আশার আলোয় উদ্ভাসিত

‘চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল। পাঠশালার স্যাররা আমার মা-বাবাকে বুঝিয়ে বিয়ে বন্ধ করেন। তারপর এখানে নিয়ে আসেন। আমি প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছি। এখন নবম শ্রেণিতে পড়ছি।’ রমিছার কথা এগুলো। রমিছা যে পাঠশালার কথা বলছে, সেটি কুড়িগ্রামের আশার আলো পাঠশালা। শুধু পড়াশোনা নয়, বাল্যবিবাহ রোধ, মাদকবিরোধী প্রচারণা, বয়স্কশিক্ষা—এমন নানা কাজ করে এই সংগঠন।
কুড়িগ্রামের সীমান্তবর্তী গ্রাম নাখারগঞ্জ। পাশেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দিনহাটা মহকুমা। মাদক, জুয়া আর অশ্লীল নৃত্যের আসর ছিল প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। প্রতিদিন শহর থেকে যুবকেরা মাদকের নেশায় ছুটে আসত এখানে। এ অবস্থা থেকে গ্রামটিকে আলোর পথে আনতে লড়াই শুরু করেন বিশ্বজিৎ কুমার বর্মনের নেতৃত্বে কয়েকজন তরুণ। অন্ধকার দূর করতে প্রথমেই তাঁরা শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। দরিদ্র পরিবারের শিশুদের বিনা পয়সায় পড়ান। এর খরচ জুগিয়েছেন নিজেদের টিউশনি থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে। গড়ে তুলেছেন পাঠদান কেন্দ্র। নাম দিয়েছেন ‘আশার আলো পাঠশালা’।

গল্পের শুরু
গ্রামের অভাবী পরিবারের ছেলে বিশ্বজিৎ কুমার বর্মন। ২০০৯ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগে কয়েকজন বন্ধুসহ ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে পড়তে শিক্ষকের কাছে যান। কিন্তু তাঁদের বিনা পয়সায় পড়াতে কেউ রাজি হননি। টাকা দিয়ে পড়বেন, সেই সামর্থ্যও নেই। বিষয়টি সবার মনে দাগ কাটে। বন্ধুরা প্রতিজ্ঞা করেন, নিজেদের চেষ্টাতেই পড়াশোনা করবেন।
সবাই এসএসসি পাস করেন। ভর্তি হন রায়গঞ্জ কলেজে। বিশ্বজিৎ একদিন জানতে পারেন, তাঁদের গ্রামে চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রীর বিয়ের কথাবার্তা চূড়ান্ত হচ্ছে। তিনি বন্ধুদের নিয়ে সেই বাড়িতে যান। ছাত্রীর বাবাকে বুঝিয়ে বিয়ে বন্ধ করেন। ওই ছাত্রীকে পড়ানোর দায়িত্বও নেন তাঁরা। এই বিষয়গুলো ভাবায় তাঁদের। একদিন কলেজ শেষে বন্ধুদের নিয়ে বসেন। দরিদ্র শিশুদের পড়াশোনার বাধাবিপত্তি ও তাদের কীভাবে সহায়তা করা যায়—এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। একপর্যায়ে বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নেন, স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুদের বিনা পয়সায় পড়াবেন।

পাঠশালা এখন
হেমন্তের মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে ১১ নভেম্বর সকালে কুড়িগ্রাম থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের নাখারগঞ্জ গ্রামে যাই। সড়কের দুই ধারে সোনারঙা পাকা ধান। এখানে বাঁশঝাড় ও গাছগাছালির নিচে সব্যসাচী সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়ের মাঠেই আশার আলো পাঠশালার পাঠদান কেন্দ্র। মাঠের পশ্চিম পাশে লম্বা একটি টিনের ঘর। এই ঘরেই চলছে পাঠদান।
