‘আয়রনম্যান’ শব্দটা শুনলেই চোখের সামনে যে পেশিবহুল মানুষের অবয়ব ভেসে ওঠে, মোহাম্মদ শামছুজ্জামান আরাফাতকে দেখে তা মেলানো গেল না!
মধ্য অক্টোবরের এক দুপুর। তাঁকে প্রথম আলো কার্যালয়ে নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। উদ্দেশ্য, দুপুরের খাবার খেতে খেতে তাঁর গল্প শুনব। তিনি এলেন যখন, দেখি নিতান্তই সাধারণ দেখতে এক তরুণ! তাহলে এই আরাফাত কীভাবে লৌহমানবে পরিণত হলেন?
তার আগে কিছু প্রাক্–কথা বলে নিই। প্রতিবারের মতো এবারও প্রথম আলোর বর্ষপূর্তি উপলক্ষে একটি প্রামাণ্যচিত্র বানানোর ডাক পড়ল, যেটা নির্মাণের জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকি। দীর্ঘদিন ধরে ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম চরকির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার কারণে নির্মাণে কিছুটা বিরতি। নিজেও ক্যামেরার আলোর উত্তাপ নেওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিলাম। কিন্তু এবারের অনুপ্রেরণাদায়ী গল্পটি কী হবে? কার গল্প বললে মানুষ উজ্জীবিত হবে নতুন আলোর পথে? সে রকম একটা গল্প খুঁজে বের করা দুঃসাধ্যই বটে। প্রথম আলোয় গত বছর ছাপা হয়েছে অসংখ্য অনুপ্রেরণাদায়ী, সাড়া জাগানো প্রতিবেদন।
বাছাই করতে করতে হিমশিম, প্রথম আলোর যুগ্ম ফিচার সম্পাদক পল্লব মোহাইমেন প্রস্তাব করলেন ‘আয়রনম্যান’–এর কথা। মোহাম্মদ শামছুজ্জামান আরাফাত নামের এই বিস্ময় তরুণের গল্প জেনেই আমার মনে হলো, অদম্য তারুণ্যের এই গল্পই হতে পারে প্রামাণ্যচিত্রের বিষয়বস্তু। তিনিই হতে পারেন নতুন প্রজন্মের আইকন। কেন?
আরাফাত সাতবার বাংলা চ্যানেল (কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত বঙ্গোপাসাগরের ১৬.১ কিলোমিটার স্রোতোধারা) সাঁতরে পার হয়েছেন। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, জার্মানির পর এবার যুক্তরাষ্ট্রে আয়রনম্যান ৭০.৩ ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতায় সাফল্য পেয়েছেন। এসব খবরই বিভিন্ন সময় প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোতে।
আরাফাতের মুখোমুখি
প্রথম আলো কার্যালয়ে দুপুরের খাবার খেতে খেতে আরাফাতের মুখে তাঁর গল্প শুনছি আমি, আমার সহকারী পরিচালক কনক খন্দকার এবং প্রথম আলোর সাইদুজ্জামান রওশন ও পল্লব মোহাইমেন। পরে যোগ দিলেন আনিসুল হক। আমরা জানছি, নিজের প্রচেষ্টায় কীভাবে এক সাধারণ তরুণ ‘লৌহমানব’ হয়ে ওঠেন। তবে তখনো আমি খুঁজছিলাম গল্পের আরও গভীরের গল্প। সেই গল্প, যা নির্মাতা হিসেবে আমাকে স্পর্শ করবে, দর্শককে উজ্জীবিত করবে।
আমার মনে হচ্ছিল, স্পোর্টসম্যান তো সব সময় নিজের আগের রেকর্ড ভেঙে চলেন। এটাই তাঁর সব সময়ের লক্ষ্য। কিন্তু এই রেকর্ড ভেঙে চলার যে সংগ্রাম, সেটি আমরা জানি না। সেই সংগ্রামের কথাই বলব এবারের প্রামাণ্যচিত্রে।
আরাফাতের নানান কথা শোনার মধ্যেই বেরিয়ে এল সেই গল্প। ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। আরাফাত টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া দৌড়যাত্রা শুরু করেছিলেন। ২০ দিনে ১ হাজার ৪ কিলোমিটার পার হয়ে তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টে পৌঁছান তিনি। বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর দিয়ে যাওয়ার অনুমতি না পেয়ে যমুনা নদী সাঁতরে পার হন।
