মায়ের সঙ্গে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

প্রিয় আম্মা, ওপারে কেমন আছ?

২০০৮ সালে তোমায় হারিয়েছি। মরণব্যাধি ক্যানসারে তুমি আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিলে। তখন আমি পাগলের মতো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর সেই ‘টাইম মেশিন’ খুঁজে বেড়াতাম। বর্তমান ও অবশ্যম্ভাবীকে এড়িয়ে চলে যেতে চাইতাম সুদূর ভবিষ্যতের কোনো সময়ে, তোমাকে হারানোর অসহনীয় বেদনা থেকে নিজেকে উপশম করতে।

আজ ২০২২ সাল। আমি এখনো সেই টাইম মেশিন খুঁজছি। কিন্তু এবার ফেরত যেতে চাই অতীতে। সেই ২০০৮ সালে। তোমার সঙ্গে কাটানো শেষ দিনগুলো আবার নতুন করে ফিরে পেতে চাই। তখনকার সেই অসহনীয় দিনগুলোই ছিল যেন জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ।

তুমি জেনে খুশি হবে যে আজ আমি পাশ্চাত্যের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। আর আমার গবেষণাগারের দর্শন কী জানো? জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গ যেন কারও এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধক না হয়ে দাঁড়ায়। সমদর্শিতার এই জীবনদর্শন শিখেছি আমি তোমার কাছে।

মাত্র ১৪ বছর বয়সে তোমার বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের প্রথম বর্ষে প্রথম সন্তান এবং তার কয়েক বছর পর আসে দ্বিতীয় সন্তান। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ফুরসত আর মেলেনি তোমার। ঘরসংসার ও রান্নাবান্নাই যেন জীবন।

হঠাৎ তোমার মাথায় ভূত চাপল। তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে একটা কলেজে ভর্তি হয়ে গেলে, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্যে। ব্যাপারটি যদিও আমার কাছ থেকে লুকাতে পারনি। কারণ আমাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়েই তুমি চলে যেতে তোমার কলেজে। সময়মতো কলেজে ও ক্লাসে না আসার জন্য কলেজের দারোয়ান থেকে অধ্যাপকেরা পর্যন্ত তোমাকে হেয় করে কথা বলতেন। তুমি হতাশ না হয়ে তাঁদের সব সময় আলোকিত করতে তোমার সহনশীলতা, শ্রদ্ধা ও বিচক্ষণতায়।

পড়াশোনার ব্যাপারটা যেন কেউ বুঝতে না পারে, তাই তুমি কলেজের পোশাকের ওপর বোরকা পরতে। তোমার এই সাদামাটা বেশ দেখে আমার নার্সারির এক অবস্থাপন্ন বন্ধু বলেছিল, ‘ওহ, উনি তোমার মা? আমি তো ভেবেছিলাম উনি তোমার আয়া।’ আমার কাছ থেকে এই কথাগুলো শোনার পরও তুমি এক ফোঁটা বিচলিত হওনি। মন খারাপ করনি। বাহারি পোশাকের অভিভাবকদের ভিড়ে তুমি ছিলে বেমানান। কিন্তু সমাজের প্রথার বিরুদ্ধে নীরবে যুদ্ধ জারি রেখে আমাদের অনুপ্রাণিত করার ব্যাপারে তুমি ছিলে অগ্রগামী। ভাবতেই অবাক লাগে, সন্তান লালনপালন থেকে শুরু করে একান্নবর্তী পরিবারের সব কাজ করার পরও তুমি অধ্যবসায়ের জন্য সময় রাখতে। মনে আছে, কাকডাকা ভোরে বাড়ির ছাদে পাটি বিছিয়ে পড়াশোনা? আমি ঘুম থেকে উঠে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে গিয়ে শুয়ে থাকতাম তোমার আঁচলের উষ্ণতায়।

এভাবে এইচএসসি থেকে শুরু করে সহিষ্ণুতা ও কঠোর পরিশ্রম পুঁজি করে পৌঁছে গিয়েছিলে পিএইচডি অর্জনের শেষ পর্যায়ে। আজও গবেষণার কোনো কাজে বিফল হলে, তোমার সংগ্রামের কথা ভাবি। আবার নতুনভাবে উদ্দমিত হই।

তোমার মনে আছে, এইচএসসির পর ভেবেছিলাম দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করব। আমরা তখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবরণী একসঙ্গে পড়তাম। হঠাৎ তুমি আমাকে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কথা ভাবতে বললে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এত প্রতিষ্ঠান থাকতে এই বিশ্ববিদ্যালয় কেন?’

তুমি তখন সরল মনে বলেছিলে, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্টের কন্যা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। যদি কোনোভাবে আমি পরিচিত হতে পারি, তাহলে হয়তো কোনো সূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসে দাওয়াত মিলতে পারে। একজন বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের প্রেসিডেন্টের বাসায় বা অফিসে প্রবেশ করতে পারা যেন বিশাল ব্যাপার। আমাদের ওই আলাপচারিতা মনে পড়লে এখনো হাসি পায়।

তুমি জেনে খুশি হবে যে এই বছরই যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসে আমার ভ্রমণ করার সুযোগ মিলবে। কোনো স্বজনপ্রীতির সূত্র ধরে নয়, বরং নিজ যোগ্যতায়। বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সর্বোচ্চ সম্মানের (পিকেস-প্রেসিডেনশিয়াল আরলি ক্যারিয়ার অ্যাওয়ার্ড ফর সায়েন্টিস্টস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স) ভাগীদার হিসেবে। যখন ঘোষণা পেয়েছি—নীরব হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ফোনের দিকে। যদি তোমাকে নিজ মুখে এই সংবাদ দিতে পারতাম! তোমার সঙ্গে যদি আনন্দ ভাগ করতে পারতাম! অসম্ভবকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যাওয়ার হাতেখড়ি যে তোমারই হাতে।

তোমার মনে আছে, তুমি যখন পড়াশোনার পেছনে অঢেল সময় ব্যয় করতে, তখন অনেক নিকটাত্মীয় নানাভাবে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করতেন—কী হবে এত পড়াশোনা করে? সংসারের হাল ছেড়ে চাকরি করার সুযোগ তো তোমার মিলবে না। তাহলে সংসার ও সন্তান ফেলে অধ্যবসায়ের সার্থকতা কোথায়?

তোমাকে ধন্যবাদ—তুমি সমাজের কানাঘুষা উপেক্ষা করে পড়াশোনাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে আমাদের অনুপ্রাণিত করেছ। পুরান ঢাকার ছোট্ট গলিতে সদ্য ১৪ বছরের নববধূ হওয়া সত্ত্বেও তুমি বড় স্বপ্ন দেখতে পিছপা হওনি। তুমি অকালে চলে গেলেও তোমার স্বপ্নগুলো রয়ে গেছে আমাদের মাঝে। এই স্বপ্নের মাঝে বেঁচে থাকুক বিশ্বের সব মা, তাঁদের সন্তানদের অন্তরের অন্তস্তলে। যেমনটি তুমি আছ আমাদের সঙ্গে।