ইচ্ছাপূরণের পুকুরে

পাহাড়ের ওপর টলটলে পানির পুকুর। ছবি: দীপঙ্কর রোয়াজ
পাহাড়ের ওপর টলটলে পানির পুকুর। ছবি: দীপঙ্কর রোয়াজ

হেঁটে আমাদের গন্তব্য এবার দেবতার পুকুর। এখানে এসে আরজি জানালে নাকি পূরণ হয় মনের ইচ্ছা। রোগমুক্তিও মেলে। ইচ্ছাপূরণের সেই পুকুরের স্থানীয় নাম মাতাই পূখিরী।খাগড়াছড়ির টিপরা-অধ্যুষিত থুলিপাড়া থেকে আমাদের হাঁটা শুরু হলো। উদ্দেশ্য সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় এক হাজার ৫০০ ফুট ওপরে পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত মাতাই পূখিরী পরিদর্শন। আধঘণ্টার মতো হাঁটার পর পৌঁছে যাই সেখানে। থুলিপাড়া থেকে কিছুটা এগোলেই চোখে পড়ে বড় বড় পাথরের নুনছড়ি ছড়া। সেখান থেকে এক টিপরা নারীকে পানির হাঁড়ি মাথায় নিয়ে ফিরতে দেখে আমাদের চলার গতিতে পড়ে ছেদ। ছড়ার পানি পড়ার দৃশ্য নান্দনিক সন্দেহ নেই। তবে প্রয়োজনের কথাও ভুলিনি। সেখানে বোতলে পানি ভরে গন্তব্যের পথে আবার চলা শুরু হয় আমাদের।আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ চিনতে কোনো সমস্যা হয়নি আমাদের। কেননা, মাতাই পূখিরীতে আসার অভিজ্ঞতা ছিল আমাদের সঙ্গী ত্রিপুরা ছেলে রিয়াজের। অন্য দুই সঙ্গী রিপন চাকমা ও দীপঙ্করও একবার এসেছিলেন। তাই নির্বিঘ্নে পৌঁছে যাই আমরা আমাদের গন্তব্যে। চারদিকে পাহাড় ও গাছপালাবেষ্টিত মাতাই পূখিরীর দৃশ্য দেখে মনে পড়ে বান্দরবানের বগালেকের সৌন্দর্য। পাহাড়ের এত ওপরে নিটোল পানির এমন আধার সত্যিই আকর্ষণীয়। পূর্ব-পশ্চিম দিকে দীর্ঘ এ পুকুরের আয়তন প্রায় পাঁচ একর। ককবরক ভাষায় মাতাই অর্থ দেবতা এবং পূখিরী মানে পুকুর। এটি দেবতার পুকুর নামেই খাগড়াছড়িতে বেশ পরিচিত।

ছবি: দীপঙ্কর রোয়াজ
ছবি: দীপঙ্কর রোয়াজ

এই পুকুরকে ঘিরে আছে নানা বিশ্বাস ও গল্প। পুকুরের নিচে নাকি গুপ্তধনে ভরপুর এবং সেটির রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত জলদেবতা নিজেই। দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে এখানে ছুটে আসেন অনেক ত্রিপুরা। উদ্দেশ্য—রোগমুক্তি ও ইচ্ছাপূরণ। এখানকার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ চৈত্রসংক্রান্তি। এ উপলক্ষে পুকুরের পাড়ে বসে বিশাল মেলা।এই পুকুরের আদি ইতিহাস নিয়েও আছে নানা কথা। প্রচলিত আছে কোনো একসময় এখানে বড় একটি পাহাড় ছিল এবং সেখানে চাষাবাদ করতেন এক জুমিয়া। একবার স্বপ্নে সে জুমিয়া আদিষ্ট হন নরবলি দেওয়ার। কিন্তু তাঁর সে সামর্থ্য ও ইচ্ছা কোনোটাই ছিল না। এরপর কোনো এক রাতে ভূমিকম্পে গুঁড়িয়ে যায় সে পাহাড়। স্থানীয় অধিবাসীরা সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পান পাহাড়ের জায়গায় বিশাল এক পুকুর। সেই থেকে পুকুরটি হয়ে যায় ত্রিপুরাদের কাছে দেবতাতুল্য। নাম হয় মাতাই পূখিরী। পুকুরটিকে ঘিরে এ রকম আরও অনেক গল্প প্রচলিত আছে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে।পুকুরের উত্তর-পূর্ব কোণে আছে একটি মন্দিরঘর এবং দক্ষিণে টিপরা-অধ্যুষিত থৈদৈ পাড়া। সে পাড়ায় গিয়ে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় আরও অনেক গল্প। তবে গোধূলির আলো ছড়িয়ে পড়ার আগেই আমাদের ফেরার ঘণ্টা বাজে। মুগ্ধমনে ফিরে আসি গামারি ও সেগুন বনবেষ্টিত ছোট ছোট পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে।

ছবি: দীপঙ্কর রোয়াজ
ছবি: দীপঙ্কর রোয়াজ

যেভাবে যাবেন

ঢাকার কলাবাগান, ফকিরাপুল কিংবা সায়েদাবাদ থেকে এস আলম, সৌদিয়া অথবা শান্তি পরিবহনের যেকোনো বাসে সরাসরি যাওয়া যায় পার্বত্য শহর খাগড়াছড়ি। খাগড়াছড়ি সদর থেকে দেবতা পুকুরের পাদদেশীয় এলাকা থুলিপাড়া পর্যন্ত যেতে পারেন রিজার্ভ অটোরিকশায়। এ ক্ষেত্রে ভাড়া একটু বেশি গুনতে হবে। খরচ বাঁচাতে চাইলে শহরের বাসস্ট্যান্ড থেকে রাঙামাটিগামী যেকোনো বাসে চেপে নামবেন মাইসছড়িতে। সেখান থেকে থুলিপাড়া পর্যন্ত যাওয়ার কোনো বাহন নেই। অতএব, ঘণ্টা খানেকের মতো পথ হেঁটেই যেতে হবে।