আমরা পৌঁছাতেই এগিয়ে এলেন একঝাঁক তরুণ। বিশ্বজিৎ, গুণেশ্বর, রাজু, শেফালী, হামিদা, আমিনুর, নূর ইসলাম, সাবিনা অনেকেই। তাঁদের সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে ঢুকতেই শিক্ষার্থীদের পাওয়া গেল। জানা গেল, এরা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী এবং জেএসসি পরীক্ষায় খুবই ভালো ফল করেছে। গত বছর জেএসসি পরীক্ষায় ১১ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে, পাসের হার শতভাগ। এখন এখানে ১৬০ জন পড়াশোনা করছে।
অভাবের কারণে পড়ালেখা বাদ দিয়ে অন্যের বাসায় কাজ করত ফাতেমা আখতার। ‘একদিন স্যারেরা সেই বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলে আমাকে আবার স্কুলে ভর্তি করে দেয়। কাজের ফাঁকে পোড়াশোনায় সাময় দিতাম।’ ফাতেমা এভাবেই সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষা দেয়। ফল জিপিএ-৫। ‘এখন আর আমাকে অন্যের বাসায় কাজ করতে হয় না। স্যাররা একটি টিউশনির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এ ছাড়া পড়াশোনার সব খরচও তাঁরা দিচ্ছেন।’
আশার আলো পাঠশালার ছাত্র মাসুদ রানা। সে বলে, ‘আমরা তিন ভাই। সবাই স্কুলে পড়তাম। বাবা ফেরি করে পাউরুটি বিক্রি করতেন। একদিন তাঁর সাইকেলটা ভেঙে যায়, ফলে পাউরুটি বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের তিন ভাইকে তখন কারখানায় কাজ করতে হতো।’ পাঠশালার তরুণেরা এই তিনজনকে আবার পড়াশোনার সুযোগ করে দেন। তাঁদের বাবাকেও একটি সাইকেল কিনে দেন। সে বছরই মাসুদ রানার বড় দুই ভাই অষ্টম ও পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়। মাসুদের বড় ভাই মজনু এখন স্নাতক পড়ছেন, মেজো ভাই এইচএসসি। খরচ দিচ্ছেন সেই আশার আলোর তরুণেরাই।
পথে কথা হয় অভিভাবক রফিজ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি রিকশা চালান। তিনি বলেন, ‘অর্থাভাবে ছেলেমেয়েকে পড়াতে পারিনি। আশার আলোর ছেলেমেয়েরা আমার দুই সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যায়। অনেক বুঝিয়ে বলে পড়াইতে কোনো টাকা লাগবে না। পরে হমরায় (তাঁরা) ভর্তি করে দেয়।’
এই পাঠশালায় পড়ুয়া ১৬০ শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের কাহিনি কমবেশি এমনই। এদের কেউবা বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা পেয়ে পড়ালেখা করছে। কেউ তৈরি পোশাক কারখানা কিংবা চায়ের দোকান থেকে ফিরে পড়ালেখা করছে। তবে বাল্যবিবাহের হাত থেকে রেহাই পাওয়া মেয়েদের সংখ্যা বেশি।
‘নিয়মিত শিক্ষা উপকরণের জোগান না দিতে পেরে মা-বাবারা সন্তানদের পড়ালেখা বন্ধ করে দেন। লাগিয়ে দেন কাজে। অনেকটা বাধ্য হয়েই তাদের খরচ দিতে হয়।’ বললেন বিশ্বজিৎ কুমার বর্মন। পাঠশালায় পড়তে আসা প্রায় ৮৯ জন মেয়ের মা-বাবার সঙ্গে চুক্তি করেছেন তাঁরা—মেয়েদের উচ্চশিক্ষিত করে বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে। ‘তা না হলে মা-বাবারা মেয়েদের পড়ালেখা করাতে রাজি হয় না।’ বলেন বিশ্বজিৎ।

আছে বয়স্কশিক্ষাও
আশার আলো পাঠশালায় বয়স্ক ব্যক্তিদেরও লেখাপড়া শেখানো হয়। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে একে একে আসতে থাকেন বয়স্ক শিক্ষার্থীরা। তাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয়—সবাই হাসিখুশি এবং প্রাণবন্ত। বিভিন্ন বয়সের ছাত্রের সংখ্যা ৩০। পাঠশালার অন্য একটি ঘরে বসেন। সবার হাতে চক আর স্লেট।
