আমি স্বাধীন, আমার প্রতিষ্ঠানের নারীরাও স্বাধীন: সিনথিয়া শারমিন ইসলাম
‘২০১৩ সালের আগে আমরা নাইজেরিয়ায় ছিলাম। পেশাগত দিক থেকে আমি একজন ফার্মাসিস্ট এবং আমার স্বামী প্রকৌশলী। যেহেতু সেই দেশের সবারই গায়ের রং কালো, তারা আমাকে দেখে একটু ভিন্ন চোখে তাকাত। ভাবত, ফার্মাসিস্ট হয়ে আমি কিছু ইউজ করছি কি না। নানা সময়ে তারা আমার কাছে জানতে আসত, কোন ক্রিম লাগালে তারা আমার মতো ত্বকের অধিকারী হতে পারবে? যেহেতু ফার্মাসিস্ট হিসেবে তাদের আমার পরামর্শ দিতে হতো, তাই আমি নেট ঘেঁটে, গুগল-ইউটিউবে নানা কনটেন্ট দেখতাম। রং ফরসা নয়, কীভাবে ত্বকের যত্ন নেওয়া যায়, সেই পরামর্শই দিতাম। এ পরামর্শ দিতে দিতে হয়তো আমার মধ্যে সেই স্বপ্নের বীজ বোনা হয়ে গেছে।’
নিজের স্বপ্নের কথা এভাবেই বলছিলেন সাজগোজ ডটকমের সহপ্রতিষ্ঠাতা সিনথিয়া শারমিন ইসলাম।
জীবনের গল্পের ধারাবাহিকতায় সিনথিয়া শারমিন ইসলাম জানান, ‘নাইজেরিয়ার অধিবাসীদের পরামর্শ দিতে গিয়ে নানা পড়াশোনা করে মাথায় চিন্তা এল, দেশে আমরা একটা বৃহৎ পরিবারের সবাই একটি ক্রিম ব্যবহার করতাম, কিন্তু এখানে তো উল্লেখ করা হয়েছে, ত্বকের ধরন অনুযায়ী ক্রিম ব্যবহার করতে হবে। শুষ্ক ত্বক, তৈলাক্ত ত্বকের জন্য আলাদা ক্রিম। আর এগুলো নিয়ে বাংলা কোনো কনটেন্ট-ভিডিও নেই।
সবই ইংরেজিতে। তো দেশের মানুষ তাদের স্বাস্থ্যের যত্ন, ত্বকের যত্ন, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার কথা জানবে কোথা থেকে? মূলত শুরুর চিন্তা সেখান থেকেই।’
প্রসাধন ও সৌন্দর্যচর্চাভিত্তিক ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম সাজগোজ ডটকম কনটেন্ট সাইট হিসেবে ২০১৩ সালে শুরু হয়। এ প্ল্যাটফর্ম সৌন্দর্যবিষয়ক নিবন্ধ ও পরামর্শ টিপস নিয়ে লেখা দিয়ে থাকে। এ ছাড়া এ-সংক্রান্ত ভিডিওর একটি বড় তথ্যভান্ডারও হয়ে উঠেছে সাজগোজ। ফেসবুক-ইউটিউবে এখন সবার নির্ভরতার জায়গা হয়েছে প্ল্যাটফর্মটি। শুরুর সময়ে প্রতিষ্ঠানটি সিঙ্গাপুরভিত্তিক অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টমেন্ট নেটওয়ার্ক, ব্র্যাক-ওসিরিস ইমপ্যাক্ট ভেঞ্চার ও আহান ইনভেস্টমেন্টস প্রাইভেট লিমিটেড থেকে বিনিয়োগ পেয়েছিল।
বর্তমানে সাজগোজ ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির পথে রয়েছে। ২০১৮ সালে ই-কমার্স ব্যবসা চালু করে সাজগোজ। দেশের শীর্ষ পাঁচটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে থাকা এ প্রতিষ্ঠান বর্তমানে প্রতি মাসে ১ লাখ ৮০ হাজার অর্ডার সরবরাহ করছে। পাশাপাশি সারা দেশে একই সরবরাহ মাশুলে ৪০০টি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পণ্য বিক্রি করছে সাজগোজ।
সম্প্রতি সাজগোজ ডটকম ২১ কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। এর মধ্যে ভারতের সেকোয়া ক্যাপিটাল ১৭ কোটির বেশি (২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) টাকা বিনিয়োগ করেছে। আর বাকি টাকা দিয়েছে বাংলাদেশি প্রযুক্তিভিত্তিক ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি এসবিকে টেক ভেঞ্চার। বিনিয়োগের এ অর্থ ভোক্তা, প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ করা হবে। বিনিয়োগের এ অর্থ গ্রাহক সংগ্রহ, নতুন বিক্রয়কেন্দ্র খোলা ও ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে আরও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডকে যুক্ত করা হবে।
দিনে দিনে দেশের মানুষের কাছে বিশ্বস্ত হয়ে ওঠা এ প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে কর্মরত মানুষ তিন শতাধিক। এর ৬৫ শতাংশ নারী কর্মী। নারীরা কর্মক্ষেত্র থেকে ঝরে পড়েন খুব সহজেই। সমাজ, পরিবারের চাপের চেয়ে সন্তান কার কাছে নিরাপদে রেখে আসবেন, এ ব্যবস্থা করতে না পেরে লাখো কর্মজীবী নারী তাঁদের কর্মক্ষেত্র থেকে ঝরে পড়েন। সাজগোজ ডটকমের কর্মস্থলের প্রতিটি পদক্ষেপ নারীবান্ধব।
একজন নারী হিসেবে এ কঠোর পরিশ্রমের পথ পাড়ি দেওয়া ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সিনথিয়া ইসলাম বলেন, ‘আমার প্রথম সন্তান হয় ২০১৫ সালে। ২০১৭-তে দ্বিতীয়বার মা হই। দুই সন্তান নিয়ে কাজ করা সমস্যা হয়ে যেত যদি আমাদের অফিস নারীবান্ধব না হতো। আমার ছোট বাচ্চা দুটোকে নিয়ে অফিস করেছি। পুরো অফিস ওরা ঘুরে বেড়িয়েছে। সন্তানেরা চোখের সামনে ছিল বলে আমি পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পেরেছি। প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী বলে এ সুযোগ পেয়েছি, সেটা কিন্তু নয়। সাজগোজ ডটকমের সব নারীই এ সুযোগ পান। ৬৫ শতাংশ নারী স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারছেন। কারণ, আমরা চিহ্নিত করছি কখন নারীরা চাকরি থেকে সরে আসেন। তাঁদের সমস্যাটা কোথায় এবং কীভাবে তার সমাধান করা যায়। যখনই নারীরা সন্তানসম্ভবা হন, তাঁদের প্রথম তিন মাস ওয়ার্ক ফ্রম হোমের সুবিধা থাকে। করোনা শুরু হওয়ার আগে থেকেই প্রতিষ্ঠানের নারীরা এ সুবিধা পান। আমি বিশ্বাস করি, বাসায় সন্তান অনিরাপদ রেখে এলে মা শুধু হাত নিয়ে অফিস করতে পারেন। কিন্তু আমরা চাই হাত ও মন। তাই সবাই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে অফিস করতে পারেন। দিবাযত্ন কেন্দ্র তৈরির প্রস্তুতি চলছে। মায়েরা যেন সন্তানের দেখাশোনার কারণে কর্মক্ষেত্র থেকে ঝরে না পড়েন, এটাই আমাদের লক্ষ্য।’