আমি ক্যাম্পাসে ঢুকলেই সবাই টের পেয়ে যেত যে ‘হ্যাঁ, অ্যালিসন ফেলিক্স এসেছে!’

অলিম্পিকজয়ী মার্কিন দৌড়বিদ অ্যালিসন ফেলিক্স। খেলার পাশাপাশি উদ্যোক্তা হিসেবেও তিনি সফল। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন অ্যালিসন।

অ্যালিসন ফেলিক্স
ছবি: সংগৃহীত

‘প্রথম দিনের’ গল্প

আমার ভাই ওয়েস আমার চেয়ে দুই বছরের বড়। আমরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। এখনো আমার মনে আছে, ওর জন্য ক্যাম্পাসজীবনের অনেক ফুর্তিতেই আমি শামিল হতে পারিনি। ও আমাকে কোনো পার্টিতে নিয়ে যেত না। এরপরও ক্যাম্পাসজীবনটাকে আমি ভীষণ ভালোবাসতাম। ক্যাম্পাসের প্রথম দিনটা স্পষ্ট মনে আছে—একটা ছোট বাচ্চার মতো সেদিন এ পাশ থেকে ও পাশ ছুটে বেড়িয়েছিলাম।

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের প্রথম ক্লাসের দিনটাও মনে রাখার মতো ছিল। সে সময় আমি ১৯৮৯ মডেলের একটা কালো বিএমডব্লিউ গাড়ি চালাতাম। গাড়িটা ছিল বেশ পুরোনো। আমার ভাই ওয়েস ওটা আমাকে দিয়েছিল, আর ওকে এটা দিয়েছিল আমার আন্টি। আমি ছিলাম ওই গাড়ির তৃতীয় প্রজন্মের চালক। বয়সের ভারে গাড়িটা এতই ন্যুব্জ হয়ে পড়েছিল যে কদাকার ট্রাকের মতো আওয়াজ করত। ওই শব্দের জন্য আমি ক্যাম্পাসে ঢুকলেই সবাই টের পেয়ে যেত যে ‘হ্যাঁ, অ্যালিসন ফেলিক্স ক্যাম্পাসে এসেছে!’

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাসেও আমি ওই গাড়িতে চড়ে ক্যাম্পাসে যাই। ওয়েস আগেই আমাকে ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল। তাই প্রায় সবই আমি চিনতাম। শুধু গাড়ির পার্কিংয়ের জায়গাটাই ওয়েস চেনায়নি। তাই প্রথম দিন পার্কিংয়ের জায়গা খুঁজতে খুঁজতে কাহিল হয়ে গিয়েছিলাম। পরে অবশ্য ক্যাম্পাসেরই একটা মুদিদোকানের বাইরে বড় একটা জায়গা পাই। ওখানে গাড়ি পার্ক করে, স্টিয়ারিংয়ে লক লাগিয়ে ক্লাসে চলে যাই। ক্লাস শেষে ফিরে এসে দেখি, আমার গাড়ি আর ওই জায়গায় নেই!

গাড়ি চুরি হয়ে গেছে—ভেবে আমার পায়ের নিচ থেকে রীতিমতো মাটি সরে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে ওয়েসকে ফোন করে বিষয়টা জানালাম। ভয়ে আমি কাঁপছিলাম। ওয়েস আমাকে শান্ত করে ঠান্ডা স্বরে বলল, ‘ভুল জায়গায় পার্ক করায় তোমার গাড়ি ট্রাফিকের লোকেরা এসে নিয়ে গেছে।’ এই ছিল আমার স্মরণীয় ‘প্রথম দিনের’ গল্প।

আমি যে তোমাদের চেয়ে আলাদা নই, এটা বলতেই এই গল্পটা বলা। আমিও তোমাদের মতো পরীক্ষার আগের রাতে ভয় পেতাম, আমারও ইচ্ছা করত বন্ধুদের সঙ্গে পার্টি করে বেড়াতে, আমারও বন্ধুদের সঙ্গে মন–কষাকষি হতো। হ্যাঁ, অলিম্পিক গেমসে অংশ নিতে গিয়ে ক্যাম্পাসজীবনের অনেক আনন্দই মিস করেছি, জীবনের অনেক অংশের স্বাভাবিকতা হারিয়েছি। কিন্তু আমি আদতে তোমাদেরই একজন।

কণ্ঠ ছাড়ো জোরে

আমি কী করে বুঝেছি যে আমার আওয়াজেও জোর আছে, আমিও পারি অনেক ভ্রান্ত ধারণাকে বদলতে দিতে—সেই গল্পটা এখন বলব। একজন দৌড়বিদ হিসেবে আমাকে প্রতিটি খেলায় অংশ নেওয়ার জন্য কোনো না কোনো পোশাক নির্মাতা বা জুতা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হয়। তারা পৃষ্ঠপোষকতা করলেই আমরা ট্র্যাকে নামতে পারি। মোদ্দাকথা, একজন দৌড়বিদের আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংই আসে পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানের পণ্য বা সেবার প্রচার করে। আমার বেলাতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এই গল্পটা একটি স্পনসরশিপের ঘটনা দিয়ে শুরু হয়।

যখন আমি প্রতিটি খেলায় সফল হতে শুরু করি, বড় বড় প্রতিষ্ঠান আমার পৃষ্ঠপোষক হওয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে। আমার উদ্দীপনা আরও বেড়ে যায়, আরও বেশি খেলায় মন দিই। একের পর এক মেডেল জিততে থাকি, স্বীকৃতি পাই, বিশ্বজোড়া খ্যাতিও ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু একটা সময় আমি নিজের সংসারের অভাববোধ করছিলাম। তাই সিদ্ধান্ত নিই, এবার পেশাগত জীবনের পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনের দিকেও মন দেব—তখনই আমি বিরাট সংকটে পড়ি।