মনে হলো, প্রামাণ্যচিত্রে এবার অদম্য বাংলাদেশের গল্প বলব। সেটা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া যেতে যেতে। বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার না বলা কিছু গল্প বলব। যেখানে উঠে আসবে অপরূপ সৌন্দর্যের বাংলাদেশের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার কথা ও লাখো শহীদের বীরত্বগাথা।
লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন
গত ২৭ অক্টোবর আরাফাতকে নিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফের রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেলাম। প্রস্তুত ক্যামেরা, লাইট। শুরুতে তাঁকে খুঁটিনাটি জানালাম। বললাম, ‘এটা প্রচলিত কোনো শুটিং নয়, সত্যিকারের গল্প বলছি আমরা, যেভাবে দৌড়েছিলেন, সেভাবেই দৌড়াবেন।’ চিত্রগ্রাহক রাজু রাজ পরামর্শ দিলেন, ‘আমরা সকালের “ম্যাজিক লাইট” ধারণ করে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায় যাত্রা শুরু করব।’
তিনটি মাইক্রোবাস, সঙ্গে শুটিংয়ের সরঞ্জামাদি নিয়ে একটি পিকআপ ভ্যানে যাত্রা শুরু। আরাফাত কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়কে দৌড় শুরু করেছেন, আমরাও। একটি মাইক্রোবাসে ক্যামেরা বসিয়ে তাঁকে অনুসরণ করতে থাকি।
কক্সবাজার পার হয়ে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী সেতু, তারপর কুমিল্লা পার হয়ে হয়ে ঢাকা জেলায়। পুরো শুটিং ইউনিট নির্ঘুম, বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ নেই। যথাসময়ে নির্মাণ শেষ করতে হবে। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর দিকে যাত্রার সময় গাড়ির চালকদের পরিবর্তন করে নিই আমরা। শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে গাড়িতে অনেকেই ঘুমানোর সুযোগ পাচ্ছি, কিন্তু চালকদের ওপর চাপ বেড়ে চলছিল।
যমুনায় ঝাঁপ
বঙ্গবন্ধু সেতুতে এসেই সাঁতরানোর মুহূর্ত শুটিংয়ের সময় দেখা গেল বিপত্তি। স্রোত এত বেশি যে ভয়ই পেয়ে গেলাম। কিন্তু এবারও বীরত্বের পরিচয় দিয়ে আরাফাত ঝাঁপিয়ে পড়লেন যমুনার জলে। তীব্র স্রোত আরাফাতকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল অনেক দূরে। এভাবে অনেক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে দৃশ্য ধারণ করে চললাম।
শাওন শিব্বিরের নেতৃত্বে প্রোডাকশন টিম এগিয়ে চলল। যেতে যেতে আরাফাতকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনি সারা বাংলাদেশ দৌড়ানোর সময় সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য কী দেখেছিলেন?’ ভেবেছিলাম তিনি উত্তর দেবেন পাহাড়, সমুদ্র বা সুন্দর ল্যান্ডস্কেপের কথা। কিন্তু তিনি বললেন, একদল মেয়ের সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়ার দৃশ্যের কথা, যা দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।
পঞ্চগড়ে এই দৃশ্য ধারণের ইচ্ছা হলো। সহকারী পরিচালক রাব্বি ও ইলাকে আগেই পাঠিয়ে দিলাম তেঁতুলিয়ায়। স্থানীয় প্রশাসন ও পঞ্চগড়ে প্রথম আলোর প্রতিনিধি রাজিউর রহমানের সহযোগিতায় প্রায় ২০০ মেয়ে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল রাস্তায়। এ ডি কল্লোল সবাইকে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করালেন। আমরা যখন দৃশ্যধারণ শুরু করলাম, সে দৃশ্য দেখে চোখ বারবার ভিজে উঠছিল।
শেষ দৃশ্য
অবশেষে আরাফাতের দৌড়ের শুটিং করতে করতে বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টে পৌঁছালাম। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্যরা আমাদের সহযোগিতা করলেন। তবে শর্ত একটাই, বিকেল চারটার মধ্যে শেষ করতে হবে। আমরা ঝাঁপিয়ে পড়লাম। যেভাবেই হোক, শেষ করতে হবে যথাসময়ে। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান, বীর প্রতীক চলে এসেছেন ঠিক সময়ে। সঙ্গে স্থানীয় অনেক মানুষ। আরাফাতকে সংবর্ধনা দেওয়ার দৃশ্যের পুনর্নির্মাণ করা হলো। আবারও আরাফাত আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন। সবার ভালোবাসায় সেদিনের শুটিং যথাসময়ে শেষ করে রাতে আমরা থাকলাম তেঁতুলিয়ায়। পরদিন বধ্যভূমিতে আরাফাতের শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে আমাদের বাংলাদেশ দৌড়ে যাওয়ার গল্পের দৃশ্যধারণ শেষ হলো।
সম্পাদনার সাতসতেরো
ঢাকায় ফিরেই মাহবুব টিপু শুরু করলেন সম্পাদনার কাজ। টানা তিন দিন নির্ঘুম কাটিয়ে সম্পাদনা সম্পন্ন হলো। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের পুকুর পাড়ে আরাফাতের সাক্ষাৎকার ধারণ করা হলো। চিন্ময় শুরু করল কালার গ্রেডিংয়ের কাজ, রায়হান গ্রাফিকস, রিপন নাথ ও সাউন্ড বক্স ইউনিট শুরু করল শব্দের কাজ। জাহিদ নীরবের সঙ্গে চিরকুটের স্টুডিওতে বসলাম আবহ সংগীতের জন্য। রাসেল মাহমুদের ধারাবর্ণনায় শেষ হলো সম্পাদনার কাজ।
প্রথম প্রদর্শন
আয়রনম্যান আরাফাত প্রামাণ্যচিত্র প্রথম যখন দেখানো হলো, তখন ব্যাপ্তি ছিল ১৪ মিনিট। সম্পাদক মতিউর রহমান, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ, সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক, ফিচার সম্পাদক সুমনা শারমীন, উপসম্পাদক এ কে এম জাকারিয়া, হেড অব ডিজিটাল বিজনেস জাবেদ সুলতানসহ উপস্থিত অনেকে প্রিভিউ করে সবাই একমত হলাম, আরও ছোট করা দরকার।
আবার চ্যালেঞ্জ শুরু হলো গল্প ছোট করার। কোনটা ফেলে কোনটা রাখব! এত এত অনুপ্রেরণাদায়ী ঘটনা! শেষমেশ সাত-আট মিনিটে দাঁড় করালাম আনিসুল হকের পরামর্শে।
প্রথম আলোর ২৩তম বর্ষপূর্তির একটি অনুষ্ঠানে ট্রান্সকম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিমিন রহমান প্রথম আলো কার্যালয়ে এসেছিলেন। তিনি দেখে খুব প্রশংসা করলেন। ২০ নভেম্বর রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে প্রথম আলোর বর্ষপূর্তির প্রীতিসম্মেলনে যখন এটা দেখানো হলো, তখন এক বিশাল ঘটনা ঘটল। মন্ত্রী, কূটনীতিক, পেশাজীবী, লেখক, শিল্পী, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে আমন্ত্রিত সব অতিথি দাঁড়িয়ে জোর করতালির মাধ্যমে আরাফাতকে অভিনন্দন জানালেন। তখন আমার চোখও ভিজে উঠল আরাফাতের মতোই।
রাতে যখন প্রথম আলোর অনলাইনে তথ্যচিত্রটি প্রকাশ করা হলো, মুহূর্তে দর্শকেরা মন্তব্য করতে শুরু করলেন। অবাক হয়ে গেলাম ভিউ, মন্তব্য আর শেয়ারসংখ্যা বাড়তে দেখে। দ্বিতীয় দিনে ২০ লাখ ভিউ শুধু প্রথম আলো পেজেই। লক্ষাধিক শেয়ার আর মানুষের প্রশংসাবাক্য। যাঁদের কেউ কেঁদেছেন, কেউবা দোয়া করছেন আর অসংখ্য দর্শক অদম্য বাংলাদেশের প্রতীক আয়রনম্যানকে স্যালুট জানাচ্ছেন। সঙ্গে নির্মাণের প্রশংসাও করছেন।
তখন মনে হলো, আমরা আসলে প্রত্যেকে বাংলাদেশের জয়ের গল্প শুনতে চাই, বিজয় দেখতে চাই। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে আমরা এগিয়ে নিতে চাই।
লেখক: নির্মাতা