আমি যে আলাদা এক মা

ওহীর জন্ম ১৯৮১ সালে ১৪ অক্টোবর বিকেল চারটায়। জন্মের আগের রাতে আমি টেবিল ফ্যানের তারে পা জড়িয়ে খুব জোরে মেঝেতে পড়ে যাই। ঈদুল আজহার পরের দিন ছিল। বাসায় দু–একজন মেহমান এসেছিলেন, তখন আমাদের ফ্রিজ ছিল না। মেহমানদের আপ্যায়ন শেষ করে রাতে খুব ক্লান্ত ছিলাম। রাতে শুতে যাওয়ার আগে এই দুর্ঘটনা। কতক্ষণ পড়ে ছিলাম জানি না। মাঝরাত থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ি। ভোরে ডাক্তারকে ফোন করা হয়। সকালে তাঁর চেম্বারে যেতে বলেন। গেলাম ডাক্তারের চেম্বারে। তিনি এক জায়গায় পাঠালেন এক্স–রে করতে। এবড়োখেবড়ো রাস্তা। রিকশায় যাচ্ছি, প্রচণ্ড ঝাঁকি। খুব কষ্ট হচ্ছিল।

এক্স–রে ল্যাবটা ছিল তিনতলায়, উঠতে হবে সরু, খাড়া একটি কাঠের সিঁড়ি বেয়ে। সিঁড়ির রেলিং ধরে অনেক কষ্টে ল্যাবে পৌঁছালাম। কষ্টটা আমার এখনো মনে আছে। এক্স–রে হলো, রিপোর্ট পেলাম। বাচ্চা ব্রিজ পজিশনে। অস্ত্রোপচার লাগবে, অবিলম্বে। টাকাপয়সা জমা দেওয়া হলো, যেখানে যেখানে সই করার করা হলো, কিন্তু অস্ত্রোপচার তৎক্ষণাৎ হলো না। অ্যানেস্থেশিয়ার জন্য অবেদনবিদকে সেই মুহূর্তে পাওয়া গেল না। আমি তখন রাজশাহীতে ছিলাম। চিকিৎসক ছিলেন জুবাইদা বেগম। অবেদনবিদ এলেন বিকাল সাড়ে চারটায়। এত দেরিতে আসায় যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে। আমাকে একটু অক্সিজেনও দেওয়া হয়নি। অক্সিজেনের অভাবে বাচ্চার ৫০ শতাংশ ব্রেন ড্যামেজ হয়ে গেছে। জন্মের পর সে একটুও কাঁদল না। এটা আমি পরে জেনেছি, কারণ অস্ত্রোপচারের পর আমি কোমাতে চলে গিয়েছিলাম। অনেক চেষ্টায় আমার জ্ঞান ফিরেছিল।

দিন যেতে লাগল। এক মাস, দুই মাস, তিন মাস—বাচ্চা বেড়ে ওঠে কিন্তু বড় হয় না। চোখে ভাষা নেই, মুখে হাসি নেই। আমার দুই মেয়েকে জন্মের পরপর আমার মা দেখভাল করেছেন। বড় মেয়ের সময়ও আমি খুব অসুস্থ ছিলাম।

আমার বড় মেয়ে ঐশীর চেয়ে ছোট মেয়ে ওহী আট বছরের ছোট। এই আট বছরে আম্মারও বয়স বেড়েছে। তিনি তখন অনেক দুর্বল। চোখেও কম দেখেন। ওহীকে তখন দেখভাল করতে আম্মার কষ্ট হতো। ছোট মেয়েটাকে আম্মা কিছুতেই ঠিকমতো খাওয়াতে পারতেন না। কী করে পারবেন? সে তো ফিডার সাক করতেই পারত না। আমি সেটা খেয়াল করে নিপলের ফুটো বড় করে দিই। যাতে ওকে আর সাক করতে না হয়। তখন থেকে মেয়ে আমার খাবার পেল ঠিকমতো। দিন দিন খুব সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে লাগল। খায় আর ঘুমায়, একটুও বিরক্ত করে না। তিন মাসের সময় ওকে একবার ডাক্তারের কাছে নেওয়ার প্রয়োজন হলো। ডাক্তার দেখলেন, মুখটা ভার। অবশেষে বললেন, ‘ডা. জুবাইদা আপনাদের কিছু বলেন নাই।’

‘কী ব্যাপারে?’

