
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন।—বি. স.
সমস্যা
ছোটবেলা থেকে আমি সবার থেকে একটু আলাদা থাকতাম। বন্ধু নেই বললেই চলে। মা–বাবার সঙ্গেও আমার খুব একটা ভালো সম্পর্ক নেই। বাবা খুব কড়া মানুষ ছিলেন। তিনি আমার সম্পর্কে বাইরের মানুষের কথায় বেশি ভরসা করতেন। আমি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছি। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় আমি এক অবিবাহিত শিক্ষকের বাসায় পড়তে যেতাম। তখনো যৌনতা সম্পর্কে জানা ছিল না। পঞ্চম শ্রেণির মাঝামাঝি পর্যায়ে তিনি আমার সঙ্গে চরম নোংরামি শুরু করেন। এভাবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চলে। বাবার বদলির পরে আমরা ঢাকায় চলে আসি। আকস্মিকভাবে একজনের প্রতি আমার দুর্বলতা সৃষ্টি হয়। আমি কোনো দিন নিজের মুখে তাঁকে কিছুই বলিনি। একসময় তাঁর কাছ থেকে আমি জীবনে চরম আঘাত পাই। তবে থেমে থাকিনি। নিজেকে পড়াশোনায় নিবিষ্ট করে সব ভুলে থাকার চেষ্টা করতাম। কিন্তু গত নভেম্বরের দিকে আমার ভয়াবহ টাইফয়েড ও জন্ডিসের কারণে ছয় মাস শয্যাশায়ী ছিলাম। এখন নিজেকে আর গোছাতে পারছি না। শুধু অতীতের বিষাক্ত স্মৃতিগুলো তাড়া করে। অধিকাংশ সময় দরজা বন্ধ করে থাকি আর এসব ভেবে প্রচুর কান্না পায়। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাকে দিয়ে হয়তো আর কোনো দিন ভালো কিছু হবে না। মেজাজও খিটখিটে হয়ে গেছে। আজকাল মানুষের কথায় কথায় খারাপভাবে জবাব দিই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে চিনতে পারি না। চোখের সামনে পড়াশোনা, ভবিষ্যৎ—সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে, একাকিত্বে ভুগতে ভুগতে সবকিছুতে হেরে গিয়ে দিশেহারা অবস্থায়। আমার পক্ষে কী করা উচিত? কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া সম্ভব নয়।
নাম ওঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ
তোমার শৈশবের দিনগুলো ভালো যায়নি বোঝা যাচ্ছে। যে সময়টি সবচেয়ে উপভোগ্য হতে পারত, তুমি তখন বন্ধুহীন অবস্থায় একাকী কাটিয়েছ। মা–বাবার সঙ্গে নেতিবাচক সম্পর্ক, বাবার নিষ্ঠুর আচরণ তোমাকে যে সেই সময়টিতে তীব্র কষ্টের মধ্যে রেখেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। তিনি তোমার প্রতি আস্থা না রেখে বাইরের যে লোকদের কথা বিশ্বাস করতেন, সেটি অত্যন্ত পীড়াদায়ক। এরপর তুমি একটি ভয়ংকর সময়ের ভেতর দিয়ে গেছ বেশ অনেক দিন।
মা–বাবার সঙ্গে সম্পর্কের দূরত্ব থাকার কারণে তুমি তিন-চার বছর নীরবে একটি বিকৃত রুচির ব্যক্তির নির্যাতনের শিকার হয়েছ, অথচ তাদের কাছে কথাগুলো শেয়ার করে হালকাবোধ করতে পারোনি। কারণ, তুমি হয়তো ভেবেছ, এ ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা বা সহমর্মিতা পাবে না। সেই দুঃসহ স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়া যখন মনের ভেতরে চলছিল, তখন অন্য একজনের কাছ থেকে আবার অনেক বড় একটি ধাক্কা খেলে। এরপরও শুধু নিজের মনের শক্তি প্রয়োগ করে পড়ালেখা করছিলে। দীর্ঘ ছয় মাস দুটো কঠিন রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে তুমি এখন দিশেহারাবোধ করছ। হয়তোবা তখন ক্রমাগত শয্যাশায়ী ছিলে বলে অলস মস্তিষ্কে অতীতের কষ্টের স্মৃতিগুলো তোমাকে তাড়া করেছে।
শৈশব থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে পাওয়া ভীতিকর অভিজ্ঞতাগুলো তুমি সে সময়ে কিছুটা সামলাতে পারলেও এখন আর সেটি সম্ভব হচ্ছে না। প্রচণ্ড হতাশা আর বিষণ্নতায় ডুবে গিয়ে তুমি প্রায় হাল ছেড়ে দিতে চাইছ। যে মানুষটি আগে সব প্রতিকূলতাকে দুপাশে সরিয়ে সামনে চলছিল, তাকে তুমি নিজের ভেতরে এই মুহূর্তে হয়তো খুঁজে পাচ্ছ না। তবে সৃষ্টিকর্তা আমাদের মধ্যে অফুরন্ত ক্ষমতা দিয়েছেন। নিজের ওপরে তোমার সবটুকু আস্থা হারিয়ে যায়নি। প্রতিদিন কিছুটা সময় ধরে নিজেকে মনে মনে উৎসাহ দিয়ে বলো, তুমি নিশ্চয়ই আবার এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসবে। যদি একা একা এটি করা খুব কঠিন মনে হয়, তাহলে ০৯৬১২২২২৩৩৩ (টেলিসেবা) নম্বরে ফোন করে কাউন্সেলিং সেবা গ্রহণ করো।