ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দশক

শুধু রাজপরিবারে জন্মেছেন বলেই নয়, নিজের পড়ালেখা, প্রজ্ঞা, নানা সামাজিক কাজে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নিজের একটা আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন প্রিন্স উইলিয়াম। দ্য রয়্যাল ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তরুণদের নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প, সংস্থা পরিচালনা করেন তিনি। টেড টকের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে দেওয়া এক বক্তব্যে বর্তমান সময় ও পরিবেশ নিয়ে নিজের ভাবনা তুলে ধরেছেন গত অক্টোবর মাসে।

প্রিন্স উইলিয়াম
ছবি: সংগৃহীত

বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পরিবারে ইতিহাস সম্পর্কে একটা ধারণা হয়ে যায়। আমি কেবল লাইনের সামনে দাঁড়ানো একজন। পেছনে আপনি বহু প্রজন্মের দেখা পাবেন। আমার পেছনে যে ওকগাছটা দেখতে পাচ্ছেন, এর সঙ্গে উইন্ডসর ক্যাসলের নিবিড় সম্পর্ক আছে। ৯০০ বছরের বেশি সময় ধরে এই উইন্ডসর আমাদের ঘর। ৩৯ জন রাষ্ট্রনায়ক এখানে বসবাস করেছেন, আশপাশের সুন্দর পরিবেশ উপভোগ করেছেন।

এই জায়গায় আমি বহুবার হেঁটেছি। যতবার আসি, প্রতিবার অবাক হয়ে ভাবি, এখানে কিছু গাছ আছে—এখানকার মাটি, বৃষ্টি, রোদে বেড়ে ওঠা কিছু জীবন্ত প্রাণ; উইন্ডসরের প্রথম পাথরটা বসানোর সময়ও ওরা এখানে ছিল। তার মানে এখানকার কয়েকটি ওকগাছের বয়স এক হাজার বছরের বেশি। ১০৬৬ সালে উইলিয়াম দ্য কনকিওরারের শাসনামলে একটা সাধারণ ওকগাছের ফল থেকে এই গাছগুলো অঙ্কুরিত হয়েছিল। অষ্টম হেনরি যখন এখানে থাকতেন, তত দিনে গাছগুলো মোটামুটি পরিপূর্ণ হয়েছে, বিশালাকায় হয়ে উঠেছে। আশ্চর্যজনকভাবে, সেই সময়ের কিছু গাছ আজও বেঁচে আছে। এবড়োখেবড়ো হয়ে গেছে, কোথাও গর্ত হয়ে গেছে, কিন্তু এখনো ওরা ভীষণ সজীব।

এই গাছগুলো বেড়ে ওঠার সময় সাড়ে তিন হাজার কোটি মানুষ পৃথিবীতে জীবন ধারণ করেছে। তার মানে হলো সাড়ে তিন হাজার কোটি জীবনের আশা, ভালোবাসা, ভয় ও স্বপ্ন। এই সময়ের মধ্যে মানুষ আকাশযান, টিকা ও কম্পিউটার আবিষ্কার করেছে। আমরা পৃথিবীর প্রতিটি কোনায় পৌঁছেছি, মানবদেহের জিন সিকোয়েন্স উন্মোচন করেছি, এমনকি পেরিয়ে গেছি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল। আমাদের আবিষ্কারের গতি ছিল অবিশ্বাস্য, কিন্তু একই সঙ্গে এর প্রভাবও পড়েছে দ্রুতগতিতে।

ভুগব আমরাও

আমার দাদির জীবদ্দশায়, গত ৯০ বছরে প্রভাবগুলো এতটাই গতি পেয়েছে যে সমুদ্র, বাতাস, পরিবেশ ও এর ওপর যা কিছু নির্ভরশীল, সবই চরম বিপদের মুখে পড়েছে। এই ওকগাছ এখানে শত বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু এমন একটা দশকের মুখোমুখি কখনো হয়নি।

এটা ইতিহাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সময় জেনেই আমরা এই দশকে পা রেখেছি। বিজ্ঞান অপরিবর্তনীয়। যদি এই দশকেও আমরা কিছু না করি, যে ক্ষতি আমরা করেছি, তা আর কখনো ফেরানো যাবে না। এর প্রভাব শুধু আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মই নয়, আমাদেরও ভোগ করতে হবে। আরও জানিয়ে রাখি, এই ক্ষতি সবাই একইভাবে অনুভব করবে না। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, যাঁদের সম্পদ সবচেয়ে কম এবং যাঁরা পরিবেশের এই ক্ষতিসাধনে সবচেয়ে কম ভূমিকা রেখেছেন, তাঁরাই ভুগবেন সবচেয়ে বেশি।

