আমার প্রথম ক্রাশ

আমার জীবনের প্রথম ভালো লাগা বা ক্রাশ ক্লাস থ্রি-ফোরের দিকে। উনি ছিলেন আমার সহপাঠিনী। নামটা হয়তো না বলাই ভালো, কিন্তু বেশ মনে আছে।
শ্যামলা এক মেয়ে। অতীব সুন্দর হাসি। হরিণের মতো চোখ। বাকি সব বিটকেলে সহপাঠীদের মতো না। বেশি কথা বলে না। হরিণ চোখ দিয়ে মিটমিট করে এদিক-ওদিক তাকায়। যেমন খুশি তেমন সাজোর দিনে কৃষ্ণবর্ণের সিন্ডারেলা সেজে আসে। টিফিন টাইমে টিফিন খেতে চাইলে ঝামেলা করে না। যত খুশি খেতে দেয়। খুব বন্ধুত্ব করতে ইচ্ছা করে তার সঙ্গে, কিন্তু ক্লাস ফোরের আবহাওয়া একদমই সেই ইচ্ছার অনুকূলে নয়।
টিফিন চাওয়ার বাইরে ছেলেমেয়েদের কথা বলা সামাজিকভাবে বারণ। কোনো বাঘা যতীন যদি সেই বারণ উপেক্ষা করে কোনো মেয়েকে ‘এই কালকে থান্ডার ক্যাটস দেখেছিলে?’ জিজ্ঞেস করে বসে, তাহলে তার জীবন তেজপাতা। কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বলার শাস্তি দুই পর্বে দেওয়া হয়। প্রথম পর্বে কেউ বলে, ‘এই দেখ দেখ, অমুক অমুককে থান্ডার ক্যাটস-এর কথা জিজ্ঞেস করেছে।’ পুরো ক্লাসে হাসির রোল পড়ে যায়। বাঘা যতীন ও নির্দোষ মেয়ে টমেটো হয়ে হায়েনার হাসি শুনতে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। সেই সময়টা তাদের কাছে কচ্ছপের জীবনের চাইতেও দীর্ঘ মনে হয়। এরপর আসে সহপাঠী ও বন্ধুদের হাতে মৌখিক লাঞ্ছনা। সেটা চলতে থাকে বেশ কয়েক সপ্তাহ। আমি কখনোই সাহসী ছিলাম না। এখন তো না-ই, ছোটবেলায় আরও না। বাঘা যতীন হওয়ার কোনো ইচ্ছা বা শক্তি আমার নাই এবং ছিল না।
এখানে বলে রাখি যে ছোটবেলায় আমি খুব ভালো একটা বাচ্চা ছিলাম। এখনকার মতোই গোলগাল আর চশমা পরা। নিরীহ। তবে এখন বিষয়টা যে রকম বেমানান, নয় বছর বয়সে তেমন বেমানান ছিল না। তাতে যে খুব লাভ হয়েছিল তা নয়। ভয়ংকর সব হাস্যবিদ্রূপ ফেস করে এসেছি। পাড়ার বড় ভাইদের দেওয়া নামের মধ্যে দুটি মনে পড়ে। একটা বেঁটে বালতি, আরেকটা তুলা। থাক সে কথা। আসল কাহিনিতে ফিরে আসি।
আমি ছিলাম নিরীহ একটি শিশু। ক্রাশ খেলে, বিশেষ করে প্রথমবারের মতো ক্রাশ খেলে যে নিরীহ শিশুও পিশাচে পরিণত হতে পারে, সেটা আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই শেখা।
যে রকমটা বলছিলাম। হরিণ চোখকে আমার খুব ভালো লাগত। কথা বলতে ইচ্ছা করত, কিন্তু ‘সামাজিক সুইসাইড’ করার সাহস আমার ছিল না। ছোটবেলায় বিশেষ করে স্কুলে বাচ্চারা কখনোই একা থাকে না। একটু যে ফোন নম্বরটা চাইব, তারও কোনোই সুযোগ নেই। দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। কিছুই হয় না। সূর্য ওঠে না, গাছের পাতা নড়ে না টাইপ ব্যাপার-স্যাপার।

