
চৌদ্দ বছর বয়সের ছেলে ফাহিম। প্রায়ই দেখা যায় যে সে ঘরের দরজা বন্ধ করে ল্যাপটপে কিছু একটা করে। বাবা-মা জিজ্ঞেস করলে বলে, গেম খেলি। কেবল ল্যাপটপে নয়, মাঝেমধ্যে সে তার মুঠোফোনেও ব্যস্ত থাকে এবং অবশ্যই সবার আড়ালে। মায়ের একদিন সন্দেহ হলো, ফাহিমের অনুপস্থিতিতে তিনি তার ল্যাপটপ ঘেঁটে দেখতে পেলেন গত এক মাসে ফাহিম অসংখ্যবার একাধিক পর্নোসাইট ব্রাউজ করেছে। সেখান থেকে সে উত্তেজক ভিডিও নামিয়েছে, সেগুলোও ল্যাপটপে রাখা আছে! এরপর সুযোগ বুঝে তিনি ফাহিমের মুঠোফোন পরীক্ষা করেও একই ধরনের ওয়েবসাইটে আগ্রহের প্রমাণ পেলেন। এসব দেখে তিনি ফাহিমের বাবাকে সব খুলে বলে ফাহিমের ল্যাপটপ, মুঠোফোন সরিয়ে নিলেন আর ফাহিমকে দিলেন বেদম পিটুনি।
কিন্তু বকুনি আর পিটুনি এই সমস্যার সমাধান নয়। আর কেবল উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরীরাই নয়, অনেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ রয়েছেন যাঁরা এই পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। এই পর্নো আসক্তি কখনো আসক্তিজনিত সমস্যা (অ্যাডিকশন), কখনো বাধ্যতাধর্মী আচরণের সমস্যা (অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার), আবার কখনো তা যৌন বিকৃতির অংশ। পর্নো আসক্তি নিজেই একটি সমস্যা, আবার কখনো তা বিভিন্ন মানসিক রোগের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ।
নানা কারণে পর্নো আসক্তি হতে পারে। কয়েকবার পর্নো দেখার পর মস্তিষ্কের তৃপ্তি কেন্দ্র, বিষয়টির সঙ্গে একটি শর্তাধীন অবস্থা তৈরি করে, যা ক্রমে অভ্যাসে পরিণত হয়, অভ্যাস থেকে তৈরি হয় আসক্তি। ব্যক্তিত্বের ধরন, সঠিক যৌন শিক্ষার অভাব, পরিবেশের প্রভাব, মানসিক চাপ সামলাতে না পারা, শিশু বয়সে নির্যাতনের শিকার হওয়া, অন্যকে দেখে শেখা, সমবয়সীদের চাপ (পিয়ার প্রেশার), ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা, সুস্থ বিনোদনের অভাব, পরিবারে নৈতিকতার চর্চা কম থাকা ইত্যাদি কারণেও পর্ণ আসক্তি জন্মাতে পারে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় চার কোটি বিভিন্ন বয়সী মানুষ মোটামুটি নিয়মিতভাবে পর্নোগ্রাফি দেখে থাকে। মুঠোফোন থেকে প্রতি পাঁচটি ইন্টারনেট সার্চের একটি হচ্ছে পর্নোসাইট সার্চ। মার্কিন বিবাহিত পুরুষদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ নিয়মিত পর্নোসাইট দেখেন। পাশ্চাত্যের গবেষণায় দেখা যায়, ১৮ বছরের নিচে প্রতি ১০ জন কিশোরের মধ্যে ৯ জন আর প্রতি ১০ জন কিশোরীর মধ্যে ৬ জন অন্তত একবার পর্নোগ্রাফি দেখেছে। বাংলাদেশে খুব ছোট আকারের একটি জরিপে দেখা গেছে, স্কুলপড়ুয়া কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখে থাকে। প্রথমে তৈরি হয় কৌতূহল, এরপর আগ্রহ, আগ্রহ থেকে অভ্যাস আর অভ্যাস থেকে আসক্তি। বেশ কিছু লক্ষণ দেখে বুঝতে হবে কারও মধ্যে পর্নো আসক্তি তৈরি হয়েছে কি না।
পর্নো আসক্তির খারাপ দিক
• যৌন বিষয় সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাব তৈরি হয়। যৌনতার যে একটি বড় পরিসর রয়েছে তা না বুঝে খণ্ডিতভাবে ভুল আর অসম্পূর্ণ জ্ঞানলাভ করে।
• এই আসক্তি নৈতিকতা আর ধর্মচর্চার পরিপন্থী।
• বিবাহিত জীবনকে বাধাগ্রস্ত করে, যৌনস্পৃহার পরিবর্তন ঘটায়। বিকৃত যৌনচর্চার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
• আসক্ত হয়ে পড়লে দিনের একটা বড় সময় এ বিষয় নিয়ে চিন্তা করে, চর্চা করে। ফলে পড়ালেখার মান খারাপ হয়, কর্মক্ষেত্রে কাজের মান কমে যায়। উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়।
• নিজেকে সামাজিক কাজগুলো থেকে গুটিয়ে রাখে, কখনো হীনম্মন্যতা তৈরি হয়।
• আচরণের পরিবর্তন দেখা যায়, হঠাৎ করে রেগে ওঠে, মেজাজ খিটখিটে থাকে, বিষণ্নতা দেখা দেয়। পর্নোর প্রভাবে নানা সামাজিক বা যৌন অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে।
• মার্কিন গবেষক ড. জুডিথ রিসম্যান পর্নোকে ‘ইরোটোটক্সিন’ বলে আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘পর্নোচর্চা করতে থাকলে মস্তিষ্কে ডোপামিন, এপিনেফ্রিন, এন্ডোরফিন জাতীয় রাসায়নিক পদার্থের সাম্যাবস্থা নষ্ট হয়, মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, চিন্তা ও আচরণের সমস্যা দেখা দেয়।’
• আসক্ত ব্যক্তি জড়িয়ে যেতে পারে সাইবার অপরাধে বা নিজেও সাইবার অপরাধের শিকার হতে পারে।
• পর্নো আসক্তি অনেক সময় অবসেসিভ কম্পালসিভ সমস্যা অথবা আবেগের বাড়াবাড়ির সমস্যার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হয়ে উঠতে পারে। পর্নো আসক্তি থেকে জন্ম নিতে পারে মাদকাসক্তির মতো আরেকটি ভয়াবহ অসুখ।
প্রতিরোধ আর প্রতিকার
কিশোর-কিশোরীসহ যে কাউকে পর্নো আসক্তি থেকে দূরে রাখতে হলে একদিকে প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে আবার অন্যদিকে কেউ আসক্ত হয়ে পড়লে প্রতিকারও করতে হবে। এর জন্য যা যা করা যেতে পারে—
সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক না হলে প্রযুক্তির ব্যবহার, বিশেষ করে ইন্টারনেটের ব্যবহারের একটি পারিবারিক নীতিমালা তৈরি করতে হবে। যেমন দিনের নির্দিষ্ট সময়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করা, কম্পিউটার, ট্যাব, মুঠোফোন প্রকাশ্য স্থানে ব্যবহার করা, দরজা আটকে এগুলো ব্যবহার করতে নিরুৎসাহিত করা, বাথরুমে মুঠোফোন নিয়ে যেতে না দেওয়া।
সন্তানকে তার বয়স উপযোগী যৌনশিক্ষা দিতে হবে। বাবা-মাসহ স্কুলের দায়িত্ব এ ক্ষেত্রে বেশি। উঠতি বয়সে যৌন বিষয়ে আগ্রহ জন্মাবে। সঠিক আর বিজ্ঞানসম্মত যৌনজ্ঞান না থাকার কারণে পর্নো আসক্তি তৈরি হয়।
• পারিবারিকভাবে নৈতিকতার চর্চা বাড়ানো।
• পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যদের দায়িত্বশীলভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হবে। যৌক্তিকভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার করুন। কারণ ছাড়া কম্পিউটার, মুঠোফোনের ব্যবহার পরিহার করুন।
• প্রয়োজনে প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হবে। বেশ কিছু সফটওয়্যার আছে, যা ব্যবহার করলে ওই ইন্টারনেটের লাইন থেকে বা নির্দিষ্ট মুঠোফোন থেকে কোনো পর্নোসাইটে প্রবেশ করা যাবে না। ইন্টারনেট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইচ্ছা করলে পর্নো সাইটগুলো বন্ধ রেখে গ্রাহককে সেবা দিতে পারে। এ জন্য প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
• সন্তানদের গুণগত সময় দিতে হবে। বাবা-মা বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে, আড্ডা দিয়ে, খেলা করে, একসঙ্গে টিভি দেখে বা বেড়াতে গিয়ে যেন তারা আনন্দ পায়, সেই অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। পরিবারের মধ্যে সুস্থ বিনোদনের চর্চা বাড়াতে হবে।
• সন্তানের এ ধরনের আচরণ দেখলে রাগ না করে বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে, আসক্তির খারাপ দিকগুলো তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে। এটি নিয়ে তাকে বক্রোক্তি, ব্যঙ্গ করা যাবে না।
• কেউ যদি নিয়মিত পর্নো দেখতে থাকে, তবে এই অভ্যাস দূর করার জন্য তাকে বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপি, কাউন্সেলিং, মোটিভেশনাল ইন্টারভিউইং, মাইন্ডফুলনেসসহ ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে। মেডিটেশন, রিলাক্সেশন ইত্যাদির চর্চাও কমাতে পারে পর্নো আসক্তি। যদি মনে হয় কারও পর্নোচর্চার বিষয়টি আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে, তবে তা গোপন না করে, লুকিয়ে না রেখে যত দ্রুত সম্ভব মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে হবে।
পর্নো আসক্তির লক্ষণ
নিয়মিতভাবে এবং অতিরিক্ত হারে পর্নো সাইট ভিজিট করা, উত্তেজক ভিডিও, ছবি দেখা বা কাহিনি পড়া।
ল্যাপটপ বা মুঠোফোন সব সময় অন্যের কাছ থেকে আড়াল করে ব্যবহার করা। কখনো দেখা যায় বাথরুমেও মুঠোফোন নিয়ে প্রবেশ করছে।
• অনেক সময় দেখা যায় পরিবারের কোনো সদস্য কাছাকাছি গেলে সে কম্পিউটারের পর্দা পরিবর্তন করে ফেলছে, সার্চ হিস্ট্রি মুছে ফেলছে ইত্যাদি। তার মুঠোফোন বা কম্পিউটারে সঞ্চিত উত্তেজক ভিডিও বা চিত্র পাওয়া যাচ্ছে।
• প্রতিদিনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় উত্তেজক ভিডিও, ছবি, কাহিনি দেখে ব্যয় করে। এই সময় ব্যয়ের কারণে দৈনন্দিন কাজগুলো ব্যাহত হয় এবং পড়ালেখা বা অন্যান্য কাজের মান কমে যায়। বাড়িতে একা থাকতে চায়, সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে উৎসাহবোধ করে না।
• দিনে দিনে সহ্যসীমা (টলারেন্স) বাড়তে থাকে। বিষয়ে আগের চেয়ে বেশি বেশি সময় ব্যয় হতে থাকে এবং পর্নো দেখে তৃপ্ত হতে আগের চেয়ে বেশি সময় নেয়। আগের চেয়ে বেশি উত্তেজক এবং বিকৃত ধরনের পর্নো দেখার প্রবণতা তৈরি হয়।
• পর্নো দেখার ক্ষতিকারক দিকগুলো জানা সত্ত্বেও বা এ ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হলেও পর্নো দেখার অভ্যাস পরিত্যাগ করতে না পারা।
• অনেক সময় পর্নোগ্রাফি দেখে অতিরিক্ত হস্তমৈথুন করার অভ্যাস তৈরি হয়, যা পরে নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক সমস্যার কারণ।
• পর্নো আসক্তির কারণে স্বাভাবিক যৌনজীবন ব্যাহত হয়। সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হতে থাকে।
• অনেক সময় পর্নো দেখে মনের উৎকণ্ঠা, অস্বস্তি আর বিষণ্নতা কমানোর অভ্যাস তৈরি হতে থাকে।
• আবেগের বহিঃপ্রকাশ আর আচরণের কিছু পরিবর্তন হতে পারে। ক্রমাগত মিথ্যা বলার অভ্যাস তৈরি হয়, আগ্রাসী আচরণ বেড়ে যায়।
সহকারী অধ্যাপক জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা