ইংরেজি পড়িয়ে তারকা মুনজেরিন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর, এখন পড়ছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। মুনজেরিন শহীদের খ্যাতি এ কারণে নয়। তিনি নিজের ফেসবুক পেজে, ইউটিউব চ্যানেলে ইংরেজি শেখান। লাখো অনুসারী দেখেন সেসব ভিডিও।

মুনজেরিন শহীদ
ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মুনজেরিন শহীদের মাত্র দুজন বন্ধু জানেন, অনলাইনে ইংরেজি পড়িয়ে তিনি এতটা বিখ্যাত! মুনজেরিন বলছিলেন, ‘আমি অনলাইনে পড়াই—এই বিষয়টি এখনো মানুষকে বলতে লজ্জা পাই। মাঝেমধ্যে তো আমার বিশ্বাসই হয় না যে লাখ লাখ মানুষ আমার ভিডিও দেখে।’

মুনজেরিনের বিশ্বাস না হলেও এটাই সত্যি, অনলাইন দুনিয়ায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ তাঁর কাছে ইংরেজি শেখেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যাঁরা নিয়মিত ব্যবহার করেন, তাঁদের কাছে বেশ পরিচিত টেন মিনিট স্কুলের শিক্ষক মুনজেরিনের ইংরেজি শেখার ভিডিও। মোটা ফ্রেমের চশমা পরা স্কুলের কোনো রাগী শিক্ষক নন মুনজেরিন। বরং সদা হাসিখুশি একজন শিক্ষক। সহজ আর সাবলীল পড়ানোর পদ্ধতিই দর্শকদের কাছে বেশ পছন্দ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন মুনজেরিন। এখন যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লায়েড লিঙ্গুয়েস্টিক অ্যান্ড সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকুইজিশন বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়ছেন। অক্সফোর্ডে যাওয়ার আগেই বেরিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল। প্রথম শ্রেণিতে প্রথম, এই ফলাফল মুনজেরিনের।

হোয়াটসঅ্যাপে কথা হলো মুনজেরিনের সঙ্গে। ফোনের ওপার থেকে জানালেন, খুব বেশি দিন হয়নি তিনি নিজেকে শিক্ষক হিসেবে আবিষ্কার করেছেন। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকেই তিনি টেন মিনিট স্কুলে কাজ করতেন। তবে সেখানে শুরুতে ব্লগ লিখতেন। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মানবসম্পদ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু কখনো ক্লাস নেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, ‘টেন মিনিট স্কুলের অনেকেই বলত, তুমিও তো ক্লাস নিতে পারো। কিন্তু আমি তখন ক্যামেরার সামনে আসতেই লজ্জা পেতাম। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ইংরেজি পড়াব, এটা তো আমি চিন্তাই করতে পারতাম না। এমনিতে পেশাদারিভাবে কখনো টিউশনিও করিনি।’

করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুর দিকে একটানা ঘরে থাকতে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়লেন মুনজেরিন। এরপরই ভিন্ন কিছু করার চিন্তা এল। ঠিক করলেন ভিডিও বানানো শুরু করবেন। মুনজেরিন বলেন, তখন তেমন বিশেষ কোনো প্রস্তুতি ছিল না। ভিডিও করার জন্য কোনো ট্রাইপডও ছিল না তাঁর। পড়ার টেবিলে সামনেই বসে, বইয়ের সঙ্গে মুঠোফোন হেলান দিয়ে রেখে বানিয়ে ফেললেন প্রথম ভিডিও। কিছুটা দ্বিধা তখনো ছিল। মুনজেরিন ভেবেছিলেন, হয়তো কেউ ভিডিও দেখবেই না অথবা দেখলেও সবাই হাসাহাসি করবে। তবে প্রথম ভিডিও প্রকাশের পরই মুনজেরিনের ভাবনার উল্টো কিছু ঘটল। মানুষ সাদরে গ্রহণ করেছেন তাঁর ভিডিও। লাইক, শেয়ার আর মন্তব্যে সবাই উৎসাহ দিয়েছেন।

মুনজেরিন বলেন, ‘ইংরেজি শেখানোর ভিডিও বানানো শুরু করব—এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আমার বন্ধুরা অনেক উৎসাহ দিয়েছে। ওরা বলত, একবার চেষ্টা করেই দেখো। শুরুতে অল্প কয়েকজনই দেখুক। আর কেউ যদি তোমার ভিডিও না–ও দেখে, তাতেও তো সমস্যা নেই।’

