‘আমরা-আমাদের’–এর চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ‘আমি-আমার’

মার্কিন সাংবাদিক ও লেখক মার্টিন ব্যারন দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায়। গত ফেব্রুয়ারি মাসে এই পদ থেকে অবসর নেওয়ার আগে আট বছর তিনি পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন। ২৩ মে যুক্তরাষ্ট্রের সাফোক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন মার্টিন।

৪৫ বছর আগে আমি সমাবর্তন পেয়েছিলাম। সেই স্মৃতি এখন অনেকটাই ঝাপসা। কিন্তু একটা বিষয় আমার স্পষ্ট মনে আছে। ওই সময়টায় আমি আমার কর্মজীবন শুরু করার জন্য অধীর হয়ে ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে দারুণ সময় কাটিয়েছি। অনেক ভালো বন্ধু ছিল। কিন্তু এর বাইরের জীবন নিয়ে বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করছিলাম।

আমি ভীষণভাবে নিজের জীবন, নিজের ভবিষ্যৎ, ভালো চাকরি, নিজের আয়, ব্যয়, সচ্ছল জীবনযাপন নিয়ে ভাবতাম। আমার জগতের সব ভাবনার কেন্দ্রে ছিলাম আমি। আর সহপাঠীদের মতো, নিজের বাইরে আর কোনো কিছু নিয়ে আমি ভাবতে পারতাম না।

পার্থক্য আকাশ-পাতাল

কয়েক মাস আগে চাকরিজীবন থেকে অবসর নিয়েছি। আট বছর দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট–এর সম্পাদকের পদে থাকার পর অবসর নিই। খেয়াল করে দেখলাম, আমার অবসরের পরের চিন্তাভাবনাগুলো থেকে আমার সমাবর্তনের দিনের ভাবনার পার্থক্য আকাশ-পাতাল।

সেই বদলে যাওয়া চিন্তাধারা থেকেই বিদায়ী দিনের নোটে আমি আমার সহকর্মীদের বলেছিলাম, ‘দ্য পোস্ট–এ কাজের সুবাদে আমরা নিজেদের ঊর্ধ্বে গিয়ে আরও বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাই।’

বোস্টন, মায়ামি, নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস—যখন যেখানেই কাজ করেছি, বৃহৎ স্বার্থে কিছু করার তাড়না বরাবরই ছিল। মোদ্দা কথা, বার্তাকক্ষে থাকা আমার সব সাংবাদিক সহকর্মীর মতো আমিও নিজের জীবনের মূল লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছি গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকদের সামনে তাদের প্রাপ্য তথ্য তুলে ধরার মধ্য দিয়ে, সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে; যে পেশায় নিয়োজিত হলে একজনকে হতে হয় সৎ, সাহসী, অবিচল ও কঠোর পরিশ্রমী।

বার্তাকক্ষে কাটানো সময় আমার জন্য শুধু চাকরি ছিল না। ছিল জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেখানেই থাকি না কেন, কাজে বা বিশ্রামে, বার্তাকক্ষে কিংবা পরিবারের সঙ্গে, আমাদের মাথায় সব সময়ই কিছু নীতিবাক্য গেঁথে থাকত। সেগুলো হলো যখন যে প্রতিষ্ঠানেই থাকো, এর অবস্থানকে সব সময় সমুন্নত রাখার চেষ্টা করো। একে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে গড়ে তোলো। এমন কিছু কোরো না, যাতে তোমার প্রতিষ্ঠানের মান হানি হয়। তুমি তোমার প্রতিষ্ঠানের লজ্জার কারণ হয়ো না।

কেউ কোনো দিনও একা এগিয়ে যেতে পারেনি

আমরা এখন এমন একসময়ে বাস করছি, যেখানে সামষ্টিক উন্নয়নের চেয়ে মানুষ ব্যক্তি স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। ‘আমরা-আমাদের’–এর চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ‘আমি-আমার’। আমার চাকরি, আমার ব্যবসা, আমার অভিজ্ঞতা, আমার পার্সোনাল ব্র্যান্ড। এখন তুমি বলতে পারো, ‘তাহলে কি আপনি বলছেন সামগ্রিক স্বার্থে আমি আমার ব্যক্তিত্ব, আমার সত্তাকে উৎসর্গ করে দেব? কথা বলব কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের হয়ে?’

মোটেও না। আমরা কখনোই নিজেদের ব্যক্তিত্ব, নিজস্বতা, সত্তাকে বিলিয়ে দেব না। বরং নিজের ব্যক্তিচিন্তা কীভাবে, কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বা কোন উপায়ে বৃহত্তর স্বার্থে কাজে লাগতে পারে, আমরা সেটা খুঁজে বের করব অথবা তৈরি করব। কেউ কোনো দিনও একা এগিয়ে যেতে পারেনি। আমরাও একা না, এগোব দল বেঁধে।

তোমাদের এসব বলার মানে এই নয় যে তোমাদেরও বৃহৎ স্বার্থে সাংবাদিকতায় যোগ দিতে হবে। তোমাদের এসব বলছি যেন তোমরাও তোমাদের জন্য উপযুক্ত পথটা খুঁজে নিতে পারো। যে পথে তুমি শুধু নিজের স্বার্থে না, বৃহৎ স্বার্থে কাজ করতে পারবে। দল বেঁধে এগোতে পারবে।

সংস্কারের সহযোগী হও

পুলিশ, চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী—যখন আমরা এমন কোনো একটা গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতা পাই, তখন আমরা দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারি। হয় আমরা তাদের প্রতি অনাস্থা দেখাতে শুরু করতে পারি, অথবা আমরা সেই গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের সংস্কারে নামতে পারি। আমি অনুরোধ করব, তোমরা দ্বিতীয় পথটি বেছে নাও, তোমরা সংস্কারের সহযোগী হও।

গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান বলতে আমি শুধু কোনো সংগঠনকেই বোঝাতে চাইছি, ব্যাপারটা এমন নয়। এটা হতে পারে তোমার পরিবার। পরিবার কিন্তু একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানও বটে। তুমি এর ওপর যতটা নির্ভর করো, পরিবারও তোমার ওপর ঠিক ততটাই নির্ভরশীল। তাই তুমি যদি মনে করো, সংস্কারের শুরু পরিবার থেকেও হতে পারে। এরপর ধীরে ধীরে তুমি নিজেকে আরও বড় লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাও।

ইংরেজি থেকে অনুদিত

সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট