আমরা দল বেঁধে স্কেচে বেরোতাম

কাইয়ুম চৌধুরী
কাইয়ুম চৌধুরী
কাইয়ুম চৌধুরী শুধু এ দেশের একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পীই নন, তিনি ছিলেন আমাদের লোক সংস্কৃতির একজন অনুরাগীও। তাঁর আঁকা ছবি যেমন অনবদ্য, তেমনি বাংলা অক্ষরচিত্রণে তাঁর পটুত্ব ছিল অসামান্য। ছিলেন ঢাকা আর্ট কলেজের (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) ছাত্র। পরে চারুকলায় শিক্ষকতাও করেছেন। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত জীবনে আমার যত আনন্দ বইয়ের ‘পঞ্চাশ বছর আগে’ শিরোনামের অনুচ্ছেদে তিনি লিখেছেন তাঁর ছাত্রজীবনের কথা। পয়লা বৈশাখকে সামনে রেখে আজ থাকল এক চারুশিল্পীর কথন। কাইয়ুম চৌধুরীর এই স্মৃতিচারণা নিশ্চয়ই এ সময়ের শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করবে

আর্ট কলেজে আমাদের সিনিয়র যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম ক্লাসটার কথা আমার মনে আছে। ওটা ছিল উডকাটের ক্লাস। আমিনুল ইসলাম, হামিদুর রহমান, আবদুর রহমান ভূঁইয়া—এঁরা সব কাজ করছেন। হামিদ একটি কাঠের হাতুড়ি দিয়ে বাটালির মাথায় ঠক ঠক করে কাঠের ওপর মারছেন। আমরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রয়েছি। কী রকম ছবি হচ্ছে এটা!

আমিনুল থাকতেন সিদ্ধেশ্বরীতে। আমিও। তাঁর একটা সাইকেল ছিল। মাঝেমধ্যে আমাকে সামনে বসিয়ে স্কুলে চলে আসতেন। তাঁর সঙ্গে বহুবার আউটডোর স্কেচে গিয়েছি। তাঁর কাজের ধরন কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। তিনি আমাকে নানা কলাকৌশল দেখাতেন। বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর কাছে মাঝেমধ্যে বাইরে থেকে কাগজপত্র আসত। বোম্বে থেকে ক্রসরোড বলে একটা কাগজ আসত। আমাকে পড়তে দিতেন। আমার মধ্যেও ওই ধরনের একটা মত আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে। আজ প্রগতিশীল যে ভাবধারায় আমি জারিত হয়েছি, তার পেছনে আমিনুলের অবদান প্রায় শতভাগ।
সিদ্ধেশ্বরী থেকে সদরঘাট আসতাম। সারা দিন আর্ট স্কুলে কাজ করতাম। তখন ওল্ডকোর্ট হাউসে একটা চায়ের দোকান ছিল মোহান্ত নামে একটা লোকের। তার ওখানে এক আনা দামের শিঙাড়া পাওয়া যেত। এক আনার এক কাপ চা, আর সন্দেশ এক আনা। তিন আনা হলে ভালো রকমের খাওয়াদাওয়া হয়ে যেত। কিন্তু তিন আনা সব সময় থাকত না পকেটে। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সচ্ছল অবস্থা ছিল রশিদ চৌধুরীর। আমরা মাঝেমধ্যে রশিদ চৌধুরীকে খুব পাম্প-টাম্প দিয়ে দুপুরের খাওয়াটা খেয়ে নিতাম। আমাদের সঙ্গে বগুড়ার একটি ছেলে পড়ত, আমিনুর রহমান। বিএ পাস করে আমাদের সঙ্গে ভর্তি হয়েছিল। খুব সুদর্শন। আমরা তাকে বলতাম প্রমথেশ বড়ুয়া। একদিন দেখি, মোহান্ত কাঁচুমাচু হয়ে আবেদিন সাহেবের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে। বললাম, ‘কী ব্যাপার?’ আবেদিন সাহেবের কাছে কী একটা নালিশ আছে। পরে শুনলাম, তিন আনা করে খেয়ে আমিনুর রহমান ৭৫ টাকা বাকি ফেলেছে! টাকাটা সে আদায় করতে পারছে না। আবেদিন সাহেব আমিনুর রহমানকে বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমার স্কলারশিপের টাকা থেকে ওটা আমি ওকে দিয়ে দেব।’ এভাবে বোধ হয় ব্যাপারটার ফয়সালা হয়েছিল।

