কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করা যাক।

‘…কেবল মুঠোয় বন্দী কফির একলা কাপ/ ডিপ্রেশনের বাংলা জানি। মনখারাপ।’ এই যে ডিপ্রেশন, তা তো আর একবিংশ শতাব্দীর নতুন কিছু নয়। মানুষ হতাশায় ভোগে, দুশ্চিন্তায় থাকে, নিজের জীবনটা যাপনের অর্থ খুঁজে পায় না—এসব অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই হয়।

হাল আমলের তারকা যাঁরা, যাঁদের সফল মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাঁদের অনেকেই এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। অবসাদে ভুগে অনেকেই আত্মহত্যা করতে গিয়েছেন। তবে নিজেকে নিঃশেষ করার মিশন থেকে পিছু হটে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা। নিজেকে চিনিয়েছেন সারা পৃথিবীর কাছে। তেমনই কয়েকজনের কথা বলব আজ।

যুক্তরাষ্ট্রের সাঁতারু মাইকেল ফেল্‌প্‌সের কথাই ধরুন। অলিম্পিক গেমসের ইতিহাসের অন্যতম সফল ক্রীড়াবিদ তিনি। একটা সময় তিনিও ভুগেছেন অবসাদে। বলিউডের নায়িকা দীপিকা পাডুকোনের মুখেও একই কথা শোনা গেছে। মার্কিন পপ তারকা লেডি গাগা বলেছিলেন, খ্যাতি তাঁকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এমন পদক্ষেপ নিতে গিয়েছিলেন বিখ্যাত লেখক জে কে রাউলিংও।

সফল সাঁতারুর কষ্টের সময়

মাইকেল ফেল্‌প্‌স

মাইকেল ফেল্‌প্‌স তাঁর ডিপ্রেশন নিয়ে একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সিএনএন বলছে, সবিস্তারে সেখানে এ বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রতিটি অলিম্পিকের পর আমি একটা বড় ধরনের ডিপ্রেশনে পড়তাম।’ ঠিক কোন সময়টা ডিপ্রেশনে নিমজ্জিত হতেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে এ কথা বলেছিলেন তিনি। নিজের ডিপ্রেশনের সময়টাও চিহ্নিত করে ফেলেছেন তিনি। প্রতিবছর ঠিক অক্টোবর, নভেম্বরে এ সমস্যা হয় তাঁর।

যা হোক, ডিপ্রেশন একটি মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, তার উদাহরণ ফেল্‌প্‌স। ২০১২ সালের অলিম্পিকে তিনি অসাধারণ পারফর্ম করেছিলেন। এরপরই পুলকে জানান টা টা, হঠাৎ অবসরের ঘোষণা দিলেন। কারণ, তখন তিনি মহা অবসাদে পড়েছিলেন। সেই সময় তিন থেকে চার দিন ঘর থেকে বের হননি। খাওয়াদাওয়া করেননি। ঘুমোতেও পরেননি ঠিকঠাক। জীবন নিয়ে একধরনের বিতৃষ্ণায় ছিলেন, তবে ফেল্‌প্‌স জানতেন তাঁর সাহায্য দরকার। আর কাছের মানুষের সাহায্য নিয়েই বের হয়ে আসতে পেরেছিলেন সেই ভয়ংকর ভাবনা থেকে। নিয়েছিলেন চিকিৎসা। পরে আবার খেলায় ফিরেছেন, তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।

ফেল্‌প্‌স বলেন, ‘আমার ধারণা, এখন মানুষ বুঝতে পরেছে, ডিপ্রেশন বলে একটা বিষয় সত্যি সত্যি আছে। এখন তারা এটা নিয়ে কথা বলছে। এটা নিয়ে কথা বলেই মানুষ অবসাদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।’

দীপিকা পাড়ুকোন

অকপট দীপিকার খারাপ সময়

২০১৩ সাল। তত দিনে ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’, ‘গোলিও কি রাসলীলা রামলীলা’, ‘ইয়ে জাওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’র মতো হিট ছবিতে অভিনয় করে ফেলেছেন দীপিকা। এর পরের বছরই অবসাদে আচ্ছন্ন হন তিনি। তাঁর ভাষ্য, ‘এটা শুরু হয়েছিল ২০১৪ ফেব্রুয়ারিতে। আমি ভয়ংকর এক শূন্যতা অনুভব করছিলাম। কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমার শুধু মনে হচ্ছিল, জীবন অর্থহীন, এর কোনো উদ্দেশ্য নেই। শারীরিক ও মানসিক—কোনোভাবেই কোনো কিছু অনুভব করতে পারছিলাম না। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আমি এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছি।’ তিনি বলেন, এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে তাঁর মা সাহায্য করেছিল।

দীপিকা এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে বেশ কিছু কাজের কথাও বলেছেন। নিয়মিত খাওয়াদাওয়া, শরীরচর্চা, ঠিকঠাক ঘুমের ওপর জোর দিয়েছেন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার কথাও বলেছেন।

আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, বুঝেছেন গাগা

লেডি গাগা

মার্কিন পপশিল্পী লেডি গাগার মতে, মানসিক অসুখ অদৃশ্য একটা ব্যাপার। হয়তো পাশের মানুষটিও বুঝতে পারবে না আপনি এমন সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ সেই অবসাদ থেকেই তিনি আত্মহত্যার কথা ভেবেছেন। সিবিএস সানডে মর্নিং নামের একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘মনে হতো আমি ক্লান্ত, আমি নিঃশেষ হয়ে গেছি।’

নিজের খারাপ সময়ের কথা উল্লেখ করে লেডি গাগা বলেন, ‘আমি নিরাপদে আছি কি না, সেটা নিশ্চিত করার জন্য একসময় আশপাশের মানুষ আমার ওপর দৃষ্টি রাখত।’

এই আশপাশের মানুষই লেডি গাগাকে রক্ষা করেছে। তিনি বলেন, ‘আশপাশের যে মানুষ রয়েছে, তারাই আমাকে উদ্ধার করেছে। তারাই আমাকে বলেছে, “ভাবছ তুমি ডুবে যাচ্ছ। কিন্তু বাস্তবতা আসলে এমনটা নয়। তুমি এখনো অসাধারণ।”’

জনপ্রিয় লেখিকার মৃত্যুভাবনা ছিল

জে কে রাউলিং

‘হ্যারি পটার’। বই হিসেবে আলোচিত। আলোচিত চলচ্চিত্র হিসেবেও। জনপ্রিয় এই বইয়ের লেখক জে কে রাউলিংও খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে গেছেন। সময়টা তাঁর জন্য এতটাই দুঃসময় ছিল যে আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন তিনি।

এমন অন্ধকার সময় রাউলিংয়ের জীবনে এসেছিল তাঁর বিবাহবিচ্ছেদের পর। স্বামী ছেড়ে চলে গেছেন। একা একজন মা যখন লড়াই করে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না, তখন আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে তিনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছেন। নিয়েছেন থেরাপিও।

জে কে রাউলিং কতটা সফল, এর একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। তাঁর বই বিশ্বের ৬৫টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ২০০৮ সালে যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম ইন্ডিপেনডেন্টের এক হিসাব অনুসারে, তাঁর সম্পদের পরিমাণ ৭৫ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি।

কিন্তু জীবনে সম্পদই যে সবকিছু এনে দিতে পারে না, ওপরের এই তারকাদের যেকেউ সেই উদাহরণ হতে পারেন। যা হোক, ফেরা যাক রাউলিংয়ের কথায়। রাউলিংয়ের জনপ্রিয় বইয়ের মধ্যে অন্যতম ‘হ্যারি পটার’। এই বই লেখা শুরুর আগেও তিনি ডিপ্রেশনে পড়েছিলেন। দ্বিধাহীনভাবে সেই কথাগুলো বলেছেন রাউলিং। তাঁর মতে, ‘আমি লজ্জা পাব কেন? আমি সত্যিকার অর্থেই একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছি। আমি এ জন্য গর্বিত যে সেই পরিস্থিতি থেকে আমি বেরিয়ে আসতে পেরেছি।’

এই মানসিক অবসাদ থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি সবার ক্ষেত্রে। আবার শ্রীজাতের কবিতায় ফেরা যেতে পারে। ‘বন্ধুরা সব ফিরছে বাড়ি দূর থেকে.../ কেন যে আজ হিংসে হল তাই দেখে,/ দেখতে গিয়ে সন্ধ্যে হল জানলাতেই/ আগের মত মেঘ করেছে...কান্না নেই’। এমন ভেবে মন খারাপ করে তো আর লাভ নেই। কারণ, প্রত্যেকের নিজের মাপকাঠি থাকে। মানুষ যে যার মতো করে সাজায় তাঁর জীবন। সমস্যা হলে কাছের মানুষের সঙ্গে কথা বলুন। এই পরামর্শই দিচ্ছেন সফল ব্যক্তিরা।