বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের সহজাত সংকোচে ভালোবাসার কথাগুলো কখনো বলা হয়ে ওঠে না। তাই তুমি যে কত অসাধারণ একজন মা, কখনো তোমাকে মুখ ফুটে বলিনি। আজ এই খোলা চিঠিতে বলার চেষ্টা করি।
আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমার টেন মিনিট স্কুলে ‘কীভাবে সন্তান প্রতিপালন করতে হয়’ নামের একটা কোর্স চালু করব। শিক্ষক হবে তুমি। তুমি সবাইকে শেখাবে—ভালো মা মানেই সব সময় সন্তানের পেছনে লেখাপড়া, খাওয়াদাওয়া, সবকিছু নিয়ে লেগে থাকা নয়। ছোটবেলা থেকে তুমি আমাদের যে স্বাধীনতা দিয়ে বড় করেছ, তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। তুমি আমাদের স্বাধীনভাবে চলতে শিখিয়েছ, স্বাধীনভাবে ভাবতে শিখিয়েছ। স্বাধীনতা দিয়ে কীভাবে দায়িত্ববোধ তৈরি করতে হয়, সেটা আমি তোমার কাছ থেকেই শিখেছি।
এমনকি আইবিএ থেকে পাস করে বড় বেতনের চাকরি না করে অনলাইনে ‘স্কুল মাস্টার’ হওয়ার এই খ্যাপাটে আইডিয়াতেও তুমি সাহসের সঙ্গে পাশে থেকেছ। তুমি কখনো ভয় পাওনি এমন নয়, তবে সে ভয়কে আমার কাছে পৌঁছাতে দাওনি। নিজের মনের ভেতরের ভয় থেকেও আমাকে আগলে রাখার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ, আম্মু।
সেনা কর্মকর্তার সন্তান হিসেবে আমাদের অনেকটা সময় একজন অভিভাবকের ছায়াতেই বড় হতে হয়েছে। তোমার কাছেই পড়ালেখার শুরু। আব্বুর অনুপস্থিতিতে তুমি বেশ বড় একটা সময় আমাদের দুই ভাইকে লালন–পালন করেছ। এক হাতে এ রকম দুটো ত্যাঁদর ছেলে মানুষ করা সহজ কথা নয়। তুমি সেই দুঃসাধ্য সাধন করেছ। তুমিই সুপার মম।
আমার কাজের বড় একটা অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেখানে আমাকে নিয়ে সুনাম যেমন আছে, তেমনি নানা আজেবাজে কথারও অভাব নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা হয় আরকি। এগুলো তোমার চোখে পড়ে। নিশ্চয় তুমি কষ্ট পাও, দুশ্চিন্তাও করো। কিন্তু সেই কষ্ট, দুশ্চিন্তা কখনো আমার কান পর্যন্ত পৌঁছাতে দাও না।
আমি সন্তান হিসেবে তোমার কাছে যত কিছু চেয়েছি এবং পেয়েছি, তুমি মা হিসেবে আমার কাছে কখনো কিছু চাও না। এত বছর পর যখন শখ করে তোমাকে একটা টিভি কিনে দিলাম, আমাকে কমপক্ষে ১০ বার জিজ্ঞেস করেছ যে আমার টাকা শেষ হয়ে গেল কি না! এমনকি নিছক পারিবারিক সময়টাও তোমার সঙ্গে কাটানো হয় না। কখনো কখনো সপ্তাহ কেটে যায়, তোমার সঙ্গে ঠিক করে কথা হয় না। তুমি সব সময় বলো, আমি নাকি ফড়িংয়ের মতো লাফাতে থাকি। তবে এ নিয়ে তোমার যে কোনো অভিযোগ আছে, তা-ও তো না। ঘর গোছানো, রুটিন মেনে চলা, রাত না জাগা আর পানি খাওয়া নিয়ে তোমার পরামর্শগুলো আমলে নিয়ে কাজ শুরু করে দেব, কথা দিচ্ছি।
তোমার মতো মায়ের ঋণ শোধ করতে রীতিমতো তোমাকে মাথায় তুলে রাখার কথা, সেখানে আমি তো কিছুই করি না। তবে কথা দিচ্ছি আম্মু, যেদিন আমার স্বপ্নের টেন মিনিট স্কুলটা ঠিকমতো দাঁড় করাতে পারব, দেশের কোটি কোটি ছাত্রের কাছে পৌঁছে যেতে পারব, সেদিন কাজ থেকে এক মাসের ছুটি নেব শুধু তোমার জন্য। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে পৃথিবী ঘুরে বেড়াব। তোমাকে নিয়ে হজে যাব। আমার স্বপ্নপূরণের শেষ দিন পর্যন্ত সঙ্গে থেকো। কারণ, আমার স্বপ্নের মেরুদণ্ড তোমার হাতেই গড়া।