তরুণ কাইয়ুম চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
তরুণ কাইয়ুম চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিল মুর্তজা বশীর। তখন সে বামপন্থী রাজনীতিতে দীক্ষিত। পোস্টার লিখছে, রাত্রিবেলায় ঘুরে ঘুরে নিজেই দেয়ালে সাঁটছে। একসময় সে পুলিশের হাতে ধরা পড়ল, জেলে গেল। বশীরের সাহিত্যপ্রীতি ও চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছিল। সুরেলা কণ্ঠে হিন্দি সিনেমার গান গুনগুন করে গাইত। অশোককুমার ছিল তার প্রিয় নায়ক। অশোককুমারের অনেক ছবির সংলাপ সে মুখস্থ বলত। সেই সঙ্গে তার চোখের চশমা খোলার ঝটিতি পোজ মুগ্ধ চোখে দেখতাম।
স্কলারশিপের ৩৫ টাকা পেয়েছি। বশীরকে বললাম, ‘চল, রং কিনব, ওয়ার্সী বুক সেন্টারে।’ গেলাম আরমানিটোলায়। দোকানে ঢুকে বই দেখে মাথা ঘুরেই গেল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তখন আমার খুব প্রিয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে বইয়ে হাত দিই, বশীর মানা করে। বলে, ‘ধুর, ওটা কিনিস না, আমার কাছে আছে, অন্য বই দ্যাখ।’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা বইও কিনতে পারলাম না। তাঁর সংগ্রহ থেকে পড়তে পারব। অসম্ভব ভালো গল্প লিখতেন। কবিতাও লিখতেন। পরিচয় ও নতুন সাহিত্য-এ তাঁর কবিতাও প্রকাশিত হয়েছিল।
আমরা দল বেঁধে স্কেচে বেরোতাম। কলেজ ছুটি হতো বিকেল চারটায়। কলেজ থেকে বেরিয়ে আমরা ফুলবাড়িয়া স্টেশনে বসতাম। সেখানে ঘণ্টা তিন-চার স্কেচ করে রাত্রিবেলা ফিরতাম ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে।
শিক্ষকদের ছবি ছাড়া তখন অন্য কোনো ছবি দেখার কোনো সুযোগ হয়নি। ছবির সাইজ কত হবে, কী হবে না হবে—এ সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। ওয়াটার কালার বা স্কেচ আজকে ২০/৩০ সাইজের যে কাগজ, তার কোয়ার্টার শিটে আঁকতাম। ১৫/১০-এর ওপরে আমরা ছবি আঁকতাম না। ছবি কত বড় হতে পারে আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না। রশিদ চৌধুরীকে দেখেছি, সে জলরঙে খুব দ্রুত কাজ করত। তার সবকিছুতেই একটা দ্রুততা। তবে কামরুল ভাইয়ের মতো দ্রুত নয়। জলরং করতে গিয়ে সে হয়তো কাগজে রং চাপাচ্ছে, ওয়াটার কালার প্যালেটে পানি দিয়ে রং গুলছে। অনেক সময় একেবারে পুরো টিউবটা কাগজের ওপর ঢেলে কাগজের ওপরই সে ওই রংটাকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তাতে নতুন একটা মাত্রা আসত। কাজ করতে করতে আমরা শেষে এমন একটা জায়গায় এলাম, তার কিছুই চিনি না। তখন পড়ন্ত বিকেল। হেঁটে হেঁটে একটু এগিয়ে দেখি হাট বসেছে। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভাই, জায়গাটার নাম কী?’ উত্তর পেলাম, টঙ্গী। রামপুরা থেকে টঙ্গী! শোনার সঙ্গে সঙ্গে পায়ে খিল ধরে গেল। হাঁটার শক্তি নেই। জিজ্ঞাসা করলাম, টঙ্গী রেলস্টেশনটা কোন দিকে। হদিস নিয়ে সোজা স্টেশন। রাত নয়টার ট্রেনে ঢাকায় ফেরত। তখন অদ্ভুত নেশা ছিল ছবি আঁকার। বিশেষ করে জলরং।