আমরা যাঁরা টিউশনি করতাম

অনেক শিক্ষার্থী আবার নতুন করে টিউশনি খুঁজছেন। প্রতীকী ছবিতে মডেল হয়েছেন মির্জা
ছবি: সুমন ইউসুফ

মাসের শেষে ছাত্র পড়াতে গেলে একটু আনমনা হয়ে যেতেন আসিফুর রহমান। বারবার আড়চোখে দরজার দিকে তাকাতেন আর ভাবতেন, আজ কি নাশতার সঙ্গে খামটা আসবে! খামের ভেতর যে চার হাজার টাকা আসে, ধারদেনা শোধ করেই তার অনেকখানি চলে যায়। তবু টিউশনির এই আয় ছিল তাঁর বড় সম্বল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী আসিফুর রহমান বলছিলেন, ‘করোনার আগে দুইটা টিউশনি করতাম। ৯ হাজার টাকা পেতাম। করোনার মধ্যেও একজনকে অনলাইনে বেশ কিছুদিন পড়িয়েছি। নভেম্বর মাসে মানা করে দিল। এরপর থেকে কাজ খুঁজছি।’

দেশের সরকারি-বেসরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক শিক্ষার্থীর হাতখরচের টাকা আসে টিউশনের আয় থেকে। কেউ কেউ নিজের খরচ চালানোর পাশাপাশি পরিবারের জন্যও কিছু টাকা খরচ করতেন। আসিফের মতো অনেক শিক্ষার্থীই করোনাকালে টিউশনি হারিয়েছেন। এখন কেমন আছেন তাঁরা?

সুযোগ কম, বেতনও কম

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস ছোটবেলা থেকে একটু স্বাধীনচেতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর মনে মনে ঠিক করেই নিয়েছিলেন, নিজের খরচ নিজে চালাবেন। তাই প্রথম বর্ষ থেকেই টিউশনি করতেন। ক্যাম্পাস যেহেতু পুরান ঢাকায়, সেখানে ছাত্রছাত্রী পাওয়া একটু কঠিন ছিল। তার ওপর করোনা এল বড় আঘাত হয়ে। জান্নাতুল ফেরদৌস বলছিলেন, ‘মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমার দুইটা টিউশন চলে গেল হঠাৎ করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই। সবাই মেস থেকে চলে গেলাম। দুই মাস পরেও যখন পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হলো না, শুরুতে আমি বাড়ির আশপাশে টিউশন শুরু করি। কারণ, ঢাকায় না থাকলেও বাসা ভাড়া দিতে হচ্ছিল। দীর্ঘদিন বাড়িতে থেকে সেপ্টেম্বরে ঢাকায় ফিরি। সে সময় আমার হাতে একটা টিউশনও ছিল না। বাড়ি থেকে টাকা এনে খুব কষ্ট করে চলতে হয়েছে। অক্টোবর মাসে অল্প টাকার একটা টিউশনি পাই, সেটাও বাসা থেকে অনেক দূরে। তবু অনেক কষ্ট করে টিউশনিটা চালিয়েছি দুই মাস। সম্প্রতি অবশ্য দুটি টিউশনি পেয়েছি।’

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ বলে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় থাকতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। যে যেখানে থাকছেন, তার আশপাশেই টিউশনি খোঁজার চেষ্টা করছেন। পাড়ার দোকানদার কিংবা পরিচিতজনদের মাধ্যমে খোঁজ করছেন অনেকে। এ ছাড়া ক্যাম্পাসভিত্তিক বিভিন্ন টিউশনি গ্রুপ ও গৃহশিক্ষক খুঁজে দেওয়ার প্রতিষ্ঠানের (টিউশনি মিডিয়া) মাধ্যমে অনেক শিক্ষার্থীকে টিউশনি নিতে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে অবশ্য অনেক সময় প্রথম মাসের পুরো বা অর্ধেক বেতন ‘মিডিয়াকে’ দিতে হচ্ছে। আবার দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অভিভাবকদের টিউশনে আগ্রহ নেই। বেতন আগের থেকে কম।

