আমি আর আব্বু একসঙ্গে বড় হয়েছি

আমি আর আব্বু একসঙ্গে বড় হয়েছি! আমার জন্মের কিছুদিন পরই আব্বু স্ট্রোক করেন। তাঁর শরীরের একটা অংশ প্যারালাইজড হয়ে যায়। তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। তাই বুঝতে শুরু করার পর থেকেই দেখেছি, আব্বু আমার পাশেই সারা দিন শুয়ে আছেন। বিছানার ওপরে যে অয়েলক্লথ দেওয়া থাকত, তা আমার চেয়ে আব্বুর কারণে বেশি ব্যবহৃত হতো। আম্মু আমাদের বাপ-ছেলের মলমূত্র একসঙ্গে সাফ করতেন।

মায়ের কোলে বা বুকে ঘুমানোর সৌভাগ্য আমার খুব কম হয়েছে। বেশির ভাগ সময় ঘুম থেকে জেগে শুনতাম, ‘তোমার আব্বুর শরীর হঠাৎ খারাপ করেছে, আম্মুও হাসপাতালে গিয়েছে।’ একবার হাসপাতালে গেলে চার-পাঁচ দিন আব্বু-আম্মু গায়েব!

ছোটবেলায় আব্বুর ওপর আমার রাগ আর হিংসাই বেশি হতো। আরও খারাপ লাগত ঈদের দিন। আমাদের ভবনে আমার বয়সী অনেকে থাকত। ঈদের দিন বাবার সঙ্গে তারা পাঞ্জাবি পরে ঘুরতে বের হতো। আর আমার আব্বুকে নতুন লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরিয়ে খাটের পাশে বসিয়ে রাখা হতো। তিনি বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তাঁর সেই তাকিয়ে থাকা চেহারা আমাকে আহত করত, তাঁকে দেখে তখন খুব খারাপ লাগত।

কার্টুনিস্টের চোখে মা–বাবার সঙ্গে লেখক

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি যেমন হাঁটতে শিখেছি, তেমনই আব্বুকেও লাঠি ধরে হাঁটতে শিখিয়েছি। রাতে পড়াশোনা শেষে আব্বুকে তাঁর নাম লেখা শেখাতে বসাতাম। লিখতে না পারলে শিক্ষকের মতো শাসন করতাম। প্রতি মাসে তাঁর নাম লেখার পরীক্ষা হতো।

প্রতি মাসে আব্বুর সঙ্গে আমি তাঁর সরকারি অফিসে যেতাম। আব্বু বেতন নিতে যেতেন। স্বাক্ষর করে বেতন উঠাতে হতো। আব্বু স্বাক্ষর করতে না পারলে আমিই কলম ঘুরিয়ে দিতাম। তারপর বেতন নিয়ে পাশের হোটেলে বসতাম শিঙাড়া খেতে।

আমার অনেক বিকেল কেটেছে মন খারাপ করে। খেলার সময় হয়তো আইসক্রিম বিক্রেতা এসেছেন, আমার বয়সীরা তাদের বাবার কাছে ছুটে গেছেন আইসক্রিমের আবদার নিয়ে। কিন্তু আমি যেতে পারিনি।

তবে এমনই এক মন খারাপ বিকেলে ঘটল অপ্রত্যাশিত ঘটনা। অনেকে বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে। আমি মন খারাপ করে আনমনা এদিক-সেদিক হাঁটছি। এমন সময় কানে এল অস্পষ্ট একটা ডাক। ওপরে বারান্দায় দিকে তাকাতেই দেখি—আব্বু। বারান্দার গ্রিল দিয়ে কোনোমতে হাতটা বের করে ৫ টাকার একটা নোট ফেলে দিলেন। আর চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘খা।’

সেদিনের মতো এত মজা করে আইসক্রিম আমি আজ পর্যন্ত খাইনি।

তারপর একদিন খুব সকালে ঘুম থেকে তুলে বারান্দা দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে যেতে ভাইয়া আমাকে বলল, ‘আব্বুর শরীর খারাপ করেছে।’

ভাইয়াকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম, ‘হাসপাতাল যাবা?’

জবাব না দিয়ে আব্বুর দিকে ছুটে গেল ভাইয়া। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখতে লাগলাম। হঠাৎ রুম থেকে আম্মু আর ভাইয়ার কান্নার শব্দ! দৌড়ে গিয়ে দেখি আব্বু নিস্তেজ। খাটে শোয়া। তাঁর পুরো শরীর ঠান্ডা। কী অস্বাভাবিক ঠান্ডা!

২৫ বছর পর, এই গুটিকয়েক মুহূর্ত আর সেই অস্বাভাবিক ঠান্ডার পরশ নিয়ে আব্বু আমার স্মৃতিকোঠায় আজও বেঁচে আছেন।