এই অবাধ্য সমস্যাগুলোর সমাধান আমরা কীভাবে করব? আসন্ন দুর্যোগ অপ্রতিরোধ্য মনে হলেও এটা ঠেকানো সম্ভব। লক্ষ্য ঠিক করা ও তা অর্জনের সংগ্রাম করার অনন্যসাধারণ সক্ষমতা মানুষের আছে। ১৯৬১ সালে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি বলেছিলেন, এক দশকের মধ্যে তিনি মানুষকে চাঁদে পাঠাবেন। তাঁর এই কথা আমাকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করে। তিনি এই লক্ষ্যের নাম দিয়েছিলেন ‘মুনশট’। শুনে পাগলামি মনে হতে পারে। তখন মাত্রই প্রথম স্যাটেলাইটের যাত্রা শুরু হয়েছে। এত দ্রুত মানুষকে চাঁদে পাঠানোর স্বপ্ন তখন একেবারেই অবান্তর। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জটাই সবাইকে ভীষণ নাড়া দিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, এই লক্ষ্য হলো আমাদের শক্তি ও দক্ষতার পরীক্ষা। মানব ইতিহাসের এই বড় ঘটনায় মুনশটের পেছনের মানুষেরা সারা পৃথিবীর লাখো মানুষকে এমনভাবে এক করেছিলেন, যে লক্ষ্যটা তখন আর এতটাও খ্যাপাটে মনে হয়নি। এই লক্ষ্য অর্জনের পথেই মানুষ আবিষ্কার করেছে শ্বাস নেওয়ার যন্ত্র, সিএটি স্ক্যানার ও সৌর প্যানেল।

পৃথিবীর মেরামত

এখন, এই দশকে এসে আমাদের মুনশট নয়, আর্থশট প্রয়োজন। সেই একই উদ্ভাবনী দক্ষতা, অদম্য ইচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের মোকাবিলা করা উচিত সর্বকালের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—পৃথিবীর মেরামত। আমাদের প্রজন্মের লক্ষ্যটা পরিষ্কার। সবাই মিলে পরিবেশকে পুনরুদ্ধার করতে হবে, বাতাসকে করতে হবে বিশুদ্ধ, সাগরকে বাঁচাতে হবে, বর্জ্যমুক্ত পৃথিবী গড়ে পরিবেশটা ঠিক করতে হবে। এক দশকের মধ্যেই আমাদের এই সব করার চেষ্টা করতে হবে।

যদি ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে পারি, জীবনটা আরও খারাপ হবে না, যা কিছু আমরা উপভোগ করি, তা আর বিসর্জন দিতে হবে না। বরং আমরা আরও স্বাস্থ্যকর, পরিচ্ছন্ন, বুদ্ধিদীপ্ত জীবন যাপন করতে পারব।

সারা বিশ্ব যেভাবে কোভিড-১৯–এর ক্ষেত্রে সাড়া দিয়েছে, তা প্রমাণ করে যে ক্ষমতায় থাকা মানুষগুলো সক্রিয় হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে তাঁরা অনেক কিছু করতে পারেন। আমরা রাতারাতি হাসপাতাল তৈরি করেছি, কলকারখানাগুলো চালু রাখার ভিন্ন উপায় বের করেছি, লাখ লাখ মানুষকে টিকা খোঁজার কাজে লাগিয়ে দিয়েছি। আর আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে ছড়িয়ে থাকা নায়কেরা। পরিবর্তন খুব কঠিন—তরুণেরা এখন আর সেটা বিশ্বাস করেন না। কারণ তাঁরা দেখেছেন, পৃথিবী কীভাবে রাতারাতি আমূল পাল্টে গেছে। তাঁরা বিশ্বাস করেন পরিবেশের সংকট ও জীববৈচিত্র্যের ওপর হুমকি রুখতে আমাদের পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া উচিত। আর তাঁরা সঠিক।

এখনই সময়

এখন আমাদের সবার নেতৃত্বের গুণাবলি দেখানোর সময়। আপনি হতে পারেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন কৃষক, চীনের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, কেনিয়ার রাজনীতিবিদ, ব্রিটেনের ব্যাংকার, মালদ্বীপের জেলে, ব্রাজিলের নেতা বা ভারতের একজন শিক্ষার্থী। প্রত্যেককে প্রত্যেকের জায়গা থেকে যতটুকু সম্ভব ভূমিকা রাখতে হবে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে, নানা খাতের যেসব মানুষ আর্থশটের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করছেন, আমার জায়গা থেকে আমি তাঁদের পুরস্কৃত করব। ভাবুন তো, মানুষ যদি একবার বিশ্বাস করে এই আর্থশট, এই চ্যালেঞ্জে জেতা সম্ভব, না জানি কত সম্ভাবনা উন্মোচিত হবে!

আশাবাদী হয়ে বছর শুরু করেছিলাম, আশাবাদ দিয়েই শেষ করতে চাই। এই বিশালকায় ওকগাছের তুলনায় আমাদের জীবন খুব ছোট্ট, কিন্তু ওরা যেন আরও এক হাজার বছর বাঁচতে পারে, সেটা নিশ্চিত করার ক্ষমতা ও সম্ভাবনা আমাদের হাতে আছে। তবে পৃথিবীকে মেরামত করতে হলে আমাদের সেরা মেধাগুলোর ব্যবহার করতে হবে। সফলতা ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো পথ নেই।

ইংরেজি থেকে অনুদিত