২০২০ সালের এপ্রিল মাসে নিজের ফেসবুক পেজ আর ইউটিউব চ্যানেল খুলেছিলেন মুনজেরিন। ৯ মাসের ব্যবধানে সেই ফেসবুক পেজে বর্তমানে অনুসারীর সংখ্যা ৭ লাখের বেশি। আর ইউটিউবে তাঁর ভিডিওগুলো ১৬ লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, মুনজেরিনের নামেই ফেসবুকে বেশ কয়েকটি গ্রুপ রয়েছে। লক্ষাধিক মানুষ এই গ্রুপগুলোর সদস্য। মুনজেরিন জানালেন, তিনি নন বরং ফেসবুক ব্যবহারকারীরাই এই গ্রুপগুলো খুলেছেন। তাঁরা এখানে নিজেদের মতো ইংরেজি বলার চর্চা করেন। বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন।

‘আমি নিজেও এই গ্রুপগুলোর ব্যাপারে জানতাম না। হঠাৎ করেই একদিন চোখে পড়ে। এই গ্রুপগুলো মানুষ নিজের আগ্রহ থেকে খুলেছেন, আবার নিয়মিত নিজেদের মধ্যে ইংরেজি শেখা নিয়ে আলোচনা-চর্চা করেন, এটা দেখে খুব ভালো লেগেছিল। মনে হচ্ছিল, নিজের কাজ সার্থক হলো।’ বললেন মুনজেরিন।

অনলাইনে আরও অনেকেই তো ইংরেজি শেখান। কিন্তু মুনজেরিনের শেখানোর পদ্ধতি কেন সবাই পছন্দ করেছে? মুনজেরিনের কাছেই এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলাম। তাঁর মতে, তিনি খুব বেশি নিয়মকানুন বা ব্যাকরণ ধরে পড়ান না। বরং কোনো পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে উদাহরণ দিয়ে শেখানোর চেষ্টা করেন। যার ফলে সবাই হয়তো খুব সহজেই আয়ত্ত করতে পারেন। মুনজেরিন আরও জানালেন, নিজে ক্লাসে বসে ইংরেজি শিখতে গিয়ে যেই সমস্যাগুলো অনুভব করতেন অথবা বন্ধুদের ক্ষেত্রে যেই সমস্যাগুলো দেখতেন, সেগুলো বিবেচনায় রেখেই তিনি সব সময় পড়ানোর চেষ্টা করেন।

দূর পরবাসে বসেও টেন মিনিট স্কুলে নিয়মিত পড়াচ্ছেন তিনি। ঘরে বসে স্পোকেন ইংলিশ নামে তিনি সম্প্রতি একটি বই বের করেছেন। এ ছাড়া ইংরেজি বলার ওপর বিশেষ একটি কোর্সও রয়েছে তাঁর। ভবিষ্যতে আইইএলটিএস, কর্মক্ষেত্রের ইংরেজি, ছোটদের ইংরেজি বলাবিষয়ক কোর্স শুরু করার পরিকল্পনার কথা জানালেন। বললেন, ‘এখানে ব্যক্তিগত পড়াশোনার বেশ ব্যস্ততা আছে। তাই অক্সফোর্ডে বসে সব কটি কোর্স তৈরির কাজ হয়তো শেষ করতে পারব না। দেশে ফিরেই পুরোদমে কাজ শুরু করব। আমি এত দিন যা কিছু শিখেছি, সেগুলো তো অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া আমার দায়িত্ব।’

মুনজেরিনের সঙ্গে যখন কথা হলো তখন যুক্তরাজ্যে আবার লকডাউন শুরু হয়েছে। তাই ঘরে বসেই সময় কাটছে তাঁর। সুযোগ পেলে বাইরে একা একা হাঁটতে যান। জানালেন, পরিবার, বন্ধুবান্ধব আর টেন মিনিট স্কুলের সহকর্মীদের অনেক মিস করেন। বললেন, ঢাকায় প্রতিদিন কাজ শেষে সন্ধ্যায় চায়ের কাপে বন্ধুদের সঙ্গে পড়াশোনা, রাজনীতি, ইতিহাস কিংবা দর্শনের সেই তুমুল আলোচনা এখন আর বিলেতে কফির মগে জমে ওঠে না।