আমি আমার প্রেমিককে বিয়ে করি। বিয়ের পর যখন সংসার ও সন্তান নিয়ে ভাবছিলাম, তখন নাইকি থেকে আমার স্পনসরশিপ পুনর্মূল্যায়নের প্রস্তাব আসে। দেখি, আমার স্বাভাবিক পারিশ্রমিকের চেয়ে ৭৫ শতাংশ কম পারিশ্রমিক প্রস্তাব করছে তারা। তখনো কিন্তু আমি সন্তানসম্ভবা নই। এর আগেই এ ধরনের বৈষম্য দেখে দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই। একজন নারী ক্রীড়াবিদের জীবনে বিয়ে ও সন্তান জন্ম দেওয়াকে মনে করা হয় কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার মতো। নারী ক্রীড়াবিদেরা অন্তঃসত্ত্বা হলে সেটা গোপনে লুকিয়ে রাখার প্রথা অনেক পুরোনো। তাই যখন অন্তঃসত্ত্বা হলাম, সেটা আমার জীবনের সবচেয়ে সুখকর অভিজ্ঞতা হলেও প্রচণ্ড ভয়ে আর আতঙ্কে দিন কাটাতে শুরু করলাম। কারণ, একজন নারী ক্রীড়াবিদ হিসেবে আমার ধারণা ছিল, ক্যারিয়ার ও সন্তান—এই দুইয়ের মধ্যে আমাকে ভারসাম্য করে চলতে হবে। কিন্তু এরপরও আমি হেরে যেতে পারি। তাই গর্ভাবস্থায় লুকিয়ে দৌড় অনুশীলন করতাম। ভোরের আলো ফোটার আগে প্র্যাকটিসের জন্য বের হতাম, যেন কেউ আমাকে না দেখে। দিনের বেলা ঢিলেঢালা পোশাক পরতাম, যেন আমাকে অন্তঃসত্ত্বা মনে না হয়। দিনের আলোয় ঘরের বাইরে বের হওয়া ছেড়েই দিয়েছিলাম। জীবনের যে অধ্যায়টা আমার উপভোগ করে কাটানোর কথা, সেই সময় আমি ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার ভয়ে নিজেকে ঘরবন্দী করে ফেলেছিলাম। কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবর এভাবে বেশি দিন চেপে রাখা যায়নি। নাইকি যখন জানতে পারল আমি অন্তঃসত্ত্বা, আমার পারিশ্রমিক নিয়ে দর-কষাকষিতে আরও কঠোর হয়ে উঠল তারা। লম্বা লম্বা বৈঠক আর আলোচনার পর নাইকি আমাকে প্রাপ্য পারিশ্রমিকের চেয়ে ৬০ শতাংশ কম টাকা প্রস্তাব করল।

আমি এই প্রস্তাব মেনে নিলাম। কিন্তু সঙ্গে একটা শর্ত জুড়ে দিলাম। সেটা ছিল ‘ম্যাটারনিটি প্রোটেকশন ক্লজ’ (মাতৃত্বকালীন সুরক্ষা ধারা)। আমাদের পেশার নিয়ম হলো—কেউ যদি বড় ম্যাচে মেডেল জেতে, তাহলে তার পারিশ্রমিক বাড়ানো হয়। আর মেডেল না জিতলে পারিশ্রমিক কমে যায়। যেহেতু আমার চুক্তিই হচ্ছিল ৬০ শতাংশ কমে, তাই আমি নাইকিকে অনুরোধ করেছিলাম ‘ম্যাটারনিটি প্রোটেকশন ক্লজ’ যুক্ত করতে, যেখানে কোনো ম্যাচে হেরে গেলে যেন আমার পারিশ্রমিক কাটা না হয়। আমার অনুরোধ তারা রাখল। ভেবেছিলাম, এখন থেকে এটাই বুঝি হবে নতুন প্রথা, যা সব নারী ক্রীড়াবিদের মাতৃত্বকালীন সংকট দূর করে দেবে। কিন্তু না, মাতৃত্বকালীন সুরক্ষা ধারা শুধু আমার জন্যই মেনে নিয়েছিল নাইকি। অন্য নারী ক্রীড়াবিদদের জন্য এটা প্রযোজ্য ছিল না। আমার মনে আবার দুশ্চিন্তা ফিরে এল। আমি আমার মেয়ের কথা ভাবলাম, ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবলাম, আমার পরের প্রজন্ম নিয়ে ভাবলাম। তখনই উপলব্ধি করলাম, আমাকে আওয়াজ তুলতে হবে। নিউইয়র্ক টাইমস–এ এ বিষয়ে একটি কলাম লিখলাম। সেখানে আমার অনিশ্চয়তা, আমার ভয়, আমার অভিজ্ঞতার কথা লিখলাম।

আনন্দের ব্যাপার হলো, ওই কলাম লেখার তিন সপ্তাহের মাথায় নাইকি তাদের মাতৃত্বকালীন নীতিমালায় বিরাট পরিবর্তন আনল। আর এভাবেই একজনের কণ্ঠ অনেক নারী ক্রীড়াবিদের অনিশ্চয়তাকে কাটিয়ে দিল। এ জন্যই আমি শুরুতে বলেছিলাম, তোমরা আওয়াজ তোলো, কথা বলো। নিজেকে কখনো একা মনে করে নীরব হয়ে থেকো না। তোমার একার কণ্ঠই অনেক সময় বড় পরিবর্তনের হাতিয়ার হয়ে উঠবে।

ইংরেজি থেকে অনুদিত।