পরিবারের ওপর বাড়তি চাপ

কথা হলো দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রাবেয়া খাতুনের সঙ্গে। জিনতত্ত্ব এবং উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘দিনাজপুরের মতো শহরে অভিভাবকেরা সন্তানের টিউশনির পেছনে বেশি খরচ করতে চান না। আমাদের ক্যাম্পাস যেখানে, সেখান থেকে অনেক দূরে গিয়ে টিউশনি করতে হয়। আগে তবু টিউশনি পাওয়া যেত। করোনা সংক্রমণের পরপর স্বাভাবিকভাবেই অভিভাবকেরা বাসায় পড়ানো বন্ধ করে দেন। স্কুল বন্ধ বলে এখনো টিউশনি খুব একটা পাওয়া যাচ্ছে না।’

রাবেয়ার বন্ধুবান্ধবের অনেকে গত বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত অনলাইনে পড়ানোর সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ছেলেমেয়েরা ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে বলেই হয়তো অনেক অভিভাবক এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাসায় পড়াতে চাইছেন। কিন্তু ক্যাম্পাসের বাইরে থাকা-খাওয়া-যাতায়াতের পেছনেই বেতনের অনেকখানি খরচ হয়ে যায়। তাই শিক্ষার্থীরাও দ্বিধায় আছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী দীপক চন্দ্র বর্মণ। পাঁচ সদস্যের পরিবারে তাঁর বাবাই একমাত্র উপার্জন করেন। গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড় থেকে দীপক এ মাসেই ঢাকায় ফিরেছেন। দীপক বললেন, ‘করোনার আগে আমার দুটি টিউশনি ছিল। সেখান থেকে মোটামুটি ১০-১২ হাজার টাকা আসত। কিন্তু করোনায় বাড়ি ফিরলাম। দীর্ঘদিন বাড়িতে থাকায় পরিবারের ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে। তাই আবার ঢাকায় ফিরে এসেছি। বাড়ি থেকে টাকা এনে আপাতত থাকতে হবে। দ্রুত আবার নতুন করে টিউশন খোঁজার চেষ্টা করছি।’

অন্য কাজের খোঁজ

টিউশন হারিয়ে অনেক শিক্ষার্থী এখন অন্য আয়ের উপায় খুঁজছেন। ছোটখাটো ব্যবসা করছেন কেউ কেউ। ঢাকার স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ছাত্র নাজমুস সাকিব যেমন একটা অনলাইন দোকান চালু করেছেন। কিন্তু ব্যবসার পেছনে প্রচুর সময় দিতে হয়। ক্যাম্পাস খুললেও কাজটা চালিয়ে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে দ্বিধায় আছেন। সাকিব বললেন, ‘টিউশনির সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল, নিজের সুবিধামতো সময়ে তা করা যেত। ক্লাসের সঙ্গে মিলিয়ে সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে ছাত্র পড়াতাম। বাকিটা সময় আমি আমার পড়ালেখা করতাম। কিন্তু ব্যবসার তো কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই।’

কথা হলো আরও কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। একেকজনের পরিস্থিতি একেক রকম। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মোসাদ্দেক হোসেন যেমন হল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর টিউশনিগুলো বন্ধু ও ছোট ভাইদের দিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন। এখন আবার নতুন করে টিউশনি খুঁজছেন। রংপুর কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থী আকাশ অনলাইনেও পড়িয়েছেন। এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাসায় গিয়ে পড়াতে শুরু করেছেন, কিন্তু তাঁর বেতন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, শিগগিরই হয়তো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। ক্যাম্পাস খুললে, বন্ধুবান্ধব ও শিক্ষকদের সঙ্গে আবার নিয়মিত দেখা হলে নিশ্চয়ই ভরসা আর সাহস মিলবে। আবার হয়তো পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারবেন তাঁরা।