ক্রাশের বাসনা যখন প্রায় শয্যাশায়ী, তখন আমাকে বাঁচাতে চলে এল এক বাঘা যতীন, আমার সহপাঠী। নাম ধরা যাক হাসান। হাসান বাংলা সিনেমার অনুরাগী। রকি আমার নাম, দূরদেশ—এসব সিনেমার প্রায় সব সংলাপ তার মুখস্থ। একটাই সমস্যা; হাসানের গঠন, আচরণ, ব্যবহার ফিল্মের ভিলেনের মতো। ক্লাস ফোরে এটা কোনো সমস্যার বিষয় না। হাসান মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে যায়। মেয়েরা ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। হাসান নিজেকে অমরেশ পুরি ভেবে মজা পায়। হাসানকে নিয়ে হাসাহাসি করার সাহস আমাদের কারোরই হয় না।
সমস্যা ঘটে, যখন প্রথমবারের মতো এক মেয়েকে হাসানের পছন্দ হয়। বাইরে থেকে ইমেজ ঠিক থাকলেও হাসানের বুকের ভেতরকার খলনায়ক তাকে হাসানোর ব্যাপারে নিমকহারামি করে। অমরেশ পুরি বুঝতে পারে না, সে কীভাবে সোহেল রানা হবে। সাহায্যের জন্য হাসান যায় তার সবচাইতে ঘনিষ্ঠ ও নিরীহ বন্ধু, অর্থাৎ আমার কাছে।
হাসান: ইরেশ দোস্ত। একটা কথা বলব, কাউকে বলবি না তো?
আমি: না দোস্ত, কাউকে বলব না। কখনোই না। কাউকেই না।
হাসান: আমার একজনরে জবরদস্ত পছন্দ হইছে।
(শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা)
আমি: কে দোস্ত?
হাসান: হরিণ চোখ...
আমি একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে দৌড়ে চলে গেলাম হরিণ চোখের কাছে। সবাইকে শুনিয়ে চিৎকার করে বললাম।
: হরিণ চোখ, জানো কী হয়েছে? হাসান না তোমাকে পছন্দ করে।
হাসির রোল পড়ে গেল। মারাত্মক রকমের হাউকাউ লেগে গেল। খলনায়ক হাসান বুঝতে পারল না কী করবে।
কলরব থাকতে থাকতে আমি একা একা হরিণ চোখকে বললাম, ‘তোমার নম্বরটা দাও। বলা তো যায় না, হাসানের মতো আরও কতজন তোমাকে পছন্দ করে। আমি সব তোমাকে বলে দেব।’
সেদিন স্কুল শেষ হলো। হাসান সংবিৎ ফিরে পেল। সোজা এসে আমার কলার ধরে দুটো চড় মেরে বলল, ‘তুই আমার লগে নিমকহারামি করছস। সাহেদের জন্য আমার বুকে ভালোবাসা আছে। সাকিবের জন্য আমার বুকে ভালোবাসা আছে। তোর জন্য আমার বুকে পাত্থর আছে পাত্থর!’
বলেই সে আমাকে মাটিতে ছুড়ে ফেলল। উল্টে পড়লাম। হাসান আবার তেড়ে আসে কি না, সেই ভয়ে নড়াচড়া না করে মাটিতে মুখ লাগিয়ে শুয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ।
ভয় পাওয়ার কথা। অপমানিত হওয়ার কথা। কিছুই হলাম না। কারণ আমার ডায়েরিতে লেখা ‘হরিণ চোখ: ৫০৭৪৭৪।’
(এই কাহিনির প্রায় অনেকটাই সত্য)