আশি ছুঁই ছুঁই হেফাজ উদ্দিন বলেন, ‘গোটালে দিন কাম করি, রাইতোত হামরা পাঠশালাত আসি। একনা পড়ি। আও বাও করি, কম্পুটারোত ছবিটবি দেখি।’ মানে হচ্ছে, তিনি সারা দিন কাজ করে রাতে পাঠশালায় আসেন। একটু-আধটু পড়েন, কম্পিউটারে ছবি দেখেন। শিক্ষার্থী বিমল চন্দ্র (৭৫) বলেন, ‘মনটা খুব ভালো হয়ে যায় এখানে এলে।’ এই শিক্ষার্থীদের যাঁরা পড়ান, তাঁদের একজন হামিদা বেগম বললেন, সপ্তাহে দুদিন পড়ালেখা করানো হয় বয়স্ক ব্যক্তিদের। অন্য দিনগুলোতে তাঁরা বিনোদনের জন্য এখানে আসেন।
হাতের কাজ শিখে আয়
অন্য আর একটি কক্ষে পাওয়া গেল বেশ কিছু নারী ও কিশোরীকে, মোড়া বানানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষক আজিয়া বেগম বলেন, ‘পাঠশালার সহায়তায় তিনি অল্প খরচে গ্রামের নারীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এর ফলে অনেক নারীর আজ কর্মসংস্থান হচ্ছে।’ প্রশিক্ষণার্থী রহিমা বেগম জানান, পাঠশালায় বিনা খরচে সেলাই প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তিনি। এখন সপ্তাহে ৪০০-৫০০ টাকা আয় হয় তাঁর। এসব প্রশিক্ষণে সরকারের যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরও মাঝেমধ্যে সহযোগিতা করেছে।
মাদক ও বাল্য বিবাহ রোধে
আশার আলোর শিক্ষক শেফালী বেগম জানালেন পাঠদানের পাশাপাশি মাদক ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি নিয়ে কাজ করা হয়। গ্রামের মেয়েদের ক্রিকেট প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে উঠোন বৈঠক, বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে প্রচারণা চলতেই থাকে। এদিকে গ্রামের লোকজনের মধ্যে বিনা মূল্যে সবজি ও ঔষধি গাছ বিতরণও করা হয়েছে। পাঠশালাটিতে রয়েছে একটি পাঠাগার। পাঠাগারে দুটি দৈনিক পত্রিকা রাখা হয় নিয়মিত। একটি ল্যাপটপ কম্পিউটারও রয়েছে। সেটিতে আছে ইন্টারনেট সংযোগ।
নানা ধরনের কাজের জন্য স্বীকৃতিও মিলেছে আশার আলো পাঠশালার। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বিশেষ অবদানের জন্য জেলা প্রশাসক বিশেষ সম্মাননা দেন সংগঠকদের। চলতি বছরের ১ মে জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে এ সংগঠনটি। রামখানা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সহিদুর রহমান তালুকদার বললেন, ‘বিশ্বজিৎ ও তাঁর সংগঠন ছয় বছর ধরে বাল্যবিবাহ ও মাদকাসক্তি রোধে ব্যাপক কাজ করেছে।’
আশার আলো পাঠশালা গড়ে তোলার জন্য বিশ্বজিৎ বর্মনকে নানা বাধা পেরোতে হয়েছে। বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে গিয়ে জনরোষের মুখে পড়তে হয়েছে বেশ কয়েকবার। সংগঠনের শুরুতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সবাই নিজেদের পড়াশোনার জন্য চলে গেছেন। কিন্তু বিশ্বজিৎ যাননি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েও সংগঠনের কাজে ব্যাঘাত ঘটবে বলে পড়তে যাননি। বর্তমানে রংপুরের কারমাইকেল কলেজে স্নাতক (সম্মান) পড়ছেন। পাঠদান চালু রাখতে স্বল্প খরচে চারজন শিক্ষক রাখতে হয়েছে। শিক্ষকদের সম্মানী ও ছেলেমেয়েদের খাতা-কলম ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে মাসে প্রায় ৮-৯ হাজার টাকা খরচ হয়। এই টাকাটা জোগাতে এখনো টিউশনি করেন। পাশাপাশি বিত্তবানদের সহযোগিতাও নেন। তারপরও গ্রামের ছেলেমেয়েদের স্বপ্ন পূরণ করতে নিরন্তর চেষ্টা বিশ্বজিৎ ও তাঁর সঙ্গীদের।