‘আপনার মেয়ে স্বাভাবিক না, সে হবে মানসিক প্রতিবন্ধী।’ বললেন ডাক্তার রব, শিশু বিশেষজ্ঞ।

আমি তাকিয়ে আছি, কোন দিকে কার দিকে জানি না। কতক্ষণ তা–ও জানি না। তিনি আরও বললেন, ‘পৃথিবীর যেখানেই যান, পূর্ব থেকে পশ্চিমে, এর চিকিৎসা নেই। আপনারা ট্রেনিং দিয়ে যেটুকু করাতে পারবেন, সেটুকুই হবে। সেটাও অনেক সময় এবং ধৈর্যের ব্যাপার।

আমার পৃথিবীর দুলতে দুলতে একসময় স্থির হয়ে গেল। আমি হয়ে গেলাম একজন প্রতিবন্ধী শিশুর মা। হলে কী হবে? আমি মাঝেমধ্যেই ভুলে যেতে লাগলাম যে আমি প্রতিবন্ধী শিশুর মা। একটা ঘটনা বলি।

বাসায় মেহমান এসেছে, তাকে আমি অনেক দিন পর দেখলাম। আমার স্বামীর সহকর্মীর (কিছুদিন আগে মারা গেছেন) স্ত্রী। ভাবি এসেছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। তাঁকে পেয়ে আমি আমার মেয়ের কথা ভুলে গেলাম। গল্পে মশগুল। বাসার কাজের মেয়েটা ছাদে গেছে কাপড় মেলতে। ছাদের দরজায় সব সময় তালা লাগানো থাকে। সে কাজ সেরে আবার তালা দিয়ে নিচে নেমে এসেছে। আমরা গল্প করছি। এমন সময় পাড়ার একটা ছেলে এসে বলে, ‘আপনাদের মেয়ে ছাদে।’

দৌড়ে ছাদে গেলাম, তালা দেওয়া। আবার নিচে নেমে এসে চাবি নিয়ে ছাদে গেলাম। ছাদে কেউ নেই। ছাদের একটু বর্ণনা দিই। ফাঁকা ছাদ, এক ইঞ্চিও রেলিং নেই। এটুকুই যথেষ্ট। রাস্তাঘেঁষা বাড়িটা। রাস্তা থেকে লোকজনের গলা পাচ্ছি। দৌড়ে গেলাম রাস্তার দিকে। ছাদের কিছুটা নিচে জানালার সানশেড, আর সেই সানশেডের ওপর দাঁড়িয়ে আমার মেয়ে। তখন ওর বয়স ৯ বছর।

আরেকটা ঘটনা বলি। রমজান মাস। ইফতারের সময় হয়ে এসেছে। অনলাইনে কিছু জিনিসের অর্ডার দেওয়া ছিল। তারা সেগুলো ডেলিভারি দিতে এসেছে। গার্ড তাদেরকে আমাদের দোতলার বাসায় নিয়ে এসেছে। আমি ইফতার বানাতে ব্যস্ত। গার্ডকেই পণ্যগুলো বুঝে নিতে বললাম। গার্ড ব্যস্ত হয়ে পড়ল ওদেরকে নিয়ে। কাজ শেষ করে ওরা চলেও গেল। হঠাৎ রান্নাঘর থেকেই আমি নিচের গ্যারেজে চেঁচামেচির শব্দ পেলাম। তার মধ্যে আমার মেয়ের নামও আমার কানে এল। দৌড়ে গেলাম তিনতলায় ঐশীদের বাসায় ওহীকে খুঁজতে। সেখানে নেই। আমার নিজের বাসা আগেই খুঁজেছি, নেই। নিচে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি ওহী রিকশা থেকে নামছে, সঙ্গে আমার ছোট ভায়ের বৌ। কী ঘটেছে বোঝার আগেই ওরা বলতে শুরু করল। গার্ড ছিল না।

গেট খোলা পেয়ে ওহী রাস্তায় চলে গিয়েছে। ইফতারের সময়। তাই বোধ হয় এত ব্যস্ত রাস্তা একটু ফাঁকাই ছিল। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে সে হাঁটা দিয়েছে। বেশ অনেকটাই গিয়েছে। আমাদের বাড়ির আশপাশে সে সময় বেশ কয়েকটা বস্তিঘর ছিল। সেখানকার ছেলেমেয়েরা ওহীকে দেখতে পায়। দুজন ছেলেমেয়ে ওকে পাহারা দিয়ে ওর সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে থাকে। আর দুজন আসে আমাদেরকে খবর দেওয়ার জন্য। তখন নিচতলায় থাকত আমার ছোট ভাই আর তাঁর পরিবার। ছোট ভাইয়ের বউ মুক্তি খবর পেয়ে একটা রিকশা নিয়ে ছুটে যায় ওহীর কাছে। ওহীর বয়স তখন ৩৫। ওই ছোট ছেলেমেয়ের কাছে আমি চিরঋণী হয়ে রইলাম।

আমি ভুলে যাই, আর পাঁচটা স্বাভাবিক বাচ্চার মায়েদের মতো আমার জীবনযাত্রা হতে পারে না। আমাকে অনেক সতর্ক হতে হবে, অনেক সাবধানী হতে হবে। আমি আলাদা। আমার জীবনযাত্রা হবে আলাদা। এটা আমাকে মেনে নিতে হবে। আমি ভুলে যাই।