>

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন।—বি. স.
সমস্যা
আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। ছোটবেলা থেকে একটি বিশ্বাস মনে বদ্ধমূল হয়ে আছে। তা হলো, মা-বাবা হয়তো আমাকে চান না। এ বিশ্বাসটা আরও দৃঢ় হয়েছে যখন শুনেছি বড় আপুর জন্মের পর আব্বু-আম্মু একজন ছেলের প্রত্যাশা করেছিলেন।
আমার জন্মের আড়াই বছর পর ছোট ভাইয়ের জন্ম হয়। তখন থেকেই আমাকে আম্মুর কাছে থাকতে দেওয়া হতো না। একবার আমি পার্কে হারিয়ে যাই। বেশ ভয় পেয়েছিলাম সে সময়। তারপরও আমাকে আম্মুর পাশে থাকতে দিত না। ছোট থেকে তাই একা একাই থাকি। কারও সঙ্গে তেমন বন্ধুত্ব হয়নি।
ক্লাসে সব সময় প্রথম হই আমি। এ জন্য পড়াশোনায় খারাপ এমন সহপাঠীদের সঙ্গে মিশতে আমাকে বাধা দেওয়া হয়। তা ছাড়া ভালো শিক্ষার্থীরা সবাই অফিসারের মেয়ে। তাই আমার সঙ্গে মেশে না। ছোট থেকেই আমি নিজের সঙ্গে কথা বলি, একাই হাসি, আবার একাই কাঁদি। কখনো বইয়ের সঙ্গে কথা বলি, কখনো আকাশের সঙ্গে, কখনো গাছ বা পাখির সঙ্গে। এটা আমার বাসায় কেউ জানে না।
একটা ছেলেকে খুব ভালোবাসতাম। কিন্তু কড়া শাসনের কারণে ওকে সময় দিতে পারতাম না। তাই আমাদের সে সম্পর্ক ভেঙে যায়। একটা মেয়ে বন্ধু ছিল। তাকে খুব বিশ্বাস করতাম। আমার সেই বন্ধু ওই ছেলেকে বোঝাবে বলে ওর সঙ্গে কথা বলত। কিন্তু একসময় ওরা দুজনই প্রেম করা শুরু করে। আমি বোঝাতে গেলে দুজনই গালাগাল করে। এমনকি মেয়েটা আমার গলা টিপে ধরে। বানানো বিচার দেয় আমার বাসায়। আব্বু-আম্মু কখনোই আমাকে বিশ্বাস করেন না। তাই এরপর আর ওদের বিরক্ত করিনি। স্কুলেও আমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করে।
এখন আমার মানুষ দেখলেও ভয় করে। একা থাকতে ইচ্ছা করে। আশপাশে মানুষ থাকলে অসহ্য লাগে। সবার কাছে কেবল আমার প্রথম হওয়ার গুরুত্বই আছে, আমার কোনো দাম নেই। যত অসুস্থই হই, কখনো নিজে থেকে বলি না। আমি আমার অতীত ভুলে যেতে চাই। আজব অভ্যাসগুলোও ছেড়ে থাকতে চাই। অন্য দশটা মেয়ের মতো কী আমার জীবনটা হতে পারে না?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ
একটি শিশু যখন জানতে পারে তার জন্ম বাবা-মায়ের কাছে খুব একটা আনন্দময় ছিল না, তখন তার মধ্যে প্রচণ্ড কষ্টের অনুভূতি হয়। বিশেষ করে পুত্রসন্তান প্রত্যাশী বাবা-মায়েরা কন্যাসন্তান নিয়ে যদি হতাশা বোধ করেন। তা একজন মেয়ে বড় হওয়ার সময় বুঝতে পেরে ভীষণভাবে ভেঙে পড়ে। সে তখন রীতিমতো অস্তিত্বের সংকটে পড়ে। তোমার কষ্টের পরিমাণ আরও বেড়ে গেছে মায়ের সংস্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়ে। পার্কে হারিয়ে যাওয়ার তোমার যে তীব্র মানসিক ট্রমা হয়েছিল সে সময় মায়ের সান্নিধ্য তোমার ভীষণ প্রয়োজন ছিল। এরপর তুমি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার কারণে নিজেকে সবার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছ। কিছুটা বড় হওয়ার পর ভালোবাসার মানুষটিকেও হারিয়ে ফেলেছ। সে কষ্ট আরও কয়েক গুণ বাড়িয়েছে মেয়েবন্ধুর প্রতারণামূলক আচরণ। এতে তুমি মানুষের প্রতি বিশ্বাসও কিছুটা হারিয়ে ফেলেছ।
সন্তানের সুস্থ মানসিক বিকাশের জন্য বাবা-মায়ের বিশ্বাস অত্যন্ত প্রয়োজন। সেটি পাওনি বলে সবাইকে বাদ দিয়ে নিজেই নিজের বন্ধু হয়েছ। প্রকৃতিকে বন্ধু বানিয়ে তুমি ভালো থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছ। এতে করে কিছুটা হলেও উপকার পাচ্ছ। সে কারণে এত কষ্টের মধ্যেও পড়াশোনায় খুব ভালো ফলাফল করতে সক্ষম হচ্ছ। তবে দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকলে তোমার পক্ষে পরবর্তী সময়ে ভালো থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। যত কষ্টই হোক না কেন, নিজের চারদিকের দেয়ালটি ভেদ করে অল্প অল্প করে বেরিয়ে এসো। যে সহপাঠীদের তোমার কিছুটা হলেও ভালো লাগে তাদের সঙ্গে সচেতনভাবে কথাবার্তার পরিমাণ বাড়াতে থাকো। শরীর ও মন খারাপ থাকলে পরিবারের সদস্যদের বলতে শুরু করো। কষ্টের সময় তাদের মনোযোগ পাওয়া কিন্তু তোমার অধিকার। তারা যে তোমার প্রতি
অন্যায় করেছেন সেটি একেবারেই বুঝতে পারছেন না। মৌখিকভাবে বলা সম্ভব না হলে লিখিতভাবে তোমার মানসিক অবস্থার কথা তাঁদের বলতে পারো।
তুমি যদি ফোনের মাধ্যমে কাউন্সেলিং সেবা নিতে চাও তাহলে ০৯৬১২২২২৩৩৩ (টেলিসেবা) নম্বরে যোগাযোগ করে সহায়তা নিতে পারো। বিনা মূল্যের এ সেবা কিছুদিন নিলে আশা করি নিজের প্রতি আস্থা অর্জন করতে পারবে এবং তোমার সামাজিক দক্ষতাও বাড়াতে পারবে।