আমাদের বিয়ের কোনো কাবিননামা নেই
পাঠকের প্রশ্ন বিভাগে আইনগত সমস্যা নিয়ে নানা রকমের প্রশ্ন পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।
আমার বয়স ৩৩ বছর। আমি আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী। তাঁর প্রথম ঘরে স্ত্রী এবং ২৪ বছর বয়সী একটি ছেলে আছে। তিন বছর আগে সব জেনেশুনে আমার সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর ২০১৯ সালে একটি বাসা ভাড়া করে আমরা একত্রে বসবাস শুরু করি। এর কিছুদিন পর ধর্মীয় মতে আমাদের বিয়ে হয়। এ বিয়েতে বিশেষ কেউ উপস্থিত ছিল না। আমার স্বামীর গাড়িচালক এবং দুজন ব্যক্তিগত দেহরক্ষী সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। কোনো ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান করা হয়নি।
আমার স্বামী বেশির ভাগ সময় তাঁর প্রথম পক্ষের স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে থাকেন। সপ্তাহে দুদিন আমার বাসায় আসেন। ২০১৯ সালে তিনি ব্যবসার কাজে ইউরোপ গেলে তখন আমাকে সঙ্গে নিয়ে যান। সে সময় একসঙ্গে দুই সপ্তাহ ছিলাম। কিন্তু এখন তিনি আমার বাসায় খুব কম আসেন। আমাদের ধারণা, কোনোভাবে তাঁর প্রথম স্ত্রী আমাদের সম্পর্কের কথা জানতে পেরেছেন এবং তিনি সব সময় আমার স্বামী কোথায় যান না যান, সে ব্যাপারে খোঁজখবর রাখছেন। এ জন্য আমার স্বামী বলেছেন, আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। তিনি তাঁর পরিবারকে আমাদের বিয়ের কথা জানাতে পারবেন না।
২০২০ সালের নভেম্বর মাসে আমাদের একটি পুত্রসন্তান হয়। সব রকমের ভরণপোষণ আমার স্বামী আমাদের দিচ্ছেন। কিন্তু সামাজিকভাবে কোনো স্বীকৃতি আমি বা আমার ছেলে পাইনি। এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যাচ্ছেন। এদিকে আমি আমার ছেলেকে নিয়ে অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছি।
আমার স্বামী আমাকে খুব ভালোবাসেন এবং আমার প্রতি সব দায়িত্ব পালন করেন, তবে তাঁর অনুপস্থিতিতে আমাদের কী হবে, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছি। তাঁর প্রথম স্ত্রী এবং পরিবার কখনো আমাকে এবং আমার ছেলেকে মেনে নেবে না। আমার পরিবারে মা আর ছোট বোন আছে। তারা গ্রামের বাড়িতে থাকে। তাদের জীবনধারণের সব দায়িত্ব আমার স্বামী পালন করেন। কিন্তু কোনো দিন তিনি আমার মা বা বোনের সঙ্গে দেখা করেননি বা আমার দেশের বাড়িতে যাননি।
এখন বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে জানতে পারছি, কাবিননামা না থাকলে বিয়ে বৈধ হয় না। আমাদের বিয়ের কোনো কাবিননামা নেই। আমার স্বামী যদি এ বিয়ে অস্বীকার করেন, তাহলে আমার আর আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
গুলশান, ঢাকা
উত্তর: কাবিননামা বা নিকাহনামা বিয়ের একমাত্র লিখিত প্রামাণ্য দলিল। সুতরাং, বিয়েসংক্রান্ত যেকোনো সমস্যায় এর প্রয়োজন হয়। বিয়েবিষয়ক প্রতারণার সবচেয়ে বেশি শিকার হন নারীরা। রেজিস্ট্রেশন না করায় অনেক ক্ষেত্রে বিয়েটি অস্বীকার করা হয়। সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। স্ত্রী ও সন্তানকে ভরণপোষণ দেওয়া বন্ধ করে দিলে, স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে আরেকটি বিয়ে করলে বা স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেনমোহর থেকে বঞ্চিত করলে বা প্রতারণা করে বিবাহিত থাকা অবস্থায় আর কাউকে বিয়ে করলে স্ত্রীর জন্য বিয়েটি আদালতে প্রমাণ করা অত্যন্ত কষ্টসাপেক্ষ। এসব ক্ষেত্রে স্ত্রী আদালতে কোনো নালিশ করতে চাইলে প্রথমেই বিয়ের প্রমাণ হিসেবে রেজিস্ট্রিকৃত নিকাহনামা আদালতে জমা দিতে হয়।
অন্যদিকে, কেউ নিজের বিয়ে ইচ্ছামতো অস্বীকার করলে বা সন্তানের পিতৃপরিচয় অস্বীকার করতে চাইলে বা সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চাইলে বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়ে থাকলে তা করা সম্ভব হয় না।
আপনি তাঁকে বিয়ে রেজিস্ট্রি করার জন্য অনুরোধ করতে পারেন। তবে রেজিস্ট্রেশনের অভাবে বিয়ে প্রমাণ করা অনেক ঝামেলার হলেও আপনার এই বিয়ে বৈধ হবে।
মুসলিম বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ (নিবন্ধন) আইন, ১৯৭৪-এর বিধানমতে প্রতিটি বিয়ে নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক এবং এই উদ্দেশ্যে সরকার ম্যারেজ রেজিস্ট্রার নিয়োগ দেবে। প্রত্যেক নিকাহ রেজিস্ট্রার সরকারের নির্ধারিত পদ্ধতিতে প্রতিটি বিয়ে এবং তালাকের পৃথক নিবন্ধন বজায় রাখবেন। আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একজন নিকাহ রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে বিয়ে রেজিস্ট্রি না করে অনেকেই যেমন কোনো মাওলানা বা হুজুরের মাধ্যমে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদন করে থাকেন।
আইনে বলা আছে, মাওলানা বা হুজুরের মাধ্যমে, অর্থাৎ ধর্মীয় বিধান মেনে বিয়ে করা হলেও সে ক্ষেত্রে বর বিয়ে যেদিন হবে, সেদিন থেকে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট নিকাহ রেজিস্ট্রারের কাছে গিয়ে বিয়ের রেজিস্ট্রেশন করবেন। কিন্তু আমরা অনেক ঘটনা দেখতে পাই, যেখানে পরে বিয়েটি আর নিকাহ রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে রেজিস্ট্রি করা হয় না। বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করার দায়িত্ব স্বামীর ওপর বর্তায়। তাই স্বামী বিয়ে রেজিস্ট্রি না করলে বা তাঁর দায়িত্ব পালন না করলে দুই বছর পর্যন্ত মেয়াদের বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা তিন হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় শাস্তি হতে পারে।
বিয়ে রেজিস্ট্রি না করলে বিয়েটি অবৈধ হয়ে যাবে না। তবে বৈধ বিয়ের ক্ষেত্রে আপনি ও আপনার ছেলে আপনার স্বামীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার হিসেবে পরিপূর্ণ অধিকার